আপনারা প্রদীপ বক্সির নাম শুনেছেন?
প্রায় দু’দশক আগে একটা বই আলোড়ন তুলেছিল বিদ্বৎসমাজে| বইটি হল মার্কসবাদ গণিত ও তর্কশাস্ত্র| কার্ল মার্কস গণিত নিয়ে কিছু লিখে যান| সেই পাণ্ডুলিপির ভিত্তিতে গবেষণা করেন প্রদীপ বক্সি| তখন তিনি ৩৮ বছর বয়সের এক বিরল প্রজ্ঞাবান যুবক|
কিছু দিন আগে কলকাতায় যাদবপুর কফি হাউসে প্রবীণ মার্কস গবেষক সাংবাদিক শঙ্কর রায় আমাকে প্রদীপ বক্সির কথা জানান| কিছু দিন আগে প্রদীপবাবুর একটি সাক্ষাৎকার নেন শঙ্করবাবু। জনস্বার্থ বার্তা-র ২০১৪ সালের সংখ্যায় এটি প্রকাশিত হয়|
শঙ্করবাবুর নেওয়া এই সাক্ষাৎকার থেকে আমি মার্কস এবং মার্কসবাদ সম্পর্কে বেশ কিছু নতুন ভাবনার খোরাক পেলাম। প্রথমত, প্রদীপ বক্সি বলছেন, মার্কসের নিজস্ব কোনও রাজনৈতিক অর্থদর্শন নেই| তবে তাঁর সমগ্র রচনাবলিতে রাজনৈতিক অর্থশাস্ত্র, গণিত, দৰ্শন প্রভৃতি বিদ্যা থেকে নেওয়া নানা মতামত প্রকাশিত হয়েছে| ফলে লেনিনবাদ, মাওবাদ, স্তালিনবাদ, ট্রটস্কিবাদ— এ রকম নানা সাম্প্রদায়িক সংস্করণ আসলে নানা ধরনের ভ্রান্ত চৈতন্য!
অতএব, মার্কসের ভাবনা আর মার্কসীয় চিন্তা বা মার্কসবাদ এক নয়!
দ্বিতীয়ত, সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন এবং চিনের পুঁজিবাদের পথে যাওয়া মার্কসবাদের অচলতা প্রমাণ করছে কী করে? বরং উদার পুঁজিবাদের তত্ত্ব যত মার খাচ্ছে গোটা পৃথিবী জুড়ে ততই প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছেন কার্ল মার্কস!
মার্কসবাদের বিচ্যুতি কী ভাবে, কবে শুরু হল, সে-ও এক বড় প্রশ্ন| লেনিনবাদ আর মাওবাদকে মার্কসবাদ বলে ভাবা বিকার। কিন্তু ম্যাক্লেলান-এর মতো মার্কস গবেষক মনে করেন, মার্কসের ‘ভালগারাইজেশন’-এর শুরু এঙ্গেলস থেকেই|
মার্কস হেগেল-কে উল্টে বললেন, বস্তুবাদী দ্বন্দ্বতত্ত্ব| প্লেকানভ সেটা উল্টে বললেন, দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ| ইতিহাসের বস্তুবাদী ব্যাখ্যা বলেছিলেন মার্কস। এঙ্গেলস তাকে করলেন ঐতিহাসিক বস্তুবাদ!
প্রদীপবাবু বলছেন, মার্কসীয় বিপ্লব? এই ব্যাপারটা কী, আমি জানি না। প্রাকৃতিক সামাজিক বিবর্তন ও বিপ্লব তো এক জৈবিক প্রক্রিয়া। ডারউইন থেকে হার্বার্ট স্পেন্সারের সোশ্যাল ডারউইনিজম। মরগ্যান থেকে এঙ্গেলস। আদিম সাম্যবাদী সমাজ থেকে দাসপ্রথা, সামন্তবাদ, পুঁজিবাদ— প্রতি ক্ষেত্রে বিদ্রোহ বিপ্লব যা হয়েছে তার মধ্যে কোনও মতাদর্শ ছিল না। মার্কস ফরাসি বিপ্লব-প্যারি কমিউনের বিদ্রোহ, সব ঘটনার ব্যাখ্যা করেছেন। কিন্তু পুঁজিবাদে এসে একটা রাজনৈতিক দল গঠন এবং রক্তক্ষয়ী বিপ্লবের পরামর্শ কি মার্কস দিয়েছিলেন?
রুশ বিপ্লব। ছবি : থটকো
আমার মনে হয়, কমিউনিস্ট পার্টি গঠনের সুনির্দিষ্ট কোনও নীল নকশা মার্কস দিয়ে যাননি বটে, কিন্তু কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো-তে প্রলেতারিয়ানদের নিয়ে একটি রাজনৈতিক দল গঠনের কথা মার্কস বলেন। কিন্তু তিনি হিংসার পক্ষে কোনও কথা বলেননি।
এখন তো মনে হয়, লেনিনের বলশেভিক দলের মতবাদের সঙ্গে রোজা লুক্সেমবার্গের মেনশেভিক মতপার্থক্য গভীর ভাবে অধ্যয়ন করা দরকার। সেনা সাহায্য নিয়ে তাড়াহুড়ো করে জার সম্রাটদের হত্যা করে বলশেভিক বিপ্লবটা ঠিক মার্কসবাদ ছিল কি না জানা দরকার! শোভন দত্তগুপ্তর সাম্প্রতিক বই থেকে রোজা-র ধীরে চলার নীতিটা বোঝা যায়! মনে হয়, রোজা-র ভাবনাও বোঝা দরকার!
যেমন ইউরোকমিউনিজম আর তগলিয়াট্টির?
ইতালিতে ইউরোকমিউনিজম নিয়ে যখন আলোচনা শুরু হয় তখন সোভিয়েত কমিউনিস্টরা তাতে খুব অসন্তুষ্ট হন। ইউরোকমিউনিস্টদের স্তালিন সংশোধনবাদী বলেন। আবার ক্রুশ্চেভ যে পথে হাঁটতে চান সেটাকেও বলা হল সংশোধনবাদী বিচ্যুতি। কিন্তু আজ এত বছর পর ভারতীয় কমিউনিস্টদের সংসদীয় পথে হাঁটা দেখে মনে হচ্ছে না, এ পথ আর সে পথে তফাৎ কী?
মার্কস তাঁর জামাতা পল রাফার-কে বলেছিলেন, আমি মার্কসবাদী নই। সত্যি কথা, মার্কস আসলে কোনও মতবাদ দিতে চেয়েছিলেন কি না সেটাই বিতর্কের বিষয়!
আমরা মার্কসের সেবাদাস হব কেন? তার বদলে খোলা মনে তাঁর চিন্তাকে নতুন করে খোঁজার চেষ্টা করি!