শ্রমিক এখানে নাগরিক নন

শুক্রবার নৈহাটি থেকে খবর পেয়েছিলাম, হাজিনগরের এক কাগজমণ্ডের (পেপার পাল্প) কারখানায় ছ’জন শ্রমিক মারা গিয়েছেন। কারখানা বন্ধ।

Advertisement

নব দত্ত

শেষ আপডেট: ০৫ এপ্রিল ২০১৮ ০৬:১০
Share:

কারখানার গেটের বাইরে কয়েক জন পরিচয় দিলেন, তাঁরা শ্রমিক। এক জন কাঁদছেন, বুক চাপড়াচ্ছেন, বলছেন, ‘‘আমার সামনে ওই ছ’জন নামল আর উঠল না!’’

Advertisement

শুক্রবার নৈহাটি থেকে খবর পেয়েছিলাম, হাজিনগরের এক কাগজমণ্ডের (পেপার পাল্প) কারখানায় ছ’জন শ্রমিক মারা গিয়েছেন। কারখানা বন্ধ। শ্রমিকরা এবং অঞ্চলের মানুষরা শ্রমিকদের মৃতদেহ নিয়ে অবরোধ করেছেন— ক্ষতিপূরণ, মৃত্যুর তদন্ত, নিকটজনের বিকল্প চাকরির দাবিতে।

কারখানার ভেতরে ঢুকলাম এপিডিআর ও নাগরিক মঞ্চের যৌথ অনুসন্ধান দলের সঙ্গে। মিলের পরিচালকদের এক জন ঘটনার বিবরণ দিলেন। বৃহস্পতিবার বিকেল থেকে এফ্লুয়েন্ট ট্রিটমেন্ট প্লান্ট-এর একটি পাইপ থেকে জল লিক করছিল। খবর পেয়ে শ্রমিকদের একটি দল সেখানে যায়। মিঠুন কুমার, ফিটার পাইপের ভাল‌্ভ ঠিক করতে যান। প্যাঁচ কেটে জল বেরোতে থাকে, তাঁর ‘বাঁচাও বাঁচাও’ চিৎকারে তখনই একে-একে উদয়রাজ সিংহ, অমিত যাদব, অশোক বড়াল, মহম্মদ নাজিম, বিজয় ভার্মা একে অপরকে বাঁচাতে এগিয়ে যান এবং পর-পর মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন।

Advertisement

ঘটনার বিবরণ শোনার পর কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ জানালাম, আমাদের এক বার ঘটনাস্থল পরিদর্শন করতে দেওয়া হোক। অনুমতি মিলল। কারখানাটি পুরনো কাগজ পুনর্ব্যবহার করে প্যাকেজিং বোর্ড তৈরি করে। প্রায় একশো বিঘার মতো জমির ব্যবহারযোগ্য এক-তৃতীয়াংশ, বাকি জায়গায় বাড়ি, পরিত্যক্ত গুদাম এবং খালি জমি। কারখানার একেবারে শেষ প্রান্তে তারের জালের সীমানার পাশেই গঙ্গা বয়ে চলেছে। সেখানেই কারখানার বর্জ্য সংস্কারের প্লান্টটির ট্যাঙ্ক, তারই পাশে একটা ছোট কুয়ো, ত্রিশ ফুটের মতো গভীর, ভিতরে নামার সিঁড়ি রয়েছে। বেশ কয়েকটি পাইপ। আমরা ঝুঁকে দেখছিলাম ঠিক কোথা থেকে মারণ-গ্যাসের উৎপত্তি। টর্চ জ্বেলে ভেতরে দেখতে গিয়েই নাকে এল জোরালো ঝাঁজ। প্রশ্ন হল, ইটিপি পাইপের সংযোগের পথে কোনও ভাল্‌ভ লিক করলে গ্যাস বেরনোর সম্ভাবনা থাকে। সেখানে ব্যক্তিগত সুরক্ষা সরঞ্জাম ছাড়া কীভাবে এক জন শ্রমিক এবং ফিটার-এর মতো এক জন অভিজ্ঞ পেশাদার মিস্ত্রি এই ‘মরণ কুয়োয়’ নামলেন!

ফোরম্যান মহম্মদ নাজিম বাদে মৃতরা সবাই দৈনিক ১৮০ টাকা পেতেন। এই মজুরিতেই দিন আনা দিন খাওয়া, ‘বাঁচাও বাঁচাও’ আর্তনাদে ছুটে যাওয়া, কুয়োয় ঝাঁপিয়ে পড়ে অন্যের প্রাণ বাঁচানোর চেষ্টা— শ্রমিকরা বুঝি এমনই হন! সরকার ক্ষতিপূরণের ঘোষণা করেছেন। শ্রমিকদের ওপরই তো ছিল সংসার চালানোর ভার। থানায় অভিযোগ দাখিল করা হয়েছে। মামলা রুজু করা হয়েছে।

পশ্চিমবঙ্গে কারখানায় বছর-বছর দুর্ঘটনা বাড়ছে। ১৯৯৪ থেকে ২০১৫— একুশ বছরে প্রাণনাশক দুর্ঘটনা ঘটেছে ১৩৬৭টি। এই সময়ে বিভিন্ন কারখানায় সর্বমোট দুর্ঘটনা ঘটেছে ৬ লাখ ১৫ হাজার। স্পষ্টতই, শ্রমিকের নিরাপত্তার ব্যবস্থায় বিস্তর ফাঁক, বহু ত্রুটি। অথচ দেশে কারখানা আইন কিন্তু তৈরি হয়েছে স্বাধীনতার বহু আগে। ১৮৮৪ সালে এন এম লোখান্ড-এর নেতৃত্বে মিলহ্যান্ডস অ্যাসোসিয়েশন বোম্বাইয়ে (এখন মুম্বই) শ্রমিকদের সভায় ৫৫০০ শ্রমিকের স্বাক্ষরিত স্মারকলিপি পেশ করে। দাবি করা হয়, প্রতি রবিবার শ্রমিকদের ছুটি থাকবে, প্রতিদিন মধ্যাহ্নে বিশ্রামের জন্য আধ ঘণ্টা সময় বরাদ্দ করতে হবে, মাসের পনেরো তারিখের মধ্যে আগের মাসের পুরো বেতন দিতে হবে, কর্তব্যরত অবস্থায় কোনও শ্রমিক আহত বা অক্ষম হয়ে পড়লে সুস্থ না হওয়া অবধি তাঁকে পুরো বেতন দিতে হবে, কোনও শ্রমিক পঙ্গু হয়ে গেলে তাঁর পরবর্তী জীবনধারণের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে।

১৮৮১ থেকে ১৮৯১ পর্য়ন্ত কারখানায় কাজের সময় ছিল সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত। ১৮৯১ সালে ফ্যাক্টরি আইন সংশোধিত হল। এর পিছনে দুটি কারণ ছিল। এক, ক্রমাগত অমানুষিক পরিশ্রমের ভার নিতে না পেরে শ্রমিকরা গ্রামে ফিরে যেতেন। বিষয়টি নিয়ে ব্রিটিশ হাউস অব কমন‌্স-এ আলোচনা হয়। এই সময় গঠিত ফ্যাক্টরি এনকোয়ারি কমিশন-এর কাছে শ্রমিকরা তাঁদের দুরবস্থার কথা জানান। ১৯৩৭ সালের ব্রিটিশ আইনের ভিত্তিতে ১৯৪৮ সালে ফ্যাক্টরিজ অ্যাক্ট তৈরি হয়। স্বাধীন ভারতে তো বটেই, কোনও ‘সমাজতান্ত্রিক’ দেশেও শ্রমিকদের জন্য এমন প্রগতিশীল আইন নেই। ১৯৮৭-তে এই আইনে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ সংশোধনও হয়।

কিন্তু আমাদের দেশের ট্রেড ইউনিয়ন এই আইনকে কাজে লাগিয়ে কোনও সদর্থক শ্রমিক আন্দোলন গড়ে তুলতে সক্ষম হয়নি। শ্রমিকদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন করার কোনও উদ্যোগ করেনি, কারও এ নিয়ে বিশেষ কোনও মাথাব্যথাও নেই। কাজ চলে যাওয়ার আশঙ্কায় শ্রমিকও চুপ করে থাকেন। ইএসআই বিমার আওতায় আছেন রাজ্যের মোট শ্রমিকদের মাত্র ছ’শতাংশ। রাজ্যে প্রায় পঁচিশ হাজার শ্রমিক ইএসআইয়ের আওতায় অর্ধেক বা পূর্ণ প্রতিবন্ধী হিসাবে ভাতা পান। এই প্রতিবন্ধী ভাতা পাওয়ার তালিকায় বছরে গড়ে প্রায় ২৫০০ শ্রমিকের নাম যুক্ত হয়। সমস্যা হল, রাজ্যে ক্ষমতাসীন রাজনীতিকরা এই সব আইন-অধিকার নিয়ে কোনও কথা শোনার ‘মুড’-এ নেই। হয়তো তাঁরা মনে করেন এ-সব কাজে অনুদান-নির্ভর ‘উন্নয়ন’ ব্যাহত হবে।

আর, বাংলায় শ্রমিকরা কোনও দিনই ‘নাগরিক’ নন। তাই নাগরিক সমাজের মাথারাও এই সব মৃত্যু নিয়ে বিচলিত হন না। ১৯২০-তে এক ট্রেড ইউনিয়ন নেতা বলেছিলেন, পুঁজিপতিরা ক্রীতদাস ক্রয় করা বন্ধ করেছেন, কিন্তু তাঁরা এখনও শ্রম ক্রয় করেন এবং চাহিদা ও সরবরাহের চিরন্তন নারকীয় নিয়ম অনুযায়ী এই শ্রমের জন্য তাঁরা মজুরি দেন। সেখানেই তাঁদের সব দায় ফুরোয়।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন