ভারতের প্রতিবাদ

দলীয় পরিচিতির ঊর্ধ্বে উঠিলে রাজনৈতিক প্রতিবাদও কেমন বহুবর্ণ, বহুধা হইয়া উঠিতে পারে, ১৯ ডিসেম্বর তাহা প্রমাণ করিল।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২১ ডিসেম্বর ২০১৯ ০০:১২
Share:

রাজনীতি মানে যে শুধু দলীয় পতাকা বহন নহে, ১৯ ডিসেম্বরের ভারত তাহা দ্ব্যর্থহীন ভঙ্গিতে জানাইয়া দিল। দেশের কার্যত প্রতিটি প্রান্তে নয়া নাগরিকত্ব আইনের বিরুদ্ধে যে বিপুল প্রতিবাদ হইল, তাহার উদ্যোক্তা কোনও রাজনৈতিক দল নহে। কিন্তু, রাজনীতি বিলক্ষণ ছিল। গণতন্ত্রের প্রাণশক্তি যে রাজনীতি, তাহাই— শাসকদের বিভেদনীতির বিরুদ্ধে দেশের নাগরিকেরা পথে নামিয়া নিজেদের অবস্থান প্রকট করিলেন। কাহারও মনে পড়িতেছে ‘রং দে বসন্তী’ ছবিটির কথা, কেহ ভাবিতেছেন আরব বসন্তের তাহরির স্কোয়ারের কথা। একশত বৎসর পূর্বের অন্য একটি আন্দোলনের কথাও মনে পড়িতে পারে— ভারতের প্রথম অহিংস অসহযোগ আন্দোলন। সমাজের বিভিন্ন স্তরের, বিভিন্ন পরিচিতির মানুষ যে ভাবে পথে নামিয়াছেন, যে ভঙ্গিতে নিজেদের প্রতিবাদ জানাইয়াছেন, তাহার সহিত সেই আন্দোলনের মিল দেখিতে পাওয়া স্বাভাবিক। তবে, সেই আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়াছিলেন মোহনদাস কর্মচন্দ গাঁধী। বর্তমান প্রতিবাদটি কার্যত নেতৃত্বহীন। তাহার সুবিধা যেমন আছে, অসুবিধাও অনেক। সচেতন থাকা প্রয়োজন।

Advertisement

দলীয় পরিচিতির ঊর্ধ্বে উঠিলে রাজনৈতিক প্রতিবাদও কেমন বহুবর্ণ, বহুধা হইয়া উঠিতে পারে, ১৯ ডিসেম্বর তাহা প্রমাণ করিল। সেই মিছিলে শ্রমজীবী মানুষের পোস্টার বলিয়াছে, ক্ষুধার্ত মানুষ কাঁটাতার বোঝে না, ভাত বোঝে। আবার, যুবকের হাতের পোস্টারে স্বীকারোক্তি, বিজেপিকে ভোট দিয়া তিনি ভুল করিয়াছিলেন। দিল্লির মিছিল পুলিশ ব্যারিকেডের সম্মুখে থামিয়া পুলিশের হাতে গোলাপ ফুল তুলিয়া দিয়াছে। বেঙ্গালুরুতে পুলিশকে ঘিরিয়া প্রতিবাদীরা গাহিয়া উঠিয়াছেন ‘জনগণমনঅধিনায়ক জয় হে!’ পুলিশও গলা মিলাইয়াছে। যে জাতীয় সঙ্গীতকে গৈরিক বাহিনী উগ্রতার অস্ত্র করিয়া তুলিয়াছিল, তাহাকে ফের অহিংস সর্বজনীন ভারতের হাতে ফিরাইয়া আনিল এই মিছিল। কলিকাতার মিছিল গান গাহিয়াছে, ছবি আঁকিয়াছে— পথচলতি মানুষ পা মিলাইয়াছেন সেই মিছিলের স্রোতে, শামিল হইয়াছেন প্রতিবাদে। রাজনৈতিক পতাকার তলায় সংগঠিত হইলে এই প্রতিবাদী মিছিল কি এমন গ্রহণশীল হইতে পারিত?

এই মিছিল আরও একটি কথা বুঝাইয়া দিল— ধর্মীয় মেরুকরণের রাজনীতির বিপ্রতীপে বহুবর্ণ জোট বাঁধা সম্ভব। নয়া নাগরিকত্ব বিল বা নাগরিক পঞ্জির বিরুদ্ধে লড়াই শুধু ‘যাহাদের পোশাক দেখিলেই চেনা যায়’, তাহাদের নহে— মিছিল ইহা বুঝাইয়া ছাড়িয়াছে। ধর্ম, জাতি, আর্থিক অবস্থা, বয়স, বাসস্থান হইতে যৌনতা— প্রতিটি প্রশ্নের বিভিন্নতা ১৯ তারিখের দেশজোড়া প্রতিবাদে প্রকট। গত কাল দিল্লির জামা মসজিদে ভীম আর্মির বিক্ষোভও তাৎপর্যপূর্ণ। মুসলমানদের বিপন্নতার প্রশ্নে দলিতরা তাঁহাদের পার্শ্বে দাঁড়াইয়া জোট বাঁধিতেছেন, এই সংবাদে বিভাজনের কারবারিরা বিচলিত হইবেন। ‘আমি হিন্দু, কিন্তু বোধহীন নই’ এই মর্মে পোস্টার লইয়া যে যুবক মিছিলে হাঁটিলেন, ‘আজ়াদি’ স্লোগানের সহিত গলা মিলাইলেন যে অজস্র নাগরিক, তাঁহাদের একটি পরিচিতির সূত্রেই বাঁধা সম্ভব— তাঁহারা প্রত্যেকে ভারতীয়। নয়া নাগরিকত্ব আইনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ যে আসলে কোনও বিশেষ ধর্মের নহে, ইহা সামগ্রিক ভাবে ভারতের প্রতিবাদ, এই কথাটি দিল্লির ক্ষমতার মসনদ অবধি পৌঁছাইল নিশ্চিত।

Advertisement
(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন