পিঠ-চাপড়ানি আপনি জুটবে

একটা উদাহরণ মাত্র। আরও অনেক উদাহরণ শুধুমাত্র এ বারের মার্কিন নির্বাচনের সময়টা ধরেই দেখানো যায়। সোশ্যাল মিডিয়ায় তখন হইহই ফেলছিল একের পর এক মিথ্যে খবর, ‘ফেক নিউজ’।

Advertisement

ঋদ্ধি চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ০৫ সেপ্টেম্বর ২০১৭ ০৬:০০
Share:

এই তো গত বছর, আমেরিকায় প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের সময়, সোশ্যাল মিডিয়ায় একটা উদ্ধৃতি খুব জনপ্রিয় হয়েছিল। উদ্ধৃতিটি নাকি ডোনাল্ড ট্রাম্পের। রিপাবলিকানদের তিনি কতটা ঘৃণা করেন, আর নিজেকে কত বুদ্ধিমান ভাবেন, সেই নিয়ে। লোকে তা নিয়ে বিবিধ বিজ্ঞ আলোচনাও করতে শুরু করেছিল, রিপাবলিকান পার্টি তাদের প্রার্থী পাল্টাবে কি না, জোর আন্দাজ-অনুমান চলছিল। এ দিকে, মজা হল— উদ্ধৃতিটা পুরো জাল। ট্রাম্প ও-কথা মোটেই বলেননি। অথচ কোনও নিউজ নেটওয়ার্ক সেটা ধরতে পারেনি। শেষ পর্যন্ত ব্যাপারটা ধরা পড়ে কিছু নাইট শো হোস্টের দৌলতে।

Advertisement

একটা উদাহরণ মাত্র। আরও অনেক উদাহরণ শুধুমাত্র এ বারের মার্কিন নির্বাচনের সময়টা ধরেই দেখানো যায়। সোশ্যাল মিডিয়ায় তখন হইহই ফেলছিল একের পর এক মিথ্যে খবর, ‘ফেক নিউজ’। এবং ভোটের ফলাফলও নাকি অনেকটাই তা দিয়ে প্রভাবিত হয়েছিল, লোকে বলে।

একই কাণ্ড দেখা গেল আমাদের দেশে, কিছু দিন আগে, যখন একটা স্থানীয় সাম্প্রদায়িক উত্তেজনার সূত্রে একটা পুরনো হিন্দি ফিল্মের ‘ক্লিপিং’-এ নারীনিগ্রহের ছবির পাশে একটি বিশেষ সম্প্রদায়ের নাম করে বলা হল, তারা নাকি আর এক সম্প্রদায়ের উপর এই ধরনের অত্যাচার চালাচ্ছে! ভাবুন কাণ্ড!

Advertisement

প্রশ্ন হল, কী করা যায়? একটা ছবির পাশে আর একটা কথা জুড়ে দিয়ে বাজারে ছেড়ে দিলেই যদি বহু লোক সেটা ‘সত্যি’ বলে বিশ্বাস করে নেয়, কী করব আমরা? এই আজকের ‘মিম’ সংস্কৃতি, এই ছবি আর ওই বক্তব্য মিলিয়ে মিশিয়ে ‘মজা’ করার খেলা, অথচ ‘মজা’টা যে সামাজিক-রাজনৈতিক ভাবে কতটা বিপজ্জনক হতে পারে, এর মধ্যেই তার আঁচ মিলছে। এই সর্বজনীন মজা-উৎসবে আমাদের সম্মিলিত ভাবনাচিন্তার একটা অবক্ষয়ও ধরা পড়তে বাকি থাকছে না।

এই জন্যই বোধহয় ‘পলিটিকস অ্যান্ড দি ইংলিশ ল্যাঙ্গোয়েজ’-এ আধুনিক সমাজ বিষয়ে জর্জ অরওয়েল মশাই বলেছিলেন: সভ্যতা যদি অবক্ষয়ের দিকে এগোয়, ভাষাও তবে অবধারিত ভাবে সে দিকে এগোবে! ১৯৮৬ সালেই অরওয়েল সাহেবের এমন মনে হয়েছিল! আজকের সমাজের ‘ডেকাডেন্স’ বা অবক্ষয় দেখলে কী বলতেন তিনি? অভিধানে এমন কোনও শব্দ আছে কি, যাতে আমাদের বর্তমান সমাজের ‘ডেকাডেন্স’-এর উচ্চতা (না কি নিম্নতা) ঠিকমতো ধরা যায়?

শব্দ নেই, তবে মিম আছে। মিম দিয়ে বোধহয় অবক্ষয়ের মাত্রাটা খানিক বোঝা যায়, বোঝা যায় কোথায় নেমেছি আমরা। রিচার্ড ডকিন্স মিম-কে ব্যাখ্যা করেছেন এই ভাবে যে, একটা সংস্কৃতির মধ্যে কী ভাবে একটা ভাবনা এক জন থেকে আর এক জনের মধ্যে সঞ্চারিত হয়, মিম তার দৃষ্টান্ত। অর্থাৎ ছবি ও কথার মধ্য দিয়ে কোনও ভাবনা প্রচারের উদাহরণ। এখন, সমস্যা দাঁড়ায় যখন আমরা বুঝতে শুরু করি যে একটা উপযুক্ত মিম বানানোর পিছনে যে পরিমাণ পরিশ্রম ও পড়াশোনা বা সময় লাগে, সে সব আমাদের নেই। ‘ইনফরমেশন এজ’-এ ওগুলোর জায়গা নেই। তথ্য যখন পেয়ে গিয়েছি, জ্ঞান আবার কোন কাজে লাগবে?

কেমন ছিল হলোকস্ট? ভারতীয়রা গাঁধীকে দু’চোখে দেখতে পারে না কেন? সাম্যবাদ পিছু হটার পিছনে কার বা কিসের হাত ছিল? প্রশ্নগুলো সহজ, উত্তর আরও সহজ! সব হাওয়ায় উড়ছে। টপ করে ধরে ফেললেই হল! আমরা, সুতরাং, মজা পেয়ে গেলাম। বাঃ, এ তো ভারী ভাল হিসেব! কিছুই জানতে বুঝতে মনে রাখতে হয় না, গুগল ফেসবুক বাজফিডেই কাজ হয়ে যায়। এই ডিজিটাল চণ্ডীমণ্ডপে সবার আমন্ত্রণ। ‘পোস্ট-ট্রুথ’ দুনিয়ার একটা আনন্দ আছে, মূর্খের স্বর্গে থাকার আনন্দ। বই পড়ার সময় কই! অন্তর্জাল জুড়ে যখন এত রসালো উপাচার, গহীন গোপন হাতছানি— এ সব ছেড়ে আবার দু’পাতা বই পড়া কেন? আর পড়লেও দু’পাতা নয়, দুই ছত্রই যথেষ্ট। মার্কস-এর ‘সোশ্যালিস্ট ইউটোপিয়া’ দুই ছত্র পড়েই একখানা মিম নামিয়ে দিতে পারব ডিজিটাল বৈঠকখানায়। পিঠচাপড়ানি আপনি জুটবে। নিজেকে বেশ মার্কসিস্ট হনু-ও ভেবে ফেলতে পারব।

যায় যায় দিন, ফুর্তিতে দিন! পুরো ‘অ্যানিম্যাল ফার্ম’ পড়ার সময় নেই, ইচ্ছে তো নেই-ই। শুধু এইটুকুই চট করে তুলে নিতে হবে: অল ‘মেন’ আর ইকুয়াল, সাম ‘মেন’ আর মোর ইকুয়াল দ্যান আদার্স। ব্যস, মিম-এর রসদ মজুত। এই পদ্ধতিই যদি এ বার রাজনীতিতে আনি? ‘ডার্ক হিউমার’-এর নাম করে দাঙ্গার পথ বানাই? ভাবাবেগ ক্ষুণ্ণ হলে যদি রে-রে করে উঠি: অদ্ভুত! রসবোধটাও নেই?

আপনিও চান মিম বানাতে? সুবিধের জন্য দেওয়া হল এই সহজ সহায়িকা। ১) যে কোনও একটা বিষয় বেছে নিন। ২) ওই বিষয়ে সবচেয়ে বিখ্যাত ব্যক্তিদের ব্যাপারে গুগল করে ভাসা ভাসা জেনে নিন। ৩) এক জন ব্যক্তিকে বেছে নিন এ বার, সঙ্গে ওই ব্যক্তির উল্টো পিঠে অবস্থান করেন, এমন আর একটি নামও বার করে নিন। ছবি চাই কিন্তু। মিলিয়ে দিন একটি মুখ এবং বিপরীতধর্মী বক্তব্যের একটি জম্পেশ লাইন। ৫) আপনাকে অভিনন্দন! আপনি আজকের সাত হাজার পাঁচশো তিরাশি নম্বর মিম-এর জননী হলেন! এর পর আপনিও পারবেন, ভোটে কাউকে জিতিয়ে দিতে, কিংবা এদিক ওদিক হাঙ্গামা-হুজ্জতি বাধিয়ে দিতে! পাঁচ মিনিটের কাজ!

এর মধ্যে আসল কথাটা মনে রাখুন, ভাবনা করা ছেড়ে দিন! মনে রাখুন, এই পোস্ট-ট্রুথ জগতে কম কমই আসলে বেশি বেশি! মন্দার বোস ভূগোলে ছাপ্পান্ন পেয়ে গ্লোবট্রটার হয়েছিলেন, মনে নেই?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন