নেশায় এই গ্রাম যাত্রা-সম্বল

বাঁকুড়ার পশ্চিমে প্রত্যন্ত এই বারকোণা গ্রাম এক ‘যাত্রা বৃন্দাবন’। আজ আনুমানিক নব্বই বছর আগে ‘শ্মশান মিলন’ ছিল এই গ্রামেরই প্রযোজনা। প্রতিকূলতাকে জয় করে এখনও সেই আবেগ ধরে রেখেছেন এই গ্রামের শিল্পীরা। লিখছেন শক্তি চট্টোপাধ্যায়পেশায় এই গ্রাম যাত্রানির্ভর নয়। বরং নেশায় এই গ্রাম যাত্রা-সম্বল। যাত্রা ছাড়া, যে গ্রামের পরিচয় অসম্পূর্ণ।  

Advertisement
শেষ আপডেট: ১৯ মার্চ ২০১৯ ০৮:২৪
Share:

বারকোণা গ্রামে যাত্রাপালা অভিনীত হওয়ার আগে এক শিল্পী। ছবি: লেখক।

শতবর্ষের অনেক আগে থেকেই শৌখিন যাত্রার ক্ষেত্রে মৌলিক বারকোণা গ্রাম। গোটা পশ্চিমবঙ্গে এমন গ্রাম খুঁজে পাওয়া দুষ্কর, যেখানে যাত্রামোদী মানুষ সময়-অর্থ দিয়ে যাত্রার পরিচয়ে বেঁচে থাকতে গর্ববোধ করেন। বাঁকুড়ার পশ্চিমে প্রত্যন্ত এই বারকোণা গ্রাম তেমনই এক ‘যাত্রা বৃন্দাবন’। পেশায় এই গ্রাম যাত্রানির্ভর নয়। বরং নেশায় এই গ্রাম যাত্রা-সম্বল। যাত্রা ছাড়া, যে গ্রামের পরিচয় অসম্পূর্ণ।

Advertisement

আজ থেকে পঞ্চাশ বছর আগে ‘মিলন পূর্ণিমা’, আনুমানিক নব্বই বছর আগে ‘শ্মশান মিলন’ ছিল এই গ্রামের প্রযোজনা। প্রতিটি যাত্রাঙ্কের শেষে ‘সখীনৃত্য’ এখানেই চালু হয়। সেই সময়ে অন্য স্থানে যেখানে ভাড়াটে পুরুষ ‘নর্তকী’ সেজে নাচতেন, সেখানে বারকোণা গ্রামে ‘সখীনৃত্য’ এক সংযোজন ছিল।

ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ ভাগে শিবের গাজনে কোনও এক সময়ে গ্রামের পূর্বপুরুষেরা যাত্রাপালা শুরু করেন। প্রথম প্রথম কৃষ্ণযাত্রা, রামযাত্রা, নিমাইযাত্রা, মনসাযাত্রা প্রভৃতি হত। ওই সমস্ত পালা করতে করতে অজান্তে বড় বড় যাত্রাপালায় অবতীর্ণ হতে শুরু করেন গ্রামবাসী।

Advertisement

বারকোণা গ্রামের শিবমন্দিরটি ১৮৯৮ সালে তৈরি হয়। তৈরি করেন গণেশচন্দ্র পট্টনায়ক। গম্বুজাকৃতি মন্দিরের চারদিকে দালানগাত্রে রয়েছে পত্রাকৃতি, পুষ্পাকৃতি নকশা। মন্দিরে টেরাকোটার বিভিন্ন চিত্র বেশ চিত্তাকর্ষক। মন্দিরগাত্রে প্রতিষ্ঠাতার নাম ছাড়া, কারিগরদের নামও খোদাই করা আছে। ফি বছর পয়লা বৈশাখে শিবের গাজন উপলক্ষে মেলা বসে। এই সময়েই গ্রামের মানুষেরা নতুন যাত্রাপালা মঞ্চস্থ করতেন। মহেশ্বর শিবের নামানুসারে এই শৌখিন যাত্রাদলটির নাম ‘মহেশ্বর অপেরা’।

বিংশ শতকে যখন ব্রিটিশদের দাপটে শব্দে গ্রামবাংলার মাটি কাঁপত, তখনও ব্রিটিশ-বিরোধী যাত্রাপালা মঞ্চস্থ করে এই বারকোনা গ্রাম ইংরেজ শাসকদের চক্ষুশূল হয়ে উঠেছিল। ১৮৯৮ সাল থেকে বারকোণা গ্রামে শৌখিন যাত্রাপালার সূচনা হলে গ্রামের মানুষেরাই পুরুষ ও নারী চরিত্রে অভিনয় করতে শুরু করেন। পঞ্চাশ-ষাট কী সত্তরের দশকে যাত্রার স্বর্ণযুগ শুরু হওয়ার পরে, শহর থেকে ‘বিবেক’-কে ভাড়া করে আনা শুরু হয়। কেন? গ্রামের লোকেরাই তো করতে পারতেন?

ব্রিটিশ যুগে রামায়ণ, মহাভারত বা পুরাণনির্ভর যাত্রাপালাগুলি প্রযোজিত হত। মুসলমান যুগের কাহিনি নিয়েও সে কালে দেদার যাত্রাপালা প্রযোজিত হয়েছিল। একটা সময় এমনও গিয়েছে যে ষোলোআনার চাঁদোয়া বা ত্রিপল খাটিয়ে পেট্রোম্যাক্সের আলোয় বছরের পরে বছর যাত্রাপালা হয়েছে।

সে সময় প্রচারের এমন বাড়বাড়ন্তের ছিল না। তবু দেওয়াল লিখন, খবরের কাগজে আলতা দিয়ে লিখে বিজ্ঞাপন টাঙিয়ে দেওয়া হত। আশপাশের সব গ্রামের মানুষজন এটা জানতেন যে, বারকোণা গ্রামে শিবের গাজনে যাত্রা হয়। ঝাঁটিপাহাড়ির জনৈক যাত্রামোদী শিবপদ চট্টোপাধ্যায় তাঁর লক্ষ্মীপুজোতে জাঁকজমক করে যাত্রার আসর বসাতেন। বাঁকুড়ার প্রত্যন্ত গ্রামে গ্রামে রাস উৎসব, দোল উৎসব, দুর্গোৎসব, কালীপুজো, সরস্বতী পুজো প্রভৃতিতে যাত্রা ছাড়া, উৎসব অপূর্ণ রয়ে যেত। বারকোণা গ্রামের ‘মহেশ্বর অপেরা’ সেই সব উৎসবেও যাত্রা করবার ডাক পেত।

শতাব্দী প্রাচীন যাত্রাদলটির প্রযোজক-আয়োজক গ্রামের মানুষেরা। যাত্রাদলের দেখাশোনার জন্য রয়েছে ‘বারকোণা গ্রাম ষোলোআনা কমিটি’। নানা প্রকার রাজনৈতিক উত্থান-পতন বা ভাঙাগড়াতেও এই কমিটিকে টলাতে পারেনি কেউ। আসলে যাত্রা প্রাণ যাঁদের, তাঁরা যাত্রাচর্চা ছাড়া আর কোনও কিছুতে গা ভাসাতে পারেন না। এই একটা জায়গাতে অন্য গ্রামের থেকে বারকোনা নিজেকে আলাদা করতে পেরেছে। নইলে একটা গ্রাম যাত্রা নিয়ে শতাব্দী পার করতে পারে?

সম্প্রতি কথা হচ্ছিল বারকোণা গ্রামের বাসিন্দা ও ‘মহেশ্বর অপেরা’র অন্যতম প্রধান দুই অভিনেতা জন্মেজয় চট্টোপাধ্যায় ও নয়ন মাজির সঙ্গে। তাঁরা জানাচ্ছিলেন, প্রতি বছর চৈত্র সংক্রান্তি এবং পয়লা বৈশাখ, এই দুই রাতে যাত্রাগান সুনির্দিষ্ট। ‘বিবেক’ চরিত্র ছাড়া, সমস্ত পুরুষ চরিত্রেই গ্রামের অভিনেতারা অভিনয় করেন। অতিথি অভিনেতা আনার প্রয়োজন হয় না। বাংলা যাত্রাশিল্পের গোড়া থেকেই কলকাতার পেশাদার দলগুলির অভিনীত প্রায় সব বিখ্যাত পালা পূর্বজেরা মঞ্চস্থ করে গিয়েছেন। জন্মলগ্ন থেকে আজ পর্যন্ত গ্রামে একটিই যাত্রাদল। বয়স্কেরা ক্রমশ অবসর নিয়ে অল্পবয়সীদের হাতে দায়িত্ব সঁপে দিয়েছেন। বর্তমানে দলে বারো থেকে বাহাত্তর বছরের সক্রিয় সদস্য রয়েছেন।

‘মহেশ্বর অপেরা’-র গত কয়েক বছরের প্রযোজনাগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য—‘বৌ হয়েছে রঙের বিবি’, ‘নরনারায়ণ’, ‘সাত টাকার সন্তান’, ‘তরণীসেন বধ’, ‘মা মাটি মানুষ’ (পুনঃপ্রযোজনা), ‘মীরার বঁধূয়া’, ‘অচল পয়সা’, ‘অমাবস্যায় কোজাগরী’, ‘দেবী সুলতানা’, ‘সত্যযুগ আসছে’, ‘ওগো বিষ্ণুপ্রিয়া’, ‘হরিশ্চন্দ্র শৈব্যা’। জন্মেজয় চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘‘যাত্রা সংস্কৃতিকে বুকে আঁকড়ে গ্রামের মানুষদের বাঁচতে শিখিয়েছেন আমাদের বাপ-ঠাকুর্দারা। আমরাও আগামী প্রজন্মদের একই ভাবে লোকসংস্কৃতির অন্যতম মাধ্যম যাত্রাতে নিয়ে আসছি।’’ তাঁর দাবি, অন্যত্র শিশুদের লেখাপড়ার পাশাপাশি, ছবি আঁকা, গান শেখা যেমন চলে, তা বারকোনাতেও চলে। তবে বিশেষ ভাবে নজর দেওয়া হয় বাচিক দিকটিতে। কারণ, যাত্রায় অভিনয় করতে গেলে স্মৃতিশক্তি যেমন দরকার, তেমনই দরকার স্পষ্ট উচ্চারণ।

রাতভর যাত্রাভিনয় করেও সকালে তরতাজা হয়ে কর্মস্থলে হাজির হয়ে যান গ্রামের অভিনেতারা। প্রতিষ্ঠিত হওয়ার তাগিদ এ গ্রামেও রয়েছে। তবে যাত্রাকে অবহেলা করে সুপ্রতিষ্ঠিত হওয়ার প্রতিযোগিতা এখানে চলে না। শুধু চেষ্টা চলে গ্রামের শৌখিন যাত্রাদলের অস্তিত্বকে বাঁচিয়ে রাখার। গ্রামবাসীর স্বপ্ন, একশো বছর পরেও তাঁদের গ্রাম বেঁচে থাকবে, এই শৌখিন যাত্রাপালার সৌজন্যে।

লেখক বাঁকুড়া বন দফতরে প্রধান করণিক

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন