Economy

সব কিছু কি আগের মতো হবে

এত দিন জাতীয় আয় বৃদ্ধির হার নিয়ে তোলপাড় হচ্ছিল জগৎ, এখন জাতীয় আয়ের পরিমাণই ২৫-৩০ শতাংশ কমে গিয়েছে।

Advertisement

সুগত মারজিৎ

শেষ আপডেট: ১৫ অক্টোবর ২০২০ ০০:৪৩
Share:

কোভিডের কার্যকর প্রতিষেধক মানুষের কাছে পৌঁছনোর পর, যখন অর্থনীতির অবস্থা স্বাভাবিক হতে থাকবে, তখন কি সব আগের মতোই হবে? বিশ্ব-অর্থনীতি, শিল্প, আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের চেহারা, নতুন প্রযুক্তির গবেষণা, পড়াশোনা, চাকরি— সব কিছুর মধ্যে কোনও আমূল পরিবর্তন আসবে কি?

Advertisement

সারা বিশ্বের মতোই এখন আমাদের দেশেও ‘অনলাইন’-এর রমরমা। কী পড়াশোনার জগৎ, কী চাকরিবাকরির জগৎ, যেখানেই এটা করা সম্ভব, সেখানেই এই প্রক্রিয়া চালু হয়েছে। আর এটাই স্বাভাবিক। স্কুলে আগে ৫০ জনের তিনটে ক্লাস পড়াতে তিন জন শিক্ষকের বা শিক্ষিকার প্রয়োজন হত, এখন এক জনের হয়। বাকি দু’জন যদি ঠিকা বা ক্যাজুয়াল কর্মী হয়ে থাকেন, তাঁদের ছাঁটাই করে দেওয়া হচ্ছে। শুধু হ্যান্ড স্যানিটাইজ়ারের ব্যবসায় নয়, এই ব্যবসাতেও মুনাফা বেড়েছে।

এ দেশের গ্রামেগঞ্জে এবং সম্পদ ও আয়ের হিসেবে নিম্নতর এবং নিম্নতম শ্রেণির ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের ঘরে ঘরে ল্যাপটপ না থাকলে কিংবা ইন্টারনেট যোগাযোগ অতি দ্রুত এবং সুস্থির না হলে পড়াশোনায় অনলাইন ব্যবস্থা নিঃসন্দেহে বৈষম্যকে আরও প্রকট করবে। শুধু এ দেশে নয়, গোটা বিশ্বের উন্নয়নশীল স্বল্পবিত্ত দেশগুলোতে এই সমস্যা এড়ানো শক্ত। তা ছাড়া অনলাইন ব্যবস্থায় ছেলেমেয়েদের সঙ্গে সরাসরি মুখোমুখি কথোপকথন অত সহজ নয়। প্রাথমিক স্তরে এই অমানবিক যান্ত্রিক শিক্ষা মোটেই বাঞ্ছিত নয়। আর এই ব্যবস্থা অল্পশিক্ষিত বাপ-মায়ের সন্তানদের আরও পিছিয়ে দেবে বলে আমার ধারণা।

Advertisement

পরিষেবা ক্ষেত্রে যাঁরা তথ্যপ্রযুক্তি নিয়ে কাজ করেন, তাঁদের অনেকেই বাড়ি থেকে কাজ করছেন। কিন্তু অফিসে থাকলে দশ ঘণ্টা কাজ করতে হত, এখন দিন নেই রাত নেই কাজ করছেন। আবার অনেক সরকারি অফিসে, ব্যাঙ্কে পুরোদমে কাজ হচ্ছে। অন্তত, যথাসাধ্য করছে প্রতিষ্ঠানগুলো। কিন্তু বহু কারখানা খুলছে না, ছোটখাটো অসংগঠিত ব্যবসায় মন্দা। যেমন, রাস্তার ধারে ভাতের হোটেল। বা রিকশায় চাপা মানুষের সংখ্যায় ভয়াবহ মন্দা। মানুষ বেশি পথে নামছেন না। সিরিয়ালে বিভিন্ন ছোট-বড় কাজ করতেন, এমন বহু মানুষ, গাইয়ে-বাজিয়ে, সিনেমা, থিয়েটারের কর্মীরা এক ভয়াবহ অবস্থার মধ্যে আছেন। অর্থাৎ, যেখানেই ব্যবসার জন্য মানুষের জমায়েত হওয়া প্রয়োজন, সেখানেই অন্ধকার। করোনা চলে যাওয়ার পরও বেশ কিছু দিন এ অবস্থাই চালু থাকবে। মানুষ যত দিন এক জায়গায় একত্র হতে ভয় পাবেন, তত দিন।

ইউরোপ এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কয়েকটি সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, যে শিল্পগুলোতে অনেকে পাশাপাশি একত্রে কাজ করেন, সে সব শিল্প ভয়াবহ দুরবস্থার প্রকোপে পড়েছে এবং জাতীয় আয়কে অনেকটা টেনে নামিয়েছে। এই সব সম্পর্ক বা স্পর্শ নিবিড় বা কনট্যাক্ট ইনটেনসিভ ক্ষেত্রগুলো কার্যকর টিকা না বেরোলে কোনও দিনই ভাল ভাবে মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারবে না। করোনা জাতীয় ভাইরাসের প্রকোপের অর্থ, এ সব ক্ষেত্রের প্রযুক্তিগত অল্পতার প্রকাশ। কারণ প্রযুক্তি শুধু যান্ত্রিক প্রসঙ্গ নয়, মানুষে মানুষে দৈহিক ও প্রত্যাশী কথোপকথনের প্রশ্নও বটে।

নতুন প্রযুক্তি মানেই শ্রমিককে অবান্তর করে দেওয়ার প্রস্তাব— এই ব্যাপারটা অনেক দিনই চালু হয়ে গিয়েছে। মানুষ কায়িক পরিশ্রম না করে যন্ত্রের সাহায্যে গোঁফে তা দিতে দিতে সব করে ফেলবে এবং গোঁফ গজানোর আগেই পাহাড়প্রমাণ সম্পদের মালিক হবে, এটাই এখন নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবনের পিছনে মূল মঞ্চ। নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ রবার্ট লুকাস (জুনিয়র) লিখেছিলেন: বিদ্যুতের আবিষ্কার শিক্ষিত-অশিক্ষিত সব শ্রেণির মানুষকে খানিকটা সমান ভাবে সুবিধে দিয়েছে— শুধু সুইচ টেপার অপেক্ষা। এখন ল্যাপটপ না থাকলে মানুষ পিছিয়ে পড়বে। আর কর্মীর প্রয়োজন কমানোই সভ্যতার এবং মানুষের অহমিকা। তাই বড় সিমেন্ট কারখানায় এ দেশেও ১০ জনের কমে কাজ হয়ে যায়।

এত দিন জাতীয় আয় বৃদ্ধির হার নিয়ে তোলপাড় হচ্ছিল জগৎ, এখন জাতীয় আয়ের পরিমাণই ২৫-৩০ শতাংশ কমে গিয়েছে। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে উদারনীতির আকাল শুরু হয়েছে কোভিড বিপর্যয়ের অনেক আগে থেকেই। বাণিজ্য এবং বহির্বিনিয়োগের ওপর বাড়তি নিয়ন্ত্রণ চাপানোর সময় সব দেশেই ফাটা রেকর্ডের মতো দেশের বেকার সমস্যার ভয়াবহ অবস্থার কথা শোনা যায়। কোভিড-পরবর্তী সময়ে বৈদেশিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে সংরক্ষণশীল মনোভাব আরও প্রকট হবে। সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, সুদ তলানিতে ঠেকলেও বিনিয়োগ বাড়ে না। দাম তলানিতে ঠেকলেও চাহিদা বাড়ে না, যদি না এক লপ্তে অনেকটা খরচ সরকার করে— মন্দার অর্থনীতির এই দাওয়াই এ দেশে কী ভাবে কাজ করবে, তার চেহারাটা ঠিক কেমন হবে, সে সবও তো বুঝতে হবে।

ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব ফরেন ট্রেড, কলকাতা

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন