সম্পাদকীয় ১

অবশেষে

শিকড় উপড়াইয়া তাহাকে দেশছাড়া করা গেল। মানবিকতা, নৈতিকতা, ধর্মীয়তা, কোনও কিছুরই ধার না ধারিয়া এই ভয়ংকর পুরুষতান্ত্রিক ঔদ্ধত্য এত দিন মুসলিম মেয়েদের নিষ্পেষণ করিয়া আসিতেছিল।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৪ অগস্ট ২০১৭ ০১:৩৪
Share:

তি ন তালাক সংক্রান্ত রায়টি সর্বার্থে ঐতিহাসিক। একটি অতি অন্যায় সামাজিক প্রথা অতিদীর্ঘ সময় ধরিয়া ভারতের মাটিতে শিকড় প্রোথিত করিয়া বসিয়া ছিল। শিকড় উপড়াইয়া তাহাকে দেশছাড়া করা গেল। মানবিকতা, নৈতিকতা, ধর্মীয়তা, কোনও কিছুরই ধার না ধারিয়া এই ভয়ংকর পুরুষতান্ত্রিক ঔদ্ধত্য এত দিন মুসলিম মেয়েদের নিষ্পেষণ করিয়া আসিতেছিল। দেশের সর্বোচ্চ আদালতের সুচিন্তিত ও সুবিতর্কিত রায়ের দ্বারা তাহার অন্ত ঘটিল। অতঃপর মুসলিম সমাজের ইতিহাস কিছু ভিন্ন ধারায় বহিবে। ভারতীয় নারীসমাজ কিছু নূতন মুক্তির আলোক দেখিবে। মুসলিম মেয়েরা অন্তত একটি আতঙ্ক হইতে রক্ষা পাইবেন। বাস্তবিক, এত সংখ্যক মুসলিম নারী এবং পুরুষ যে আগাইয়া আসিয়া তিন তালাক প্রথার বিরুদ্ধে, নিজেদের সমাজের পুরুষতন্ত্র-সিঞ্চিত কায়েমি স্বার্থের বিরুদ্ধে সরাসরি লড়াই করিলেন, এবং লড়াই-এর সাফল্যে প্রকাশ্যেই উদ্ভাসিত হইয়া উঠিলেন— দেখিয়া-শুনিয়া ভারতভাগ্যবিধাতার মুখে নিশ্চয়ই প্রসন্নতার উজ্জ্বল হাসি। সমস্ত তর্ক ও কুতর্ক ছাপাইয়া দেশের অর্ধেক আকাশ অন্তত একটুখানি মেঘমুক্ত।

Advertisement

একটি কুতর্ক তো বহুশ্রুত: ভারতে তিন তালাকের প্রচলন একেবারেই নামমাত্র, তাই তিন তালাক বিরোধিতা নেহাত রাজনীতির নম্বর তুলিবার বন্দোবস্ত! উত্তরে বলা যায়— এই পীড়িত-মুর্ছিত দেশে বন্যাত্রাণ হইতে প্রেমবিবাহ, কোন বিষয়টিই বা রাজনীতির নম্বর তুলিবার ক্ষেত্র নয়? সেই ফাঁক গলিয়া একটি অন্যায় দূর করা গেলে তাহাই বা কম কী? ২০১১ সালের জনগণনা-মতে, দেশের মুসলিম সমাজে ০.৫৬ শতাংশ প্রতি বৎসর তিন তালাকের লক্ষ্য হয়। শতাংশটি দেখিতে কম, সংখ্যাটি খুব কম নহে! এক জন নাগরিককেও এমন অন্যায় অবিচারের লক্ষ্য হইতে দেওয়া যায় না, বিশেষত যখন মুসলিম দেশগুলিতেই তিন তালাক প্রথা বহু কাল উঠিয়া গিয়াছে। উদ্যোগটিকে কেবল হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির উপকরণ ভাবিলে বিরাট ভুল হইবে। ইহা মানবতাবাদ ও নৈতিক গণতন্ত্রেরও উদ্যোগ। হিন্দুত্বের সহিত যাঁহারা এই অন্যান্য উদ্যোগ ও সামাজিক চিন্তাকে মিশাইয়া দিতে উদ্যত, তাঁহারা নিজেদের দৃষ্টির সংকীর্ণতা দিয়া নিজেরাই হিন্দুত্ববাদের হাত শক্ত করিতেছেন— অতীব বিপজ্জনক ভাবে।

উল্লেখ্য, সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি নিজে এই রায়ের সহিত একমত ছিলেন না। তাঁহার বক্তব্যে ভারতীয় রাষ্ট্রের দীর্ঘলালিত দুশ্চিন্তাটিরই আভাস: তিন তালাকে হস্তক্ষেপ করা কি সংবিধানের আওতায় পড়ে? ধর্মসমাজের মধ্যে রাষ্ট্র কি এত দূর প্রবেশ করিতে পারে? অন্য তিন বিচারপতি তাঁহার সংশয়ের উত্তরে যে প্রতিযুক্তি দিয়াছেন, সেগুলি অতিশয় গুরুতর: এই প্রথা কোরান বা শরিয়ত অনুযায়ী সিদ্ধ নয়, অর্থাৎ ইহা ধর্মীয় অনুশাসন নয়, একটি সামাজিক অনুশাসন। সামাজিক অনুশাসনের পরিসরে রাষ্ট্রীয় বিচার প্রবেশ করিতেই পারে। প্রসঙ্গত, আদালতের রায়ে আশ্বস্ত হইয়াও লিবারেল পণ্ডিতরা কেহ কেহ মর্মাহত বোধ করিতেছেন: কেন কোরান বা শরিয়তের প্রসঙ্গ আদৌ তোলা হইল? কেন ধর্ম বনাম সংবিধান বিতর্কে সাংবিধানিক অধিকারকেই এই সুযোগে প্রশ্নাতীত ভাবে প্রতিষ্ঠা করা হইল না? ইত্যাদি। অধৈর্য বিশেষজ্ঞ সমাজকে মনে করাইয়া দিতে হয় যে, ভারতের মতো দেশে বড় ধরনের সামাজিক-আচারগত সংস্কার এই ভাবেই পায়ে পায়ে আগাইয়াছে, ব্যক্তিঅধিকারের তুমুল কলরব দিয়া ধর্মসম্প্রদায়ের আচার-অভ্যাস রদ করিবার মতো যৌক্তিক পরিবেশ এ দেশে আজও প্রস্তুত নাই। এই বিরাট সীমাবদ্ধতার মধ্যেই যে শুরুর কাজটি করা গেল, ইহাই তো বড় কথা, ইহাই তো ইতিহাস। পথ শুরু হইলে তবেই-না সেই পথে হাঁটিয়া সামনে অগ্রসর হওয়া যাইবে!

Advertisement
(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন