অনুব্রত মণ্ডলের আর যে দোষই থাকুক, তিনি অকুণ্ঠ সত্যবাদী। পঞ্চায়েত নির্বাচনের নির্ঘণ্ট ঘোষণার পরই তিনি জানাইয়া দিয়াছিলেন, বিরোধীরা মনোনয়ন পেশ করিতে বাহির হইলেই দেখিবেন, রাস্তার মোড়ে ‘উন্নয়ন’ দাঁড়াইয়া আছে। তা, উন্নয়নের সাক্ষাৎ মিলিতেছে। কোথাও সিপিআইএম নেতা রক্তাক্ত, কোথাও বিজেপি কর্মী ছুরিকাহত। উন্নয়নের জোয়ার কাহাকে বলে, তৃণমূল কংগ্রেস বুঝাইয়া দিতেছে। রাজ্য নির্বাচন কমিশন অবশ্য এই সব খুচরা ছবি দেখে নাই। জানাইয়াছে, পরিস্থিতি ভালই— অন্তত, ২০০৩ সালের তুলনায় ভাল তো বটেই। সত্য, রাজ্যে যতগুলি পঞ্চায়েত আছে, তাহার কয় শতাংশে বিরোধীরা মার খাইতেছেন? তাহাও ভাল, কমিশন বলিয়া দেয় নাই যে ইহা মাওবাদীদের চক্রান্ত। ঘটনা হইল, পঞ্চায়েত নির্বাচনের পূর্বে সন্ত্রাস পশ্চিমবঙ্গের ট্র্যাডিশন। তৃণমূল কংগ্রেস আর পাঁচটি ক্ষেত্রে যাহা করিয়াছে, এই সন্ত্রাসের ক্ষেত্রেও তাহার অন্যথা হয় নাই— বাম আমলের আইনহীনতার উপর আরও দুই পোঁচ রং চাপাইয়া, সভ্য সমাজের নামচিহ্নগুলি মুছিয়া তাহাকে আপন করিয়া লইয়াছে। আজ না হউক, পরশুর পরের দিন যদি রাজনৈতিক ক্ষমতায় ফের পালাবদল হয়, ছবিটি বদলাইবে বলিয়া রাজ্যের ভরসা নাই। এই রাজনৈতিক সন্ত্রাস বাংলার ডিএনএ-তে মিশিয়া গিয়াছে। অনুব্রত মণ্ডলরাই এই রাজ্যের বাস্তব। তবে, বাম আমলের সহিত ফারাক, সেই সময় কেহ বুক ঠুকিয়া কথাটি বলিত না। এখন অনুব্রতরা বলেন। এই সত্যবাদিতা লইয়া রাজ্য কী করিবে, ভোট মিটিলে ভাবিয়া দেখা যায়।
নির্বাচন কমিশন কেন সন্ত্রাস দেখিতে পায় না, সেই কারণটি জিজ্ঞাসা করিয়া কমিশনকে লজ্জায় ফেলিবার প্রয়োজন নাই। ২০১৬ সালেও কমিশনের দৃষ্টিশক্তি একই রকম ক্ষীণ ছিল। রাজনৈতিক ক্ষমতার চোখে চোখ রাখিয়া কথা বলিবার অভ্যাস আমলাতন্ত্র হারাইয়া ফেলিয়াছে। এখন সুরে সুরে সুর মিলাইতেই বেলা যায়। তাহাতে কমিশনের কর্তাদের কী লাভ, সেই হিসাব তাঁহারা বিলক্ষণ কষিবেন। কিন্তু, নির্বাচন কমিশন নামক প্রতিষ্ঠানটির কতখানি ক্ষতি, সেই অঙ্কটি স্পষ্ট করিয়া লওয়া ভাল। বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলি তো বটেই, রাজনীতিমনস্ক সাধারণ মানুষও কমিশনের নিরপেক্ষতায় বিশ্বাস করেন না। আশা করেন না যে সাধারণ মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষায় কমিশন কোনও ভাবে সক্রিয় হইবে। রাজ্যের রাজনৈতিক সংস্কৃতিও এই বিশ্বাস বা বিশ্বাসহীনতাকে কেন্দ্র করিয়াই গড়িয়া উঠিয়াছে। এই ক্ষতি অপূরণীয়।
‘যত পাল্টায়, ততই সব একই থাকিয়া যায়’, এই কথাটির উৎপত্তি ঊনবিংশ শতকের ইউরোপে। কিন্তু, ‘পরিবর্তন’-উত্তর পশ্চিমবঙ্গে কথাটি যতখানি খাঁটি, তাহার তুলনা মেলা ভার। ২০১১ সালে রাজ্যে রাজনৈতিক ক্ষমতা পাল্টাইয়াছে। পশ্চিমবঙ্গ পাল্টায় নাই। পঞ্চায়েত নির্বাচনের মনোনয়ন পেশ করাকে কেন্দ্র করিয়া এই তুমুল হিংস্রতা রাজধর্ম রক্ষায় শাসকদের সমূহ ব্যর্থতারই প্রকাশ। শান্তি বজায় রাখা, বিরোধীকে তাহার পরিসরটি ছাড়িয়া দেওয়া যে গণতন্ত্রের প্রাথমিক শর্ত, এই কথাটি বামফ্রন্ট ভুলিয়াছিল। তৃণমূল কংগ্রেস শিখিয়াই উঠিতে পারে নাই। এই রাজ্যে অনুব্রত মণ্ডলরাই ধর্ম, তাঁহারাই আইন। ভয় দেখাইয়া, গায়ের জোরে বিরোধীদের নির্বাচনে লড়িতে না দেওয়া যে গণতন্ত্রের পথ হইতে পারে না, এই কথাটি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দলের নন্তু-সন্তুদের শিখাইয়া উঠিতেই পারিলেন না। দলের অভ্যন্তরীণ সংস্কৃতির মাধ্যমেও নহে, প্রশাসনিক দৃঢ়তার পথেও নহে। দল অনুব্রতদের সংযত করে নাই, বরং প্রশ্রয় দিয়াছে। পুলিশেরও শাসনের সাহস হয় নাই। এই ব্যর্থতা কেন? গণতন্ত্রের পথে মুখ্যমন্ত্রীরও বিশ্বাস নাই বলিয়াই কি?