বাধ্যতামূলক: আধার কার্ড নামক সুবিশাল ডিজিটাল জালের সামনে আবেদনকারীদের উদ্বিগ্ন ভিড়, কলকাতা
বলতেই পারি, ডিজিটাল উদ্ভাবনের যুগে পৃথিবীতে দুটি সফল কৃতিত্বের অধিকারী আমাদের ভারত। প্রথম কৃতিত্ব, ‘শূন্য’ আবিষ্কার। দ্বিতীয় কৃতিত্ব, ‘আধার’ আবিষ্কার। আচ্ছা, ঠিক আছে, মেনে নিলাম, প্রথমটায় না-হয় একটু চোট্টামি আছে। ওটা ডিজিটাল যুগের অনেক আগেই ঘটেছে, কিন্তু এ সব ছোটখাটো ডিটেল নিয়ে মাথা ঘামিয়ে লাভ কী! আসলে, যেটা বলতে চাইছি তা হল, আধার এক কালজয়ী
আই টি প্রকল্প। একটা কালজয়ী সমাজতাত্ত্বিক দর্শন আছে এর পিছনে। দর্শনটা আর কিছু নয়, সামষ্টিক ভিত্তিতে সমাজ নির্মাণ। এই ডিজিটাল যুগে কোটি কোটি মানুষের জন্য একটা আস্থার মঞ্চ তৈরি করতে চায় আধার, যে মঞ্চের মধ্যে জাতপাতের ভেদ নেই, ফেসবুক স্টেটাসের প্রশ্ন নেই, মতামতের ভিন্নতা বিভিন্নতা নেই। দুর্ভাগ্য, এ সবের আর একটা মানেও আছে। এর মানে, আধারের মধ্যে থাকবে ব্যক্তিগত তথ্যের একটা বিরাট সম্ভার, আর সঙ্গে সঙ্গে, সেই তথ্য নিয়ে কারচুপি করার সুযোগ। সাম্প্রতিক ঘটনাবলিই প্রমাণ, কারচুপি ইতিমধ্যেই ঘটিত বা সংঘটিত।
আধার নিয়ে এই সংশয়ের মধ্যে একটা বড় গল্প আছে। রাজনীতি আর রাজনীতির দুর্নীতির থেকেও বড় গল্প। গল্পটা নতুন নয়— একটা ব্যবস্থা চালু হতে না হতেই তার মধ্যে নিরাপত্তার অভাব ঘটে যাওয়া। রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়ার ২০১৭ সালের অক্টোবরে তৈরি একটি গবেষণাপত্র বলছে, আধার এমন একটা একক প্রকল্প, সাইবার ক্রিমিনালরা যা দিয়ে এক ধাক্কায় সমস্ত তথ্য পেয়ে যেতে পারে। ২০১৮ সালে বোঝা গেল, সত্যিই, আমরা এমন একটা টার্নিং পয়েন্ট-এ এসে পৌঁছেছি, যেখানে আমাদের এখনই জরুরি ভিত্তিতে একটা সীমারেখা টানতে হবে, এক দিকে ডিজিটাল নির্ভরতা, অন্য দিকে ডিজিটাল সংকট। এই গ্রহে মানুষের সংখ্যার থেকে মোবাইল ফোন নম্বরের সংখ্যা খুব একটা কম নয়। তার মধ্যে অর্ধেক অনলাইন থাকেন। কুড়ি কোটি মানুষ মাসে এক বার ফেসবুক চেক করেন। পঁয়ত্রিশ কোটি মানুষ প্রতি দিন এক বার গুগল সার্চ করেন। এহেন ডিজিটাল পৃথিবীতে আমাদের নিরাপত্তা, ব্যক্তিগত পরিসর, আস্থার পরিসর, এই সবের জায়গা কোথায়। সবই দ্রুত পালটে যাচ্ছে।
আধারের ভাবনা যাঁদের মাথায় এসেছিল, তাঁরা সময়ের সঙ্গে তাল রাখতেই চেয়েছিলেন। ভেবেছিলেন, ডিজিটাল উদ্ভাবনের পরবর্তী পর্বটি এমন হবে যেখানে উপভোক্তাদের ডিজিটাল জালের উপর আস্থাও থাকবে, সুযোগসুবিধাও থাকবে। ঠিক ভাবে করা গেলে, এই উদ্ভাবন নিশ্চয়ই ভারতের প্রযুক্তি-আবিষ্কারের অতি-সংক্ষিপ্ত তালিকাটির পরবর্তী নাম হয়ে দেশের মুখ উজ্জ্বল করত।
কিন্তু আধারের অভিভাবকরা নিশ্চয়ই টের পাচ্ছেন, ২০১৮ সাল তাঁদের প্রত্যাশিত পথরেখাটিকে ঘুরিয়ে দিয়েছে, ব্যক্তিগত তথ্যসংগ্রহের বিশাল ভাণ্ডারটিকে কুব্যবহার বা অপব্যবহারের সম্ভাবনা বাড়ছে। ফেসবুকের মার্ক জুকেরবার্গ বলেছেন, ২০১৮ সাল হল সেই সময় যখন তাঁরা নিজেদের ‘নানা সমস্যার সমাধান করতে চলেছেন।’ ভোটের সঙ্গে রাশিয়ার নাম জড়িয়ে যাওয়ায় ফেসবুকের সংকট বেড়েছে, ফেক নিউজ-এর বন্যা আটকানোটা জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফেক নিউজের ব্যাপারে সিলিকন ভ্যালির অন্য প্রতিবেশী গুগলও নতুন বছরে নানা ওয়েবসাইট ব্লক করতে শুরু করেছে, বিশেষত যে সব সাইট কোন দেশ থেকে কাজ করছে সেটা গোপন রাখা হয়। মাইক্রোসফট-এর মতো পুরনো অপারেটিং সিস্টেমও নাকি এই বছরে একটা বড় মাপের নিরাপত্তা বর্ধন প্রকল্প হাতে নিয়েছে।
২০১৮ সাল বিশ্বব্যাপী আমলাদের জন্যও পরিবর্তনের বছর: আধারের অভিভাবকরা কথাটা মাথায় রাখতে পারেন। ২০১৮ সালের মে মাসে শুরু হতে চলেছে ইউরোপীয় ইউনিয়নের জেনারেল ডেটা প্রোটেকশন রেগুলেশন বা জিডিপিআর। যে সব প্রতিষ্ঠান ই-ইউ বাসিন্দাদের ব্যক্তিগত তথ্যসংরক্ষণের কাজ করে, তাদের অবস্থান যেখানেই হোক না কেন, সবগুলির উপরেই এই নতুন রেগুলেশন বা নীতি প্রযুক্ত হবে। ইউরোপের এই অভিজ্ঞতা যে অন্যত্রও তথ্য সংরক্ষণ ব্যবস্থাকে নানা ভাবে প্রভাবিত করবে, এখনই তা বলা যায়।
দেখে-শুনে আধার-কর্তারা বলতেই পারেন যে নতুন বছরের এত শত প্রতিজ্ঞা ও প্রতিশ্রুতি কেবল মার্কিন কোম্পানি এবং ইউরোপীয় রেগুলেশন সংস্থাগুলির জন্যই সুখবর— হাজার হোক, ‘ফার্স্ট ওয়ার্ল্ড’-এর প্রাইভেসি বা ব্যক্তিগত পরিসরের ধারণা, নিরাপত্তার দুর্ভাবনা, বিশ্বাসযোগ্যতার মাপকাঠি, এ সব তো ঠিক বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশগুলির সঙ্গে তুলনীয় হতে পারে না! তাঁরা বলতেই পারেন যে, এক জন নির্বোধ, মূর্খ ব্যক্তিকে প্রেসিডেন্ট করতে গিয়ে ইকুইফ্যাক্স, উবর, ইয়াহুর এতগুলো বিশালাকার তথ্য-ফাঁস কেলেঙ্কারির পাকেচক্রে পড়ে মার্কিন নাগরিকরা মহাসংকটাপন্ন হয়েছেন বলেই এত কাণ্ড। তাঁরা বলতেই পারেন যে, ইউরোপের এত দিনের বিপুল আত্মসন্তুষ্টি এবং তার ফল হিসেবে তথ্য-নিয়ন্ত্রণ বিষয়ক বিপুল উদ্বেগ— তার জন্যই তাদের আজ এই অবস্থা।
আধার-কর্তারা এ-ও মনে করিয়ে দেবেন যে উন্নত দেশগুলির জীবনযাপনই আলাদা। সেখানে মানুষের মোবাইল ফোন চাই, ব্যাংক অ্যাকাউন্ট চাই, ইনশিয়োরেন্স পলিসি চাই, শপিংয়ের সুযোগসুবিধে চাই। তাঁরা বলবেন, চিনাদের দেখো— চিন একটা উন্নয়নশীল দেশ হওয়া সত্ত্বেও সেখানকার লোক প্রথম বিশ্বের মানুষদের থেকে কত বেশি উৎসাহ নিয়ে ডিজিটাল যুগকে আলিঙ্গন করছে, তথ্য নিয়ে এত রকম ভয়ভাবনার ধার ধারছে না। স্বাভাবিক। সকলেই জানে, চিনের কমিউনিস্ট পার্টি এত দিন যে পদ্ধতিতে ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর উপর নজরদারি রাখত, সব রকম তথ্য সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করত, ঠিক সেই ভাবেই চিনের সর্ববৃহৎ তথ্য-ভাণ্ডার বাইডু, আলিবাবা আর টেনসেন্ট আজ তথ্য সংরক্ষণ করে চলে। অর্থাৎ তথ্য সংগ্রহ ও সংরক্ষণ এত দিনে সে দেশের ইতিহাসের অংশ।
তবে কিনা, সব দিন তো সমান যায় না। আধার-কর্তারা আশা করি চিনের সাম্প্রতিক খবরাখবরও রাখছেন। এটা ঠিকই, এত দিন চিনের ডিজিটাল উপভোক্তারা বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে আস্থাবান ও সহিষ্ণু বলে পরিচিত ছিলেন, কিন্তু সেই পরিবেশ এখন দ্রুত পালটাচ্ছে। বাইডুর বিরুদ্ধে কিছু দিন আগেই জিয়াংসু প্রভিনশিয়াল কনজিউমার্স অ্যাসোসিয়েশন মামলা করেছে। জানা গিয়েছে যে, বাইডুর কাছে নাকি এমন সব অ্যাপ আছে যার মাধ্যমে উপভোক্তাদের ফোন ‘ট্যাপ’ করা যায়।
এই সব খবর থেকে আধার-কর্তাদেরও কিছু শিক্ষা নেওয়া জরুরি। চিনা উপভোক্তা সমাজ যদি আজ এ ভাবে তাদের ব্যক্তিগত তথ্য নিয়ে এতখানি উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন— যে চিনারা সর্বক্ষণের নজরদারি ও স্বল্প পরিমাণ নাগরিক স্বাধীনতায় বহু কাল যাবৎ অভ্যস্ত, তা হলে কাল ভারতীয় উপভোক্তারাও এক পথ ধরবেন। সুতরাং এখনই যদি আস্থা অর্জন ও বর্ধনের বিষয়ে ভাবনাচিন্তা না করা হয়, তবে সামনের দিনগুলিতে সমস্যা বিরাট। আমেরিকা, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, চিন এবং অবশিষ্ট বিশ্ব (যেখানে ভারতের থাকার কথা ছিল), সকলেই এগিয়ে যাবে, ভারত থেকে যাবে পিছনে।
আধারকর্তারা অবশ্য ইতিমধ্যে কিছু সংশোধন এনেছেন। ভার্চুয়াল আইডেন্টিটি, নো-ইয়োর-কাস্টমার বা কেওয়াইসির সীমিত ব্যবহার, আধার তথ্যে পৌঁছনো ও তা ব্যবহার করার মতো এজেন্সির সংখ্যা কমানো। তবে, গোপনীয়তা, নিরাপত্তা আর আস্থা অর্জনের পথে তাঁদের আরও অনেক পথ হাঁটতে হবে। মোদী প্রশাসনকে বুঝতেই হবে, রাশ টানার দরকার আছে। বুঝতেই হবে, রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপের বাড়াবাড়িটিকে ছেঁটেকেটে সব কাজে আধার বাধ্যতামূলক করার চেষ্টা বন্ধ করতেই হবে। তার সঙ্গে আদালতকেও বিচার ও রায়দানের ক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে, ডিজিটাল আস্থা নির্মাণের প্রশ্নটি এ দেশে নতুন, স্বল্প-পরিচিত, স্বল্প-আলোচিত।
সন্দেহ নেই, ভারতের ‘ইউনিক আইডি’ এ দেশের জন্য একটা ‘ইউনিক’ সুযোগ। এর মধ্যেই অন্তত কুড়িটি দেশ আধার নিয়ে আগ্রহ দেখিয়েছে। ঠিক পথে এগোলে বিশ্বে পথিকৃতের ভূমিকা নিতে পারে আমাদের দেশ। কিন্তু পথটা ভুলভাল হয়ে গেলে ডিজিটাল যুগে ভারতের দুটি অবদান হয়তো শেষ পর্যন্ত একটিতেই পর্যবসিত হবে: আধার হয়ে দাঁড়াবে একটা বিরাট ‘জিরো’!
টাফট্স ইউনিভার্সিটির ফ্লেচার স্কুলে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ও অর্থনীতির শিক্ষক