সম্পাদকীয় ১

বিচারক

অনুমান, এই হত্যাকাণ্ডে গোটা দেশ এমন বিচলিত হইয়াছিল যে কাহাকে অপরাধী হিসাবে পেশ না করিলে পুলিশের উপর চাপ অসহ হইতেছিল।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৫ নভেম্বর ২০১৭ ০১:১০
Share:

অশোক কুমারের একটি কথাও বিশ্বাস করিবার বাধ্যবাধকতা নাই। রায়ান ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করিবার জন্য পুলিশ তাঁহার উপর যে অত্যাচার করিয়াছিল বলিয়া স্কুলবাসের কন্ডাক্টর অশোকের অভিযোগ, প্রমাণিত না হওয়া অবধি সেই অভিযোগকে গুরুত্ব দেওয়ার প্রয়োজন নাই। রাষ্ট্রযন্ত্র সাক্ষী, হাজতে পুলিশি অত্যাচারের অভিযোগ প্রমাণ করা নেহাত সহজ কাজ নহে। বিশেষত অশোক কুমারের মতো মানুষের পক্ষে, যাঁহার অর্থনৈতিক বর্গ-পরিচিতি তাঁহাকে সামাজিক সহানুভূতির দাবিদার করিতে পারে না। সোশ্যাল মিডিয়ার নাগরিকরা বুঝাইয়া দিয়াছেন, রাষ্ট্রের শাখাপ্রশাখার বিরুদ্ধে কে আঙুল তুলিতেছেন, সেই পরিচিতিটি অভিযোগের সামাজিক গ্রাহ্যতা অর্জনের গুরুত্বপূর্ণ। কোনও এক প্রাক্তন দিনমজুরের পার্শ্বে দাঁড়াইবার তাগিদ ক্ষীণ, অতি ক্ষীণ। অতএব, অশোকের যুদ্ধটি একার। স্কুলেরই দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্র গ্রেফতার হইবার পরও বিশ্বাস করিবার প্রয়োজন নাই যে অশোক প্রকৃত খুনি নহেন। কিন্তু, তাঁহার অপরাধ প্রতিষ্ঠিত হইবার পূর্বেই যে পুলিশ তাঁহাকে খুনি হিসাবে দুনিয়ার সম্মুখে পেশ করিয়াছিল, এই কথাটি কোনও প্রমাণের অপেক্ষা রাখে না। অপরাধ প্রমাণিত হইবার পূর্বেই যে তাঁহাকে, এবং তাঁহার পরিবারকে, শাস্তি ভোগ করিতে হইয়াছে, সেই সত্যকে অস্বীকার করিবার কোনও উপায় নাই। পুলিশ কী ভাবে সেই ক্ষতি পূরণ করিবে? শেষ অবধি অশোক কুমার যদি নিরপরাধ প্রমাণিত হন, কোন মন্ত্রে পুলিশ তাঁহার জীবনের স্বাভাবিকতা ফিরাইয়া দিবে?

Advertisement

অনুমান, এই হত্যাকাণ্ডে গোটা দেশ এমন বিচলিত হইয়াছিল যে কাহাকে অপরাধী হিসাবে পেশ না করিলে পুলিশের উপর চাপ অসহ হইতেছিল। এবং, সেই কারণেই, অপরাধ প্রমাণিত হইবার পূর্বে, বিচার আরম্ভ হওয়ার পূর্বে, পুলিশ অশোক কুমারকে দোষী ঘোষণা করিয়া দিল। অনুমান করিবার কারণ আছে যে অশোকের আর্থসামাজিক পরিচয় পুলিশের পক্ষে তাঁহাকে দোষী ঘোষণা করিবার কাজটিকে সহজ করিয়াছে। তিনি দিল্লি-হরিয়ানা অঞ্চলের খাটিয়া খাওয়া শ্রেণির পুরুষ, এবং সাম্প্রতিক কালে বেশ কিছু ধর্ষণ বা নৃশংস খুনের ঘটনায় এই শ্রেণির পুরুষরা জড়িত— এই দুইটি তথ্য একত্র করিলে যে যৌক্তিক সিদ্ধান্তে পৌঁছানো সহজ, পুলিশ তাহাতেই পৌঁছাইয়াছে। এবং, ভুল করিয়াছে। অশোক কুমার দোষী না নির্দোষ, তাহা এখনও বিচারসাপেক্ষ, কিন্তু বহু অপরাধী কোনও একটি বিশেষ জনগোষ্ঠীর মানুষ মানেই সেই জনগোষ্ঠীর প্রতিটি মানুষ অপরাধী, অথবা তাঁহাদের অপরাধী হইবার সম্ভাবনা বেশি, এহেন সিদ্ধান্ত সংখ্যাতত্ত্বের প্রাথমিক নিয়মেই রদ হইয়া যায়। কিন্তু, পুলিশ অথবা সমাজ, কেহই সেই প্রাথমিক বিচারটুকুর তোয়াক্কা করে নাই। অশোক কুমারকে দোষী ঘোষণা করিয়া দিয়াছে।

কাহাকে অপরাধী ঘোষণা করা নহে, পুলিশের কাজ যে আদালতের সম্মুখে অভিযোগ ও তাহার সপক্ষে প্রমাণ পেশ করা, এই কথাটি পুলিশ ভুলিয়াছে। সমাজও। কলিকাতা পুলিশের ফেসবুক পেজও তাহার একটি নিদর্শন বলিয়া অভিযোগ। কাহাকে গ্রেফতার করিয়া তাঁহার ছবিসহ অপরাধের বিস্তারিত এবং বিশেষণালংকৃত বিবরণ ফেসবুকের পাতায় তুলিয়া দেওয়া এখন কলিকাতা পুলিশের দস্তুর। কাহারও অপরাধ প্রমাণিত হইবার পূর্বে যে তিনি নিরপরাধ হিসাবেই গণ্য, এবং প্রতিটি নিরপরাধ মানুষের ব্যক্তিগত গোপনীয়তা ও সম্মানের অধিকার রহিয়াছে, সহজ হাততালির মোহে পুলিশ তাহা ভুলিয়াছে বলিয়াই নাগরিক সমাজের একাংশের মত। এই নিরিখে কলিকাতা পুলিশের ফেসবুক পেজে ‘অপরাধী’র তকমা পাওয়া অভিযুক্তদের সহিত অশোক কুমারের কোনও মৌলিক ফারাক আছে কি?

Advertisement
(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন