বিপজ্জনক নিজস্বী। ফাইল ছবি
মানুষে তো নিজেকেই সবচেয়ে বেশি ভালবাসে। নিজের সম্পর্কে হয়তো কিছুটা অন্ধও। নিজেকে প্রকাশ করা জন্য উৎসুক। এই প্রকাশের আধুনিক মাধ্যম ‘নিজস্বী’। পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি দেশেই জনপ্রিয়। সোশ্যাল মিডিয়া নিজস্বীর মাধ্যমে আত্মপ্রকাশের ইচ্ছাকে ইন্ধন জুগিয়ে চলছে। তথ্যপ্রযুক্তির বিপ্লবের সঙ্গে পা মিলিয়ে আমরা এক উত্তর আধুনিক দুনিয়ায় এসে পৌঁছেছি। এই দুনিয়ার স্বরূপ নিয়ে নানা মুনির নানা মত। সে সব যুক্তি তর্কে না ঢুকেও এ কথা বলা চলে যে, স্মার্টফোন, কম্পিউটার, ট্যাবের সৌজন্যে আজকের যোগাযোগের ভাষাটা অনেকটাই বদলে গিয়েছে। এই যন্ত্রগুলি ক্রমশ দৈনন্দিন জীবনযাপনের অপরিহার্য অঙ্গ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। এই যন্ত্রগুলির মাধ্যমে সোশ্যাল মিডিয়ার ব্যবহার ছড়িয়ে পড়েছে। সেখানেই একটি আলাদ জায়গা করে নিয়েছে নিজস্বী।
নিজস্বী তুলে আপলোড করে ‘লাইক’ পাওয়ার অপেক্ষা মাঝেমধ্যেই দেখা যায়। ট্রেনে, বাসে হামেশাই দেখা যায় মোবাইলে ছবি ‘আপলোড’ করে দিয়ে হাপিত্যেশ করে অনেকে বসে থাকেন। মাঝেমাঝে মোবাইলটা খুলে দেখেন কতগুলি ‘লাইক’ বা ‘কমেন্ট’ পড়ল। আর এখানেই জন্ম নিচ্ছে এক বিপজ্জনক ধারণা। মনোবিজ্ঞানীরা বলছেন, প্রত্যেক মানুষই মনে করেন তাঁর নিজস্বীটি যত সুন্দর, বিস্ময়কর বা বিপজ্জনক হবে তত বেশি করে সেই ছবিতে আছড়ে পড়বে লাইক আর প্রশংসার ঢেউ। তাই নিজস্বী তোলার হাজারো ভঙ্গিমা আবিষ্কার করেছে মানুষ। এমনকি, নিজের দুঃসাহসিকতা প্রমাণ করতে বাঘের গলা জড়িয়ে ধরতে বা শিম্পাঞ্জির গালে চুম্বন করতেও তাঁর আপত্তি নেই। নিজেকে দুঃসাহসী প্রমাণ করতে বিপজ্জনক জায়গায় গিয়ে ছবি তুলছেন অনেকে। বেশ কিছু লাইক ও শেয়ার পেলে তবেই সন্তোষ।
অনেকেই নিজস্বী সংস্কৃতি বলে একটি কথার উল্লেখ করছেন। ‘সেল্ফি’ শব্দটি বছর পাঁচেক আগে ‘অক্সফোর্ড অভিধান’-এর অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। পৃথিবীর নানা ভাষায় ‘সেল্ফি মিউজিক আর্কাইভ’ তৈরি হচ্ছে। ভারতেও ‘কেমন করে আরও ভাল সেল্ফি তুলবেন’ জাতীয় নানা ওয়েবসাইট তৈরি হয়েছে। হাত দিয়ে নিজস্বী তোলার ‘প্রতিবন্ধকতা’ ঘোচাতে বাজারে এসেছে ‘সেল্ফি স্টিক’, নিজস্বী তোলার জন্য বিশেষ ধরনের জুতোও পাওয়া যাচ্ছে। নিজস্বী তোলার ক্যামেরার গুণমানের উপরে স্মার্টফোনের বিক্রি বা চাহিদা নির্ভর করছে। ইউরোপে তো ‘সেল্ফি স্টিক’ কে ‘নার্সিসাস স্টিক’ বলে চিহ্নিত করা হয়েছে।
দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯
বিষয় খুঁজে না পেয়ে, অনেক সময়ে অনেক তুচ্ছ বিষয়েও নিজস্বী তুলতে দেখা যায়। বর্ধমানের যুবকদের নিজের উপার্জিত অর্থে জীবনে প্রথম বার ট্রেনের টিকিট কাটার আনন্দে নিজস্বী তুলতেও দেখেছি। নিজস্বীর আকর্ষণ ছড়িয়ে পড়েছে ছোটদের মধ্যেও। পুজোর সময়ে মণ্ডপে ঠাকুরের সামনে দাঁড়িয়ে শিশুদের নিজস্বী তোলার ছবি হামেশাই চোখে পড়ে। মনোবিজ্ঞানীদের করা সাম্প্রতিক একটি সমীক্ষা বলছে, নিজেকে প্রকাশ করার চেষ্টা যে যে রকম ভাবে করে, সে সেই অবস্থায় ছবি তুলতে পছন্দ করে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, কেউ অবসাদগ্রস্ত। সে মনে করে সমাজ ও সংসারের নানা অভিঘাত তাকে খাদের কিনারে এনে দাঁড় করিয়েছে। এই অনুভূতিকে প্রকাশ করতে গিয়ে সে সত্যিই খাদের কিনারায় দাঁড়িয়ে ছবি তুলতে পারে। এই প্রবণতাগুলিই দিনে দিনে বিপজ্জজনক হয়ে উঠছে। আবার অ্যাডভেঞ্চারপ্রিয় মানুষেরা বাঘ, সিংহের মতো বন্যজন্তুর কাছে গিয়েও ছবি তুলতে পিছপা হন না। চিড়িয়াখানায় বাঘের খাঁচায় ঢুকে ছবি তুলতে গিয়ে কয়েক জন পর্যটকের মৃত্যুর খবরও বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে।
গুগল থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, সারা বিশ্বের নিরিখে নিজস্বী তুলতে গিয়ে দুর্ঘটনায় মৃত্যুর হারে ভারতবর্ষই সব থেকে এগিয়ে। দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে রাশিয়া। পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে দেখা গিয়ে, নিজস্বী তুলতে গিয়ে মৃতদের মধ্যে ৭২ শতাংশই মহিলা। তাঁদের অধিকাংশেরই বয়স তিরিশের নীচে। গুগলের দেওয়া তথ্য অনুসারে, ২০১৮ সালে এমন চার কোটি এমন নিজস্বী পোস্ট হয়েছে, যা বিপজ্জনক ভাবে তোলা। ভারতবর্ষে নিজস্বী তোলার জেরে ঘটে চলা দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণে মুম্বইয়ের ১৬টি পর্যটনস্থালে নিজস্বী তোলা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। আমাদের দেশে যেমন রাস্তা ঘাটে ‘ধীরে গাড়ি চালান, প্রাণ বাঁচান’ জাতীয় সতর্কতামূলক বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয় তেমন ভাবেই নিজস্বী তোলার জেরে ঘটে চলা দুর্ঘটনায় রাশ টানতে ও সচেতনতা প্রসারে রাশিয়ার রাস্তাঘাটে নিজস্বী তোলা নিয়ে সতর্কবার্তা লাগাতে বাধ্য হয়েছে সে দেশের সরকার। নিজস্বী তোলা নিয়ে সতর্কতা এ বার কালনার কয়েকটি সরস্বতী পুজোর মণ্ডপে থিম হয়েছিল।
বিজ্ঞানী হ্যাভলক এলিস, মনোবিজ্ঞানী অটো রাঙ্ক প্রমুখ মানুষের আত্মমগ্নতার কারণ হিসেবে নার্সিসিজম এর উল্লেখ করেছিলেন। এই তথাকথিত ‘নার্সিসিজম’ থেকেই আজকের যুগের নিজস্বী সংস্কৃতির বাড়বাড়ন্ত বলে মনে করেন বিজ্ঞানীদের একাংশ। তাঁদের মতে ‘নার্সিসিজম’ এর প্রভাবেই অনন্য হয়ে ওঠবার প্রাণপণ চেষ্টায় মানুষ নিজেকে সুন্দর, দুঃসাহসী ইত্যাদি প্রমাণ করতে চায়। আর সেই তাগিদ থেকেই আসে দুর্ঘটনা এবং বিপদ। এই নার্সিসিজম কাটিয়ে উঠতে না পারলে আশঙ্কা হয় ‘নিজস্বী তুলতে গিয়ে দুর্ঘটনায় মৃত্যু’-র ঘটনা বারবার ফিরে আসবে।
লেখক বর্ধমানের সাহিত্য ও সংস্কৃতিকর্মী