শেরপারা জানেন, পর্বতশৃঙ্গে ওঠার কোনও শর্টকাট নেই

হঠাৎ এভারেস্ট হয় না

২৯ মে, ১৯৫৩ সাল। সেই দিনই এভারেস্টের চূড়ায় প্রথম পা রেখেছিল মানুষ। কিন্তু সেই ভোরেও তেনজিং গোম্ফা দেখছেন। সে কথা অবশ্য রেকর্ড বইয়ে লেখা নেই।

Advertisement

গৌতম চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ২৭ মে ২০১৮ ০০:০২
Share:

শৃঙ্গপথে: এভারেস্ট বেস ক্যাম্প। শেরপা ও পর্বতারোহী সকলে এক সঙ্গে। ছবি: চন্দ্রনাথ দাস

ভোর সাড়ে তিনটে নাগাদ দু’জনের ঘুম ভেঙে গেল। অতঃপর স্টোভে বরফ গলানো শুরু, সকালের কফিটা খেতে হবে তো! আগের বিকেলে ২৭,৯০০ ফুট উঁচুতে ফেলা হয়েছে তাঁবু। দূরে, অনেক নীচে লোৎসে ও মাকালু শৃঙ্গ। এত উঁচুতে মানুষের প্রথম রাত্রিবাস! প্রথম নভশ্চর ইউরি গ্যাগারিনের মহাকাশে পৌঁছতে পৌঁছতে আরও আট বছর কেটে যাবে!

Advertisement

তাঁবুর দরজা খুলে বেরিয়ে এলেন তেনজিং নোরগে আর এডমন্ড হিলারি। ভোরের প্রথম আলোয় তেনজিং হিলারিকে দেখালেন, ‘‘ওই যে নীচের ছোট্ট বিন্দুটা, ওটাই থিয়াংবোচে গোম্ফা!’’

২৯ মে, ১৯৫৩ সাল। সেই দিনই এভারেস্টের চূড়ায় প্রথম পা রেখেছিল মানুষ। কিন্তু সেই ভোরেও তেনজিং গোম্ফা দেখছেন। সে কথা অবশ্য রেকর্ড বইয়ে লেখা নেই।

Advertisement

রেকর্ড বইয়ে অনেক কিছু থাকে না। যেমন বেস ক্যাম্পের রান্নাঘরে অন্য শেরপারা ঘিরে
ধরেছিল তেনজিংকে, ‘‘তুমি সর্বনাশ ঘটাতে যাচ্ছ। একটু ভাবো।’’

‘‘কী সর্বনাশ?’’

‘‘পাহাড়চুড়োয় দেবতা থাকেন। তোমার মৃত্যু অবধারিত। আর, বেঁচে ফিরলেও আমাদের সবাইকে মারবে। এক বার চুড়োয় কেউ উঠলে সাহেবরা আর আসবে এভারেস্টের পথে?’’

তেনজিং ঘাড় নাড়লেন, ‘‘বাজে কথা। এভারেস্ট জয় মানে সারা দুনিয়া আমাদের আরও চিনবে। তখন আরও বেশি অভিযান হবে, আমাদের শেরপাদের আরও, আরও কাজের সুযোগ আসবে।’’

পঁয়ষট্টি বছরে সেই ভবিষ্যদ্বাণী মোক্ষম ফলে গিয়েছে। গত ডিসেম্বর অবধি ৮৩০৬ পর্বতারোহী এভারেস্ট শিখরে পৌঁছেছেন, মারা গিয়েছেন ২৮৮ জন। প্রতিনিয়ত কোনও না কোনও ভাবে তৈরি হচ্ছে রেকর্ড। এ বারই ৪৮ বছরের কামি রিটা ২২ বার এভারেস্ট ছুঁয়ে এলেন। তাঁর বক্তব্য, বয়স থাকতে থাকতে আরও তিন বার… মানে সবসুদ্ধ ২৫ বার এভারেস্টে উঠলে তাঁর স্বপ্ন পূর্ণ হবে। মেয়েরাও পিছিয়ে নেই। এই মাসেই নবম বার এভারেস্ট জয় করে ফিরলেন লাকপা শেরপা। তিন সন্তানের জননী লাকপা আমেরিকার কানেটিকাট প্রদেশের এক রেস্তরাঁয় কাজ করেন।

আজকের প্রজন্মে শেরপাদের সামাজিক গতিমত্তা এখানেই। লাকপা ও তাঁর ভাইবোনেরা সকলে একাধিক বার এভারেস্ট জয় করেছেন। কামি রিটা-র বাবা তেনজিংয়ের আমলে পাহাড়ে সাহেবদের গাইড ছিলেন। কামির আগে যিনি ২১ বার এভারেস্ট জয় করেছিলেন, সেই আপা শেরপার বাবা ইয়াক চরাতেন। আপা এখন আমেরিকায় থাকেন। তেনজিংয়ের নাতি তাশি সিডনিতে একটি পর্বতারোহণ এজেন্সি চালান। আমরা কথায় কথায় প্রান্তিক মানুষ নিয়ে বুকনি দিই, কিন্তু হিমালয়ের ১৪ হাজার ফুট ওপরে চার-পাঁচটা গ্রামে ছড়ানো-ছেটানো এক জনগোষ্ঠী মাত্র ছয় দশকে কী ভাবে বিশ্ব জয় করল, তার খবর রাখি না।

জনগোষ্ঠীটি পাঁচশো বছর আগেই বাস্তুচ্যুত। শেরপারা বিভিন্ন জায়গা থেকে এসে তিব্বতের খাম এলাকায় প্রথম বসতি গড়ে তোলেন। অতঃপর মঙ্গোল আক্রমণ, ১৫৩৩ সালে তাঁরা গিরিপথ পেরিয়ে এসে নেপালের খুম্বু এলাকায় আশ্রয় নেন।

গিরিপথের নাম নাংপা। সব রাস্তাই বেস ক্যাম্প থেকে এভারেস্টের দিকে যায় না। নাংপা গিরিপথ শুরু হয় চিনের রংবুক গোম্ফার কাছে। এই বৌদ্ধ গোম্ফাই চিন থেকে এভারেস্টে ওঠার বেস ক্যাম্প। কিন্তু ১৯,০৫০ মিটার উঁচু গিরিপথটি এভারেস্টকে আকাশে রেখে, অরুণ নদীর উপত্যকা বেয়ে নেপালের খুম্বু এলাকায় ঢোকে।

গিরিপথ জুড়ে পাঁচশো বছরের ইতিহাস। শেরপারা এই রাস্তা বেয়েই ইয়াক চরাতেন, তিব্বত ও ভারতের সঙ্গে বাণিজ্য করতেন। ১৯৩৫ সালে তেনজিংয়ের প্রথম এভারেস্ট যাওয়া এই রংবুক গোম্ফা দিয়ে। পথে বাবার সঙ্গে দেখা। ছেলেকে দেখতে খুম্বু থেকে সেখানে চলে এসেছেন তিনি।

হাল আমলে গিরিপথে রক্তের দাগও লেগেছে। ২০০৬ সালে চিন থেকে ৭৫ জন তিব্বতির একটি দল বরফ-ঢাকা এই পথ বেয়ে নেপালে আসছিলেন। চিনা ফৌজ সেই নিরস্ত্রদের উপর গুলি চালায়। নেপাল হিমালয়ে তখনও কিছু পর্বতারোহী। তাঁদের ভিডিয়ো ক্যামেরাতেই দুনিয়া দেখেছিল নির্মম দৃশ্য। এক ভাষা এক সংস্কৃতি এক জনজাতি। কিন্তু গিরিপথের এ দিকে একটা দেশ, ও দিকে আর একটা। এই ট্র্যাজেডি শেরপারাই বোঝেন!

তিব্বত থেকে এসে খুম্বু ও পার্শ্ববর্তী সোলু অঞ্চলে বসতি করা মানুষদেরই শেরপা বলে। শেরপা মানে স্রেফ মালবাহক নয়। বোয়িং বিমানের পাইলট আং ঝাবু ছেলেবেলায় নামচেবাজারে থাকতেন। রোজ প্রায় তিন হাজার ফুট উঁচু খাড়াই পথ বেয়ে এডমন্ড হিলারির তৈরি খুমজুং স্কুলে পড়তে যেতেন। সেটিই ওই এলাকায় প্রথম স্কুল। অন্য সময় ট্রেকারদের মাল বওয়ার কাজ করতেন। বোয়িং সংস্থার এক অফিসার ট্রেকিংয়ে গিয়েছিলেন। পোর্টারের বুদ্ধিমত্তায় চমৎকৃত হয়ে তিনি আং ঝাবুর বাকি পড়াশোনার দায়িত্ব নেন।

শেরপাদের ভাষা আছে, লিপি নেই। কিন্তু অনেক উপকথা আছে। যেমন, একটা নীলরঙা হরিণকে তাড়া করতে করতে খুম্বু অঞ্চলে প্রথমে এসে পড়েন কিরা গোম্বু দোরজে নামে এক শিকারি। কৃষি নয়, শিকার ও ফলমূল আহরণ থেকেই শেরপা সভ্যতার শুরু। মধ্যযুগের নেপালি রাণারাও জায়গাটার কথা বিশেষ জানতেন না। নেপালি ইতিহাস বলছে, অষ্টাদশ শতকে হিন্দু রাণারা গোহত্যা নিবারণে আইন করেছিলেন। গরু মারলেই কারাগার বা মৃত্যু। সেই সময় এক রাজকর্মচারী এখানে আসেন। তাঁর মন্তব্য, ‘‘আইনটা ঠিকঠাক মেনে চললে এলাকাটা জনশূন্য হয়ে যাবে।’’ ইয়াকের মাংস ছাড়া ওই ঠান্ডায় ক্ষুন্নিবৃত্তি সম্ভব?

কিন্তু সংস্কৃতি অন্যত্র। বেস ক্যাম্পে এখনও শেরপারা পুজো দেন, প্রাণী হত্যা করেন না। বরং নীচে কোনও গ্রামে মোবাইলে খবর দিয়ে তাঁরা টিমের জন্য মাংস আনিয়ে নেন। শৃঙ্গের দিকে পা করে ঘুমোন না। এভারেস্ট তো মিয়োলাংসাংমা দেবীর বাসস্থান! দেবী সোনালি বাঘের পিঠে চড়ে ভক্তের মনোবাঞ্ছা পূরণ করেন। দার্জিলিঙে তেনজিংয়ের বাড়ির ঠাকুরঘরেও এই দেবীর ছবি, রোজ পুজো করতেন। সম্পন্ন শেরপাদের অনেকের বাড়িতেই নিজস্ব গোম্ফা। আর একটা গোম্ফা এলাকার সকলের জন্য, কোনও বড় লামার তৈরি। যেমন থিয়াংবোচে, প্যাংবোচে। মধ্যযুগে এই গুম্ফাগুলিতে যে শেরপা লামারা থাকতেন, তাঁরা অনেকেই বিবাহিত। এই বিবাহিত লামা-ই শেরপা ঐতিহ্য ছিল, পরে তিব্বতের প্রভাবে এখন সকলেই অবিবাহিত। বিবাহিত ও অবিবাহিতদের সম্মানের হেরফের ছিল না। কেউ লামা-জীবন ছেড়ে মাঝপথে সংসার করতেন, আবার উল্টোটাও হত। ছেলেমেয়েদের নাম রাখা হয় যে দিন তাদের জন্ম, সেই অনুসারে। যেমন পাসাং মানে শুক্রবার, পেম্বা মানে শনিবার। একটা অভিযাত্রী টিমে তাই পাসাং নামের দু’তিন জন থাকতেই পারেন।

সাংস্কৃতিক উদারতা এই জাতিটির জীবনাচরণে সর্বত্র। অমুক শেরপা ১৭ বার, আর অমুক ১৮ বার এভারেস্টে উঠছেন দেখে যে সব বাঙালির চোখ টাটাচ্ছে, তাঁরা জেনে রাখতে পারেন, এক বারে কেউ শৃঙ্গে ওঠে না। প্রথমে বেস ক্যাম্পে মাল বওয়া, রান্নাবান্না দিয়ে জীবন শুরু। তার পর ভাল ক্লাইম্বিং পারলে পরের শিবিরে মাল বওয়ার দায়িত্ব। এই ভাবে ধাপে ধাপে শৃঙ্গারোহী দলে অন্তর্ভুক্তি। অতঃপর নাম করতে পারলে, নিজের এজেন্সি খোলা। শর্টকাট নেই। কামি রিটা-র ২৫ বার এভারেস্ট ছোঁয়ার স্বপ্ন নিয়ে ‘এভারেস্ট আজকাল সহজ’ ভেবে বঙ্গীয় আত্মপ্রসাদ পেলে ভুল করবেন। ২০১৪-১৫ সালে পর পর দু’বার বেস ক্যাম্পে বড় ধস নামে। সব মিলিয়ে প্রায় ৩৫ জন মারা যান। কামি রিটা তখনও ক্লাইম্বিংয়ের অনুমতি লাভ করেননি, রান্নাঘরে থাকায় প্রাণে বেঁচে যান।

শেরপা জীবনে আর একটি বৈশিষ্ট্য আছে। প্রথম এভারেস্ট জয়ের পর সবাই কাঠমান্ডু ফিরছেন। রাস্তায় ‘তেনজিং জিন্দাবাদ’ স্লোগান। সকলের প্রশ্ন: আপনার তো সোলু-খুম্বতে জন্ম। নিজেকে ভারতীয় বলেন কেন? সে দিন দার্জিলিঙের বাসিন্দা তেনজিং-এর উত্তর, ‘‘নেপাল আমার জন্মদাত্রী আর ভারত পালয়িত্রী মা। তা হলে আজ হঠাৎ আমি নেপালি না ভারতীয় এই প্রশ্নটা কেন? রাজনীতি নিয়ে আমার কোনও আগ্রহ নেই।’’

শেরপা রক্তে তাই অ্যাডভেঞ্চার আছে, পাহাড়ি চড়াই ভাঙার ধর্ম আছে, জাতীয়তাবাদের বজ্জাতি নেই। ওঁদের তো বারংবার এভারেস্ট ছোঁয়ারই কথা!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন