লিঙ্গ ক’রকম, বেশির ভাগ মানুষের ক্ষেত্রে উত্তর আসে দ্বিত্ব বা ‘বাইনারি’তে: হয় পুরুষ নয় নারী। ‘বাইনারি’ কেন? হয় এক বা শূন্যের মতোই, এ ক্ষেত্রে ব্যাপারটা ওয়াই ক্রোমোজ়োমের থাকা বা না-থাকা। ওয়াই ক্রোমোজ়োমের উপস্থিতি ও সঙ্গে একটি এক্স, সুতরাং মানুষটি পুরুষ। ওয়াই নেই, দু’টি এক্স ক্রোমোজ়োম, অর্থাৎ নারী। গল্পটা আসলে এত সরল নয়। লিঙ্গ নির্ধারণ একগুচ্ছ ফ্যাক্টর দিয়ে তৈরি এক জটিল সার্কিটের কার্যকলাপের ফল।
মানব লিঙ্গ নির্ধারণের ক্ষেত্রে মূলত কাজ করে ওয়াই ক্রোমোজ়োমে থাকা একটি জিন, যার নাম ‘এসআরওয়াই’। এই জিন থেকে তৈরি হওয়া প্রোটিনই ঠিক করে দেয় মাতৃজঠরে থাকা ভ্রূণের যৌনাঙ্গ পুরুষের মতো হবে, না কি নারীর মতো, টেস্টোস্টেরন বেশি তৈরি হবে, না ইস্ট্রোজেন। এই দুই হরমোন আবার ঠিক করে দেয় ভ্রূণের মস্তিষ্ক গঠন পুরুষের মতো হবে, না কি নারীর মতো। পুরুষ ও নারীর মস্তিষ্ক কি তবে আলাদা? না। মস্তিষ্কে থাকা বিশেষ কিছু কোষের কোষপর্দার বাইরে থাকা কিছু গ্রাহক প্রোটিন আলাদা, যেগুলি পুরুষ বা নারীর হরমোনের গ্রাহক হিসেবে বেশি তৎপরতা দেখায়।
এ ছাড়াও লিঙ্গ নির্ধারণের অন্যতম বড় উপাদান হল সময়। গর্ভাবস্থা থেকে বয়ঃসন্ধি পর্যন্ত গড়ে ওঠা যৌনাঙ্গ, হরমোন এবং মস্তিষ্কের কোষগুলির মধ্যে একটা চক্রাকার ‘ফিডব্যাক লুপ’ চলতে থাকে। এই চক্রাকার লুপের গতিপথই ঠিক করে দেয় বয়ঃসন্ধি পর্যন্ত শারীরিক ও মানসিক বিবর্তনের সময় মানবদেহ কতটা পুরুষালি বা নারীসুলভ হয়ে উঠছে। সময় কতটা গুরুত্বপূর্ণ, তার মোক্ষম উদাহরণ হলেন ডমিনিকান রিপাবলিকের ‘গুয়োভেদস’ শ্রেণির মানুষেরা। এই বিশেষ শ্রেণির মানুষদের অবস্থাকে বলা হয় ‘পেনিস অ্যাট টুয়েল্ভ’। গুয়োভেদসরা যখন জন্মান, তখন তাঁদের ‘স্বাভাবিক’ মহিলা বলেই ভাবা হয়। বারো বছর বয়স থেকে তাঁদের পুরুষাঙ্গ দেখা দেয়। উল্লিখিত ফিডব্যাক লুপের সময়টা অনেক সময়ই অনিশ্চিত, যার প্রভাব পড়ে লিঙ্গ নির্ধারণের ক্ষেত্রে। বোঝা যায়, সময় কতটা গুরুত্বপূর্ণ লিঙ্গ নির্ধারণের ক্ষেত্রে। এই ফিডব্যাক লুপের সময় নিয়ন্ত্রণ করে এক উৎসেচক, আলফা রিডাক্টেজ়। এই উৎসেচক টেস্টোস্টেরনকে ডাই-হাইড্রো টেস্টোস্টেরনে পরিণত করে। মানবদেহকে তথাকথিত পুরুষালি করে তোলার কাজটা ডিএইচটি-র, যা গুয়োভেদসদের ক্ষেত্রে বারো বছর বয়স থেকে কাজ শুরু করে। তবে আলফা রিডাক্টেজ় প্রোটিন সৃষ্টিকারী জিন ওয়াই ক্রোমোজ়োমে নয়, রয়েছে মানবকোষের মোট তেইশ জোড়া ক্রোমোজ়োমের দুই নম্বর ক্রোমোজ়োমে, যা পুরুষ-মহিলা নির্বিশেষে সবার দেহকোষেই রয়েছে।
২০১৩ সালে শিকাগো ইউনিভার্সিটি প্রেস থেকে প্রকাশিত সেক্স ইটসেল্ফ: দ্য সার্চ ফর মেল অ্যান্ড ফিমেল ইন দ্য হিউম্যান জিনোম বইয়ে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসবিদ তথা বিজ্ঞানী সারা রিচার্ডসন দেখিয়েছেন, কী ভাবে পরিবর্তিত হয়েছে এক্স ও ওয়াই ক্রেমোজ়োম নিয়ে বিজ্ঞানীদের ধারণা। আসলে দু’টি সেক্স ক্রোমোজ়োমই একটি ক্রোমোজ়োম থেকে সৃষ্ট। তাই ভ্রূণ গঠনের একেবারে প্রাথমিক পর্যায়ে এক্স বা ওয়াই তৈরির সময়ে এক ক্রোমোজ়োমের ছাপ থেকে যায় অন্য ক্রোমোজ়োমে। মহিলাদের দু’টি এক্স ক্রোমোজ়োমের একটিতে অন্তত ৩৬টি জিন পাওয়া যায়, যা আসলে ওয়াই ক্রোমোজ়োমের। ওয়াই ক্রোমোজ়োমেও এক্স ক্রোমোজ়োমের বেশ কিছু জিনের ছাপ থেকেই যায়।
অর্থাৎ পুরুষ বা মহিলা, যে কারও লিঙ্গ নির্ধারণে দায়ী ক্রোমোজ়োমই আদৌ নির্ভেজাল নয়। প্রকৃত পুরুষ বা নারীর অস্তিত্বই টলোমলো। মানবলিঙ্গ আসলে একটি বর্ণালি বা ‘স্পেকট্রাম’, যার পরিধি তৈরি করে দেয় এসআরওয়াই জিনের কার্যকলাপ। মস্তিষ্ক গঠনের সময় সেখানকার কোষের কোষপর্দার বাইরের গ্রাহক প্রোটিনের ঘনত্ব, আলফা রিডাক্টেজ়ের কার্যকলাপ, পুরো সার্কিটটির চক্রাকারে চলতে থাকার সময় এবং সর্বোপরি এক্স ও ওয়াই ক্রোমোজ়োমের কে কতটা অন্যের ছাপ বহন করছে। তথাকথিত পুরুষ বা নারী একটি বিশাল পরিধির বর্ণালির দুই প্রান্তে অবস্থানকারী দু’টি অস্তিত্ব। মাঝের বর্ণালির বিস্তৃতি যথেষ্ট দীর্ঘ, যার মধ্যে রয়েছেন গে, লেসবিয়ান, বাইসেক্সুয়াল, ট্রান্সজেন্ডার, কুইয়ার, যাঁদের এক সঙ্গে বলা হয় ‘এলজিবিটিকিউ’। এ ছাড়াও রয়েছেন অ্যান্ড্রোজিনাস, আ-জেন্ডার, জেন্ডারফ্লুইডরা। এঁদের কেউ হয়তো শারীরিক বা মানসিক ভাবে ঝুঁকে রয়েছেন বর্ণালির কোনও এক প্রান্তের দিকে। বিজ্ঞানীরা এই বর্ণালির এই জটিল সার্কিটের সঙ্গে সম্প্রতি জুড়েছেন আরও কিছু ফ্যাক্টর, যা নারী-পুরুষ উভয়ের দেহকোষেই থাকে। নতুন সার্কিটটিকে ডাকা হচ্ছে ‘সেক্সোম’ নামে। সেক্সোম তত্ত্ব নস্যাৎ করেছে নির্ভেজাল নারী বা পুরুষের অস্তিত্ব।
সুপ্রিম কোর্টের রায় বেরোনর পরে অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন যে সমলিঙ্গের প্রতি আকর্ষণ আদৌ প্রকৃতির নিয়ম মোতাবেক কি না। এর উত্তর মিলবে বিবর্তনের পথে পিছনে হেঁটে। সাম্প্রতিক গবেষণা থেকে জানা যায় শিম্পাঞ্জি ও বোনোবো প্রজাতির ‘গ্রেট এপ’দের সমলিঙ্গের প্রতি আকর্ষণের কথা। যদি গ্রেট এপদের প্রজাতি থেকে মানুষের উদ্ভবের তত্ত্ব সত্যি হয়, তা হলে মেনে নিতেই হবে সমলিঙ্গের প্রতি আকর্ষণ আসলে বিবর্তনের দান। তা হলে গুহামানবেরাও কি সমলিঙ্গের প্রতি আকর্ষণ বোধ করত? ২০১১ সালে চেক প্রজাতন্ত্রে আবিষ্কৃত এক গুহায় খুঁজে পাওয়া গিয়েছিল সমলিঙ্গের দুই সঙ্গীর যৌনক্রীড়ার গুহাচিত্র। প্রমাণিত হয়েছে, ছবিটি প্রস্তর যুগের শেষ ভাগের।
গবেষণা প্রমাণ করে চলেছে যে বিবর্তনের পথে ডাইনোসরের মতো তৃতীয় লিঙ্গের প্রাণীদের এবং সমলিঙ্গের প্রতি আকর্ষণবোধকারীদের প্রকৃতি দূরে ঠেলেনি। প্রাকৃতিক নির্বাচনেই তারা টিকে গিয়েছে। প্রকৃতির চোখেও লিঙ্গভেদ ‘বাইনারি’ নয়, বর্ণালি।