সম্পাদকীয় ১

সর্বোচ্চ অধিকার

সাংবিধানিক বেঞ্চের এই রায়টিকে অন্য কিছু সাম্প্রতিক রায়ের সহিত মিলাইয়া পড়িলে স্পষ্ট হইবে, ব্যক্তির অধিকার এখন ভারতীয় বিচারব্যবস্থার দার্শনিক ভিত্তি।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১৩ মার্চ ২০১৮ ০০:১৬
Share:

অবশেষে নিষ্কৃতিমৃত্যুর জন্য হাই কোর্টের দ্বারস্থ হইবার বাধ্যবাধকতা ঘুচিল। সুপ্রিম কোর্টের পাঁচ সদস্যের সাংবিধানিক বেঞ্চ জানাইয়াছে, সম্মানজনক মৃত্যুর অধিকার সংবিধানের ২১তম অনুচ্ছেদের অনস্বীকার্য অংশ। আদালত সংবিধানের ব্যাখ্যা করিয়া জানাইয়াছে, সম্মানজনক মৃত্যুর অধিকারকে স্বীকৃতি দিতে নূতন কোনও আইনের প্রয়োজন নাই, ভারতীয় সংবিধানেই তাহার পরিসর রহিয়াছে। এবং, অ-সম্মানের জীবন অপেক্ষা সম্মানের মৃত্যু বাছিয়া লওয়ার অধিকারটি রহিয়াছে প্রত্যেক ভারতীয়ের। সুস্থ শরীরে, সজ্ঞানে, কেহ যদি নিষ্কৃতিমৃত্যুকে বাছিয়া লহেন, রাষ্ট্র তাঁহার সেই অধিকারটিকে সম্মান করিতে বাধ্য। কথাটি ভাবিবার মতো— সংবিধানের যে ধারা মানুষের জীবনের অধিকারকে স্বীকৃতি দেয়, আদালতের মতে, সেই ধারাতেই সম্মানজনক মৃত্যুর অধিকারও সিদ্ধ। অর্থাৎ, যে রোগীর অস্তিত্ব কেবলমাত্র প্রাণের ধুকপুকানিটুকুই, যাঁহার সুস্থ হইয়া উঠিবার ন্যূনতম সম্ভাবনাও নাই, তাঁহার জীবন প্রকৃত প্রস্তাবে তাঁহার সম্মানজনক জীবনের অধিকারটিকেই ক্ষুণ্ণ করে। দার্শনিক ব্যাখ্যা বলিবে, মানুষ বলিতে কেবলমাত্র একটি জৈব অস্তিত্ব নহে— তাহার অধিক কিছু। মানুষের মনুষ্যত্বের আকর তাহার সক্ষমতা। শারীরিক এবং মানসিক সক্ষমতা। কেহ যদি সেই ক্ষমতা চিরতরে হারান, তবে তাঁহার মনুষ্যত্ব খণ্ডিত হয়, খর্ব হয়। এবং খণ্ডিত অস্তিত্বকে— এবং তাহার অঙ্গাঙ্গি অসম্মানকে— তিনি স্বীকার করিবেন কি না, সেই সিদ্ধান্তের অধিকার সংবিধান ব্যক্তিবিশেষকেই দিয়াছে।

Advertisement

সাংবিধানিক বেঞ্চের এই রায়টিকে অন্য কিছু সাম্প্রতিক রায়ের সহিত মিলাইয়া পড়িলে স্পষ্ট হইবে, ব্যক্তির অধিকার এখন ভারতীয় বিচারব্যবস্থার দার্শনিক ভিত্তি। গোপনীয়তার অধিকারকে স্বীকার করিয়া লওয়াই হউক অথবা তাৎক্ষণিক তিন তালাককে বেআইনি ঘোষিত করা, নাবালিকা স্ত্রীর সহিত সহবাসকে ধর্ষণ হিসাবে গণ্য করা বা পারস্পরিক সম্মতিক্রমে বিবাহবিচ্ছেদের ক্ষেত্রে ছয় মাসের অপেক্ষার মেয়াদকে আর বাধ্যতামূলক না রাখা— আদালতের সাম্প্রতিক রায়গুলির প্রতিটিতেই ব্যক্তির অধিকারের সর্বাগ্রণ্যতা স্বীকৃত হইয়াছে। নিষ্কৃতিমৃত্যুর ক্ষেত্রে সেই স্বীকৃতি অতি স্পষ্ট। আত্মহত্যা বা অ্যাকটিভ ইউথানেসিয়া (অর্থাৎ, যে ক্ষেত্রে চিকিৎসকরা ঔষধ প্রয়োগ করিয়া রোগীর জীবনে যবনিকা টানিয়া দেন) আইনসিদ্ধ হয় নাই— অর্থাৎ, কেহ চাহিলেই নিজের জীবন শেষ করিয়া দিতে পারেন না। কিন্তু, যেখানে নিয়ন্ত্রণাতীত কোনও কারণে জীবনের গুণগত মান, এবং অর্থ, খণ্ডিত, সেখানে জীবন শেষ করিবার অধিকারটি স্বীকার করিয়া লওয়ার অর্থ, নিজের উপর নিজের অধিকারের সর্বোচ্চ স্বীকৃতি। রাষ্ট্র, সমাজ অথবা বিশেষজ্ঞরা নহেন, নিজের জীবনকে নিয়ন্ত্রণ করিবার সর্বাধিক ক্ষমতা যে ব্যক্তিরই হাতে, আদালতের রায়ে সেই কথাটি দ্ব্যর্থহীন।

তবে, নিষ্কৃতিমৃত্যু ঘটাইবার ক্ষেত্রে আদালত কঠোর নিয়মবিধি বাঁধিয়া দিয়াছে। প্রতিটি ক্ষেত্রেই হাই কোর্টের সম্মতি গ্রহণের বাধ্যবাধকতা গিয়াছে, কিন্তু বিচারবিভাগের অনুমোদনের শর্ত আছে। বাধ্যতামূলক অপেক্ষার নির্দেশটি লইয়াও প্রশ্ন আছে। রায়ে কিছু ক্ষেত্রে চিকিৎসাশাস্ত্রের আধুনিক ভাষাও ব্যবহৃত হয় নাই বলিয়া বিশেষজ্ঞদের মত। অনেকের মতে, পদ্ধতিগত জটিলতার কারণে কাহারও নিষ্কৃতিমৃত্যুর সিদ্ধান্তটির বাস্তবায়ন কঠিন হইতে পারে। আবার সম্পূর্ণ বিপরীত আশঙ্কাটিও আছে— এই আইনি ছাড়পত্রের ফাঁক গলিয়া কাহারও ইচ্ছার অমতে তাঁহার প্রাণহরণ করা হইতে পারে। দুর্নীিত সর্বশক্তিমান। ফলে, আদালতের সিদ্ধান্তটির দার্শনিক গুরুত্ব যেমন স্বীকার করা প্রয়োজন, তেমনই তাহার প্রয়োগগত জটিলতা এবং অপপ্রয়োগের দিকেও দৃষ্টি রাখা বিধেয়। প্রশ্নটি মানুষের প্রাণের, ফলে গাফিলতির অবকাশ নাই।

Advertisement
(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন