কেন রাহুল গাঁধীকে বিরোধী নেতা হিসাবে গুরুত্ব-সহকারে লওয়া ছাড়া বিজেপির উপায় নাই, তাহার একটি কারণ, সম্প্রতি কালে তাঁহার টুইট-বার্তায় একের পর এক অতি প্রাসঙ্গিক সব প্রশ্ন ধ্বনিত হইতেছে। এই যেমন, সিবিআই কেন নীরব মোদী ও মেহুল চোক্সীর মতো ব্যবসায়ী-প্রবর বিজয় মাল্যকেও দেশ ছাড়িয়া পলায়নের সুযোগ করিয়া দিল। কিংবা কেনই-বা বিজয় মাল্য দেশ ছাড়িবার আগে অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলির সহিত দেখা করিলেন। সরকারের তরফে এই সব অভিযোগ ভিত্তিহীন বলিয়া উড়াইয়া দেওয়া হইতেছে। মুশকিল হইল, যত বেশি উড়াইবার প্রয়াস, ততই বেশি করিয়া ছাইয়ের তলায় মণিমুক্তাসম তথ্যের আবিষ্কারে বিরোধী দলগুলি সমৃদ্ধ হইতেছে। সিবিআই-এর তরফে রাহুলের টুইট-অভিযোগের লক্ষ্য এজেন্সির যুগ্ম-অধিকর্তা এ কে শর্মার উপর হইতে সন্দেহ মুছিয়া ফেলিবার যথেষ্ট চেষ্টা হইতেছে। ঘটনা হইল, যদি বা সিবিআই অধিকর্তা শর্মা রাহুল গাঁধীর অভিযোগমতো প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর ‘ব্লু-আইড বয়’ বা বিশেষ স্নেহপাত্র না-ই হন, তাহা সত্ত্বেও সিবিআই কেন বিজয় মাল্য বিষয়ক লুক-আউট নোটিসটি উপর্যুপরি লঘু করিতেছিল, তাহার কোনও ব্যাখ্যা জনসমক্ষে এখনও প্রকাশিত হয় নাই। কেন প্রথম বার নোটিসে তাঁহার দেশ ছাড়িবার উপর নিষেধাজ্ঞাটি পরবর্তী নোটিসে নেহাত তাঁহার গতিবিধি লক্ষ করিবার নির্দেশে পরিণত হইয়াছিল, তাহার যথেষ্ট যুক্তি সিবিআই মোটেই দিতে পারে নাই। একই ভাবে, বিজয় মাল্যের ‘মুখ-ফসকানো’ দাবি যে, দেশ ছাড়িবার আগে তিনি অর্থমন্ত্রীর সহিত দেখা করিয়াছিলেন— অর্থমন্ত্রী জেটলি যতই তাহা প্রাণপণ অস্বীকার করুন, তাঁহার ও বিজয় মাল্যের কথার ফাঁকে ফোকরে অজস্র অসঙ্গতি ইঙ্গিত দেয় যে দুই জনে দেখা করিবার মধু-মুহূর্তটির বিষয়ে অনেক তথ্যই এখনও অজ্ঞাত। সংসদে সেই দেখা হইয়াছিল কি না, সরাসরি এই প্রশ্নের উত্তরটিও অর্থমন্ত্রী দেন নাই। হিসাবি বাক্য ব্যবহারে তিনি বরাবর দক্ষ। বাস্তবিক, কেহ বলিতে পারে, ঘটনা যে কত দূর প্যাঁচালো, পেশায় আইনজীবী ও রাজনীতি অঙ্গনে বিচক্ষণ অরুণ জেটলির অস্পষ্ট প্রতিক্রিয়াই তাহার প্রমাণ।
যে ব্যাঙ্কসমূহের কাছে বিজয় মাল্য নয় হাজার কোটিরও বেশি ঋণ ফিরাইয়া দিতে বাধ্য, সিবিআই সেই ব্যাঙ্কের কর্তাদের বিরুদ্ধে চার্জশিট আনিতে চলিয়াছে বলিয়া শোনা যায়। তবে কিনা, ব্যাঙ্কের দিক হইতে অনাদায়-কৃত ব্যবসায়িক ঋণের কথা ভাবিলে, পরিমাণে ইহার অপেক্ষা বৃহত্তর দুর্নীতির দৃষ্টান্ত এ দেশে অনেক আছে। সুতরাং মূল প্রশ্ন সেখানে নয়। মূল প্রশ্ন হইল, কেন এতগুলি ব্যাঙ্ক মাল্যের বিরুদ্ধে ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারি অবধি কোনও ভাবে নড়িয়া বসে নাই, কেনই-বা নড়িয়া বসিবার পরও এত ধীর গতিতে তাহারা পদক্ষেপ করিয়াছে, কেন বিজয় মাল্য দেশ ছাড়িবার আগে ব্যাঙ্কগুলি সর্বোচ্চ আদালতের কাছে তাঁহার বিরুদ্ধে অভিযোগ লইয়া উপস্থিত হয় নাই। এই সব কূট প্রশ্নের উত্তর কোথায় পাওয়া যাইবে, এখনও অজানা। বিরোধীদের চুপ করাইবার জন্য তাই প্রয়োজন, বিজয় মাল্যকে ফিরাইয়া আনা। তেমন কিছু প্রচেষ্টাও নাকি চলিতেছে। তবে, আঁচাইবার আগে অধিক আশাময় না হওয়াই ভাল, এখনও তো অ-প্রত্যাগত নীরব মোদীদের দৃষ্টান্ত হাতের কাছে আছেই। সত্য বলিতে, বিজয় মাল্যকে ফিরাইয়া আনিলেও তাঁহার দেশ ছাড়িবার ঘটনা সংক্রান্ত প্রশ্নগুলি হাওয়ায় উবিয়া যাইবে না। রাজনীতি, অর্থনীতি ও পলায়ননীতির পারস্পরিক সম্পর্কের রহস্য যত ক্ষণ পর্যন্ত না উদ্ঘাটিত হইতেছে, নরেন্দ্র মোদী সরকারের কার্যবিধির বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগগুলি থাকিয়া যাইবে। সিদ্ধান্ত করিবার অবকাশ থাকিবে যে বৃহদাকার ব্যবসায়িক দুর্নীতি দিল্লির ক্ষমতামঞ্চে আসন পাতিয়া বসিয়াছে, তাহাকে টানিয়া নামানো মুশকিল।