রাধিকা এবং রাজা ভেমুলা।
ভাবিয়াছিলাম বিদেশে গিয়া উচ্চতর শিক্ষা ও গবেষণা করিব, কিন্তু শেষ পর্যন্ত দেখিতেছি আমার জীবন অন্যায়ের বিরুদ্ধতা করিতেই কাটিতেছে: এক বৎসর আগে জানুয়ারি মাসেই বলিয়াছিলেন রোহিত ভেমুলার ভাই রাজা ভেমুলা। আজ হইতে ঠিক তিন বৎসর আগের জানুয়ারিতে তাঁহার ভ্রাতা রোহিত হায়দরাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ে আত্মঘাতী হইবার পর রাজাকে যে অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়া যাইতে হইয়াছে, তাহার অভিঘাতেই এই উচ্চারণ। উচ্চারণটির মধ্যে এক অবর্ণনীয় যন্ত্রণা টের পাওয়া সহজেই সম্ভব। দুই ভাই স্থির করিয়াছিলেন গবেষণা করিয়া বৈজ্ঞানিক হইবেন, কিন্তু ভারতের মাটিতে নহে, বিদেশে— কেননা ভারতের কোনও দলিত যুবক মেধাবুদ্ধির জোরে বৈজ্ঞানিক হইলে তাঁহার পরিচয় হয় নিছক ‘দলিত বৈজ্ঞানিক’ বলিয়াই। এই অমোঘ পরিচিতিটির বাহিরে যাইতে চাহিয়াছিলেন তাঁহারা। নিয়তির কী পরিহাস, দলিত পরিচিতি হইতে উত্তরণ চাহিয়াও শেষ পর্যন্ত এক জনকে সেই পরিচিতির শৃঙ্খল কণ্ঠে জড়াইয়া মৃত্যুবরণ করিতে হইল, অপর জনকে সেই পরিচিতির পক্ষ লইয়া সমাজ-সংগ্রামে নামিতে হইল। কিন্তু রাজা ভেমুলার বাক্যটি কেবল এই দিক দিয়াই গুরুত্বপূর্ণ বলিলে কম বলা হইবে। আরও বৃহৎ একটি মর্ম আছে ইহার, যাহা হয়তো তত সহজে খেয়াল করিবার মতো নয়। মর্মটি হইল, ভারতীয় সমাজের জন্যও বাক্যটি অক্ষরে অক্ষরে সত্য। স্বাধীনতা লাভের পর ভারতীয় সমাজের উচ্চাশা ছিল, জাত-ধর্ম ইত্যাদি সঙ্কীর্ণতার বেড়া ডিঙাইয়া একটি মুক্ত সমাজের দিকে অগ্রসর হইবার, ব্যক্তিকে তাহার জন্মপরিচিতির নিগড় হইতে মুক্তি দিয়া এক উদার সাম্যের আকাশের দিকে আগাইয়া দিবার। সে সব আশা মিথ্যা প্রমাণিত হইয়াছে। বদলে, এখন এই দেশ নূতন করিয়া সামাজিক বৈষম্যবন্ধনের মধ্যে ডুব দিয়াছে, আবার নূতন ভাবে ধর্ম-জাত বিভাজনরেখাগুলিকে আঁকড়াইয়া ধরিয়াছে। যে লড়াই ইতিমধ্যে শেষ হইবার কথা ছিল, তাহা তো শেষ হয়ই নাই, বরং লড়াইয়ের ক্ষেত্র আরও প্রসারিত হইয়াছে, লড়াইয়ের অংশগ্রহণ ও উদ্দীপনা হুড়হুড় করিয়া বাড়িতেছে। লজ্জাদ্বিধাভয় দূর করিয়া সমাজের এ প্রান্ত হইতে ও প্রান্ত এখন অনৈক্য ও অসাম্যের জয়গান গাহিতেছে।
সুতরাং, আশ্চর্য কী, হায়দরাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের দলিত ছাত্রদের ক্ষোভ থাকিবে একই রকম, ছাত্রছাত্রীরা সেখানে জাত-বরাবর একই রকম তীব্র বিভক্ত, ভেমুলার স্মৃতিতে বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে সৌধ নির্মাণ করিলে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বেদম আঘাতে তাহা ভাঙিতে ব্যস্ত। সব মিলাইয়া সেখানেও যেমন পূর্বাপেক্ষা বেশি বেগে বিভাজনের বাতাস বহিতেছে, বৃহত্তর দেশেও তেমনই। বিজেপি আমলে দলিতদের উপর হিন্দুত্ববাদীদের অত্যাচার কেবল অব্যাহত বলিলে ভুল হইবে, তাহা লাফে লাফে বর্ধমান। গোরক্ষার নামে নির্যাতন মুসলিমদের সহিত দলিতদেরও অসহায় শিকার করিয়া দিয়াছে। দলিতদের দিকে বিজেপি সংগঠন মনোযোগ দেয় শুধু ভোটপ্রচারের সময়ে, আর সেই মনোযোগের চরিত্র হয় পুরামাত্রায় রাজনৈতিক; সামাজিক বা অর্থনৈতিক নহে। দলিত নির্যাতনের বিরুদ্ধে আইনটি গত বৎসরে প্রত্যাহৃত হইয়া দলিতদের খেপাইয়া দেয়, তাহার পর ফিরিয়া আসিয়া উচ্চবর্ণকে ক্ষুব্ধ করে। সেই ক্ষোভ দমাইতে আবার উচ্চবর্ণের দরিদ্রদের জন্য সাংবিধানিক বিধি অমান্য করিয়া দশ শতাংশ অতিরিক্ত সংরক্ষণ ঘোষিত হয়। এই ভাবেই ধাপে ধাপে সঙ্কটের গভীর হইতে গভীরতর স্তরে আনীত হইতেছে ভারতীয় সমাজ। দলিত ও সংখ্যালঘুদের বুঝিতেছে যে, তাঁহারা সংখ্যাগুরুর দয়ায় এ দেশে বাঁচিতেছেন। আগামী নির্বাচন দেশে রাজনৈতিক পটপরিবর্তন আনিতে পারুক না পারুক, নরেন্দ্র মোদী ও তাঁহার শাসনকাল এক অক্ষমণীয় অবনমনের জন্য ঐতিহাসিক হইয়া থাকিবে— আর ভেমুলা তাহার অন্যতম প্রতীক হইয়া বিরাজ করিবেন।