পাঁচিল টপকে মাঠে ঢুকতে হলেও ওরা খেলবে

মেয়েরা ফুটবল খেলতে চায়, চায় একটু সুযোগ আর উৎসাহ

মুর্শিদাবাদের জেলা ইয়ুথ অফিসার জানালেন, খেলার জন্য যে সব স্কুলকে টাকা দেওয়া হয় তার ক’টা মেয়েদের স্কুল, সে হিসেব রাখা হয় না। আর ক্লাবগুলো টাকা নিয়ে কী করে, তিনি জানেন না। তাঁর এক সহকর্মী জনান্তিকে জানালেন, সরকারি অনুদানের অল্প টাকাই খেলায় খরচ হয়, অধিকাংশ যায় মাল্টিজিম আর টুর্নামেন্টের খরচে। মেয়েদের ড্রেসিং রুম? হয়নি। বহরমপুরের একমাত্র স্টেডিয়ামটিতে একটিই বাথরুম। মেয়েরা খোলা পাবে কি না, সেটা ‘ক্ষমতার ব্যাপার’।

Advertisement

স্বাতী ভট্টাচার্য

শেষ আপডেট: ১৪ জুলাই ২০১৮ ০১:১৮
Share:

লড়াই: অনেক বাধা পেরিয়ে খেলা চালিয়ে যাচ্ছে মেয়েরা। ২০১৩ সালে বীরভূম জেলার দুবরাজপুরে একটি স্টেডিয়ামের উদ্বোধন

ওড়নায় মাথা ঢেকে এসেছিল ইস্কুলে। মিড ডে মিল শেষ করেই সেই মেয়েরা তৈরি লাল জামা-কালো হাফপ্যান্ট পরে। মাঠে যাবে প্র্যাকটিস করতে।

Advertisement

এই দুপুর রোদে? বেলা আড়াইটেয়?

‘‘নইলে মাঠ পাবে না এই মেয়েরা।’’সঙ্গে গেলে প্র্যাকটিস দেখা যাবে?

Advertisement

‘‘পাঁচিল টপকাতে হবে কিন্তু। ওরা মেয়েদের জন্য গেট খোলে না।’’

সে কী? কেন?

‘‘ওরা বলে, মেয়েদের হাফপ্যান্ট পরে খেলতে দেখলে ছেলেরা খারাপ হয়ে যাবে।’’

হাসতে গিয়ে ব্রেক কষতে হল। যিনি বলছেন, তিনি একে অঙ্কের দিদিমণি, তায় ইস্কুলের বড়দিমণি। দেবকুন্ড এসআরকে গার্লস হাই মাদ্রাসার মুর্শিদা বেগমকে বেলডাঙার লোক সমঝে চলে। মুর্শিদাবাদের বাইরেও শিক্ষকেরা তাঁকে চেনেন। মুর্শিদা মাদ্রাসার মেয়েদের জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপে পাঠিয়েছেন। ভলিবল, স্প্রিন্ট, কবাডি, সাইকেল চালানোয় তাঁর ছাত্রীরা জাতীয় ক্যাম্পে জায়গা পায়। কিন্তু বেলডাঙার তিনটে বড় মাঠে ঢুকতে পায় না। ‘‘আমি বলে দিয়েছি, পাঁচিল টপকে ঢুকবি। তার পর দেখব’’, বললেন মুর্শিদা।

মেয়েরা মাঠ পায় না, মানলেন বেলডাঙা পুরসভার চেয়ারম্যান, ভরতকুমার ঝাওয়ার। কিন্তু তিনি অসহায়। ‘‘পুরসভার নিজস্ব মাঠ নেই। কী করব?’’ গোটা মুর্শিদাবাদেরই ছবি এটা। জেলা স্পোর্টস কাউন্সিলের এক কর্তা বললেন, ‘‘মেয়েদের খেলার মতো মাঠ নেই বললেই চলে।’’

আচ্ছা, ক্লাবগুলো যে সরকারি অনুদান পায়, তার থেকেও কি পাড়ার মেয়েরা, স্কুলের মেয়েরা কিছুই পায় না?

কিচ্ছুটি না। না বল, না জার্সি, না বুট, না একটা রেসিং সাইকেল, কিছুই পায়নি সাদিয়া, সুরাইয়া, হাসিনা, সাহিনারা। বাবা-মা দেবে, সে আশা নেই। হাফপ্যান্ট পরে খেলার জন্য মারধর খেতে হয় বাড়িতে। অন্তত দু’টি মেয়ে জাতীয় স্তরে কোচিংয়ের জন্য নির্বাচিত হয়েও যেতে পারেনি— বাড়ির বাইরে রাত কাটানো নিষেধ। ওদের যা দরকার, দিদিমণিরাই চাঁদা তুলে কিনে দেন, যতটা পারেন। বুটের অভাবে একটি মেয়ে সাইক্লিং ইভেন্ট থেকে বাদ পড়েছিল গত বছর।

কেন মেয়েদের কিছু জোটে না? বেলডাঙার এক ক্লাবের ম্যানেজিং কমিটির এক সদস্য বললেন, ‘‘ছেলেদের চাহিদাই মেটাতে পারি না। মেয়েদের যা দেওয়ার সরকারি আধিকারিকরা দিক।’’

মুর্শিদাবাদের জেলা ইয়ুথ অফিসার জানালেন, খেলার জন্য যে সব স্কুলকে টাকা দেওয়া হয় তার ক’টা মেয়েদের স্কুল, সে হিসেব রাখা হয় না। আর ক্লাবগুলো টাকা নিয়ে কী করে, তিনি জানেন না। তাঁর এক সহকর্মী জনান্তিকে জানালেন, সরকারি অনুদানের অল্প টাকাই খেলায় খরচ হয়, অধিকাংশ যায় মাল্টিজিম আর টুর্নামেন্টের খরচে। মেয়েদের ড্রেসিং রুম? হয়নি। বহরমপুরের একমাত্র স্টেডিয়ামটিতে একটিই বাথরুম। মেয়েরা খোলা পাবে কি না, সেটা ‘ক্ষমতার ব্যাপার’।

শুধু মুর্শিদাবাদ? ইন্ডিয়ান ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনের মহিলা কমিটির সদস্য সুদেষ্ণা মুখোপাধ্যায় নিজে মেয়েদের একটি ফুটবল ক্লাব চালান। জানালেন, কলকাতা লিগ-এ ছেলেদের টিমগুলো খেলে কলকাতায়। মেয়েদের খেলা হয় ব্যারাকপুর, বাঁশবেড়িয়া, চন্দননগরে। ড্রেসিং রুম, বাথরুমের সমস্যা সর্বত্র।

হিঙ্গলগঞ্জে স্কুলের মাঠ ডুবে থাকে তিন-চার মাস। মেয়েরা তখন খেলে পিচের রাস্তায়। কনকনগর এসডি ইনস্টিটিউশনের ছাত্রীরা অধিকাংশই দলিত-আদিবাসী। গত তিন বছরে সরকারি প্রাপ্তি পাঁচটি ফুটবল। ক্লাবগুলো মেয়েদের সুন্দরবন কাপে খেলায়, কিন্তু টুর্নামেন্টের সরকারি জার্সি ছাড়া কিছুই দেয় না। স্কুলের মেয়েরা যখন বারাসতে জেলা স্পোর্টস কাউন্সিলের কোচিংয়ে আসে, থাকার জায়গা মেলে না। প্রধান শিক্ষক পুলক রায়চৌধুরী বললেন, ‘‘সরকারি কর্তারা বলেন, কোনও অ্যারেঞ্জমেন্ট তো নেই। আপনাদের বাড়িতেই রাখুন।’’ তা-ই রাখেন তাঁরা। কিন্তু যত মেয়ে আসতে চায়, তার ক’জন আসতে পারে?

ক’জনই বা চায়, মেয়েরা খেলাধুলো করুক? ছেলেদের মতোই?

‘কন্যাশ্রী’-র বিজ্ঞাপন মোড়ে মোড়ে। কিন্তু সর্ববৃহৎ প্রকল্পটি চলে ঘরে ঘরে। কৈশোরে না-পড়তেই ঝুঁটি-বিনুনিদের ঘরবন্দি করে ‘মেয়ে’ করে তোলার প্রকল্প। যৌথ উদ্যোগ সমাজ এবং সরকারের। পাবলিক স্পেস, আর পাবলিকের টাকা, এই দুটোতেই মেয়েরা যত কম ভাগ বসায়, তত সুবিধে। মেয়েদের জায়গা ঘরে, বড়জোর ক্লাসঘরে।

মেয়েগুলো বোঝে না। কলকাতার ছাব্বিশ নম্বর ওয়ার্ডে কিশোরীদের সঙ্গে কাজ করতে গিয়েছিল এক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা। মেয়েদের রাগ, কেন খেলা বন্ধ করেছে বাপ-মা? অগত্যা স্থানীয় কাউন্সিলরকে ধরে ব্যবস্থা করেছে রবীন্দ্রকাননে। মাস পাঁচেক হল, এক দিকে খেলে ছেলেরা, এক দিকে মেয়েরা।

এই ‘সমান সমান’ ভাব, ভয় না পেয়ে লড়ে যাওয়া, টিম স্পিরিট, হারিয়ে দেওয়ার উল্লাস, এ সব কি মেয়েদের মানায়? মুখে যে যা-ই বলুক, মনে মনে বেশি ভোট একটাই বাক্সে— ‘না’।

তাই গত ছয় বছরে ক্লাবগুলোকে যত টাকা দিয়েছে তৃণমূল সরকার, তার এক শতাংশও বোধ হয় জোটেনি মেয়েদের। ছ’শো কোটি টাকার দশ শতাংশ পেলেও মেয়েদের কোচ জুটত, বুট-নেট পেত। ‘রূপশ্রী’ না হয়ে কেউ কেউ হত দীপা কর্মকার, ঝুলন গোস্বামী। নিদেনপক্ষে ছুটোছুটির মজাটা তো পেত। পেত মাঠের মুক্তি। স্বাস্থ্যের দীপ্তি।

হল না। এ বছর ওড়িশায় চলছে জাতীয় স্তরের অনূর্ধ্ব চৌদ্দ মেয়েদের ফুটবল লিগ। পশ্চিমবঙ্গ টিম পাঠাতে পারেনি।

কেন খেলতে চাস রে তোরা? কেউ যখন চায় না তোরা খেলিস?

‘‘ম্যাম, আমরা দেখাতে চাই, খেলা করেও জীবনে বড় হওয়া যায়।’’ দুপুর আড়াইটের রোদে ভরা মাঠের মতোই মুখগুলো সাদিয়া, হাসিনাদের। ‘কিন্তু-যদি-অথবা-অগত্যা’ কিছুই ছায়া ফেলেনি। একটা পাঁচিলও কোথাও নেই, যে টপকে পালাতে পারে বড়রা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন