সম্পাদকীয় ১

ঘৃণার প্রতিভা

এই ব্যাধি আকাশ হইতে পড়ে নাই। এই ঘৃণা সমাজসঞ্জাত। সমাজমাধ্যমে কুৎসিত আক্রমণের যে প্লাবন অধুনা এই দেশে প্রতিনিয়ত ঘটিয়া চলিয়াছে, তাহার পিছনে জঙ্গি জাতীয়তাবাদের মানসিকতা অতিমাত্রায় প্রকট।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৭ জুন ২০১৮ ০১:২৭
Share:

কোদালকে কোদাল বলিতে হয়। অসভ্যতাকেও অসভ্যতা বলাই বিধেয়। সোশ্যাল মিডিয়া বা সমাজমাধ্যমে যাহারা বিদেশমন্ত্রী সুষমা স্বরাজের প্রতি কুৎসিত ভাষায় গালিগালাজ নিক্ষেপ করিতেছে, তাহারা অসভ্যতার মাউন্ট এভারেস্টে না হউক, কাঞ্চনজঙ্ঘায় পৌঁছাইয়াছে। ‘ট্রোলিং’ নামক অধুনা-প্রচলিত শব্দটি দিয়া সেই কৃতিত্বকে পুরোপুরি ধরা যাইবে না। সমাজমাধ্যমে ট্রোলিং বলিতে বুঝায়, কোনও ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে নিশানা করিয়া পরিকল্পিত ভাবে আক্রমণ করা। মত প্রকাশের স্বাধীনতা থাকিলে এমন আক্রমণের স্বাধীনতাও থাকা উচিত— এই যুক্তি বহুশ্রুত। সমালোচনা এবং গালিগালাজের মধ্যরেখাটি প্রায়শই অস্পষ্ট, সুতরাং কথাবার্তায় শালীনতা বা সভ্যতার দাবি কার্যত বাক্‌স্বাধীনতা খর্ব করিবার প্রকরণে পরিণত হইতে পারে, এই আশঙ্কা অমূলক নহে। ‘হেট স্পিচ’-এর অধিকার চাহিয়া বহু দেশে বহু যুগে বহু মানুষ সওয়াল করিয়াছেন। ট্রোলিং সেই বাঙ্ময় ঘৃণার এক নূতন প্রকাশ। কত দূর অবধি তাহা চলিতে পারে, তাহা লইয়া বিস্তর তর্ক। কিন্তু সুষমা স্বরাজ সম্পর্কে নিক্ষিপ্ত কুবাক্যগুলির কদর্যতা বুঝাইয়া দেয়, সমাজ সভ্যতা ও শালীনতার স্বাভাবিক বোধ হইতে বিচ্যুত হইলে বাক্‌স্বাধীনতা বস্তুটির কী পরিমাণ অপব্যবহার হইতে পারে। এই ব্যাধির চিকিৎসা আবশ্যক। সমাজমাধ্যমের উপর নিয়ন্ত্রণ জারি করাই সেই চিকিৎসার পথ— এমন বিধান গণতন্ত্রের শর্ত লঙ্ঘন করে, কিন্তু পথ খুঁজিবার প্রয়োজন অনস্বীকার্য।

Advertisement

এই ব্যাধি আকাশ হইতে পড়ে নাই। এই ঘৃণা সমাজসঞ্জাত। সমাজমাধ্যমে কুৎসিত আক্রমণের যে প্লাবন অধুনা এই দেশে প্রতিনিয়ত ঘটিয়া চলিয়াছে, তাহার পিছনে জঙ্গি জাতীয়তাবাদের মানসিকতা অতিমাত্রায় প্রকট। এবং সেই গরলে সঙ্ঘ পরিবারের তৈয়ারি হিন্দুত্ববাদের অনুপানও কম প্রকট নহে। নরেন্দ্র মোদীর রাজত্বে এই বিষের প্রকোপ বিপুল বিক্রমে বাড়িয়াছে। সামগ্রিক ভাবেই বাড়িয়াছে— নির্বাচনী জনসভা হইতে শুরু করিয়া যে কোনও উপলক্ষে শাসক শিবিরের রকমারি স্তরের রকমারি নায়কনায়িকার মুখে থাকিয়া থাকিয়াই অমৃতবাণী বর্ষিত হয়, তবে সমাজমাধ্যম এই শিবিরের প্রিয়তম চারণভূমি, সেখানে নিশানা বাছিয়া বাছিয়া গালিগালাজ করিবার জন্য অষ্টাদশ অক্ষৌহিণী সতত সজাগ ও সক্রিয়। উপলক্ষ পাইলেই, এবং না পাইলে উপলক্ষ বানাইয়া লইয়া তাহারা ঘৃণার বিষ ছড়ায়। সুষমা স্বরাজ এমনই একটি উপলক্ষ নির্মাণের শিকার। তিনি একটি নিতান্ত স্বাভাবিক এবং মানবিক সিদ্ধান্ত লইয়াছেন, কিন্তু যে হেতু সেই সিদ্ধান্তে ঘটনাচক্রে এক জন ইসলাম ধর্মাবলম্বী নাগরিকের উপকার হইয়াছে, অতএব তিনি হিন্দুত্ববাদী বিদ্বেষের লক্ষ্য।

আপন মন কি বাত আওড়াইতে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী অমিতবাক, কিন্তু হিন্দুত্ববাদী শিবিরের এই ধরনের অন্যায় এবং কুৎসিত আক্রমণের নিন্দা বা প্রতিবাদ তাঁহার মুখে বিরল বলিলেও কম বলা হয়। এহ বাহ্য, যাহারা এই বিষ উদ্‌গিরণ করে, তাহাদের অনেককেই তিনি সমাজমাধ্যমে ‘ফলো’ করিয়া থাকেন। কাহাকেও ‘অনুসরণ’ করিলেই তাহার সকল কথা মানিতে হইবে বা সেই কথায় নিহিত মতের দায়িত্ব লইতে হইবে, সমাজমাধ্যমের দুনিয়ায় এমন দায় কাহারও নাই। কিন্তু তাহারা ভয়ানক রকমের অসভ্যতা করিলেও তিরস্কার করিব না, এমনকি তাহাদের অনুসরণও বন্ধ করিব না— এই আচরণ কি প্রশ্রয়ের, হয়তো বা প্ররোচনারও পরিচায়ক নহে? অন্যে পরের কথা, খোদ বিদেশমন্ত্রীর এতটা অসম্মানেও মোদীজির শ্রীমুখে বোল ফুটিল না, ইহাতে সংশয় হওয়া অত্যন্ত স্বাভাবিক যে, অসম্মানকারীদের প্রতি তাঁহার সমর্থন আছে। যদি এই সংশয় সত্য না-হয়, তবে তাহা মিথ্যা প্রমাণের দায় প্রধানমন্ত্রীর।

Advertisement
(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন