(বাঁ দিক থেকে) বনমালীরানি, পুতুলরানি, খগেনরানি। নিজস্ব চিত্র
এক সাক্ষাৎকারে অভিজ্ঞতাটা জানিয়েছিলেন চপলরানি। যাত্রা এবং নাট্যাভিনেতা চপল ভাদুড়ী। মঞ্চে মেয়েদের চরিত্রে অভিনয় করতেন চপলরানি নামে। ‘চাঁদের মেয়ে’ নাটকে অভিনয়ের সময়ের ঘটনা। স্টেজ থেকে গ্রিনরুম একটু দূরে। সাদা থান পরে স্টেজে আসছিলেন। তখনই হঠাৎ করে শূন্যে উঠে গেলেন। তারপর এক জিপের ভিতরে। এক তরুণ চপলরানিকে বাড়ি নিয়ে যেতে চান।তাঁকে বিয়ে করতে চান। তিনিই চপলরানিকে জিপে তুলেছিলেন। শেষে অনেক কষ্টে জিপ থেকে নেমে লম্বা পরচুলাটা খুলতে পেরেছিলেন। তারপরই সেই তরুণ ‘পাথরের মতো শান্ত’!
চপলরানির অভিজ্ঞতার সঙ্গে কী আশ্চর্য মিল পুতুলরানির। পাঁশকুড়ার পুতুলরানির প্রকৃত নাম সীতারাম বেরা। এখন বয়স ৬৩ বছর। তিনিও চপলরানির মতো পুরুষ হয়েও যাত্রায় মহিলার চরিত্রে অভিনয় করতেন। পুতুলরানির অভিজ্ঞতা ১৯৭০ সাল নাগাদ। এক জায়গায় যাত্রা শেষে সাজঘরের দিকে যাচ্ছিলেন। সেই সময়েই কিছু যুবক তাঁকে অন্ধকারে টেনে নিয়ে যায়। শেষে ভুল বুঝতে পেরে ছেড়ে দেন তাঁকে।
সুসময়ের অভিজ্ঞতায় চপলরানি আর পুতুলরানির আশ্চর্য মিল। কিন্তু অভিনয় জগতে চালু সেই অমোঘ প্রবাদও যে বড় বাস্তব, ‘দেহপট সনে নট সকলি হারায়’। আর সেখানেই মেদিনীপুরের পুতুলরানিরা মঞ্চ ছাড়ার পরে বিপাকে পড়েন। পেট চালাতে তাঁদের কেউ চায়ের দোকানে কাজ করেন। কারও পেশা জমির দালালি। কেউ মেকআপ ম্যান। অবিভক্ত মেদিনীপুরে মহিলার চরিত্রে অভিনয় করা এমন পুরুষ অভিনেতার সংখ্যা যথেষ্ট। যাত্রার ইতিহাসের স্বর্ণযুগ বলা হয় বিশ শতকের ৪০-৬০ এর দশককে। কিন্তু এই সময়ে যাত্রায় মহিলাদের আগমন ঘটেনি। মহিলা চরিত্রে অভিনয় করতেন পুরুষরাই। তাঁদের বলা হত ‘মেল ফিমেল’। তাঁরা যে যোগ্য অভিনেতা ছিলেন তা তো চপলরানি এবং পুতুলরানির ঘটনাতেই প্রমাণ। সেই সময়ে নাম করেছিলেন শতদলরানি, ছবিরানি, মধুরানি, রাখালরানি, বিধানরানি, বাবলিরানি, বিমলরানি, চপলরানি প্রমুখ। যাত্রায় মহিলা শিল্পীরা অভিনয় শুরু করার পরেও এঁদের অনেকে অভিনয় করেছিলেন সুনামের সঙ্গেই।
বছর কুড়ি আগেও গ্রামাঞ্চলের অন্যতম বিনোদন ছিল যাত্রা। জেলার যাত্রা মানে পূর্ব মেদিনীপুরের নন্দকুমার, পশ্চিম মেদিনীপুরের বেলদা। মেদিনীপুর যাত্রা পরিষদের অন্তর্ভুক্ত যাত্রাদলের সংখ্যা ১০৫টি। ফলে অবিভক্ত মেদিনীপুরে মহিলার চরিত্রে অভিনয় করা পুরুষ অভিনেতার সংখ্যাও যথেষ্ট। দুই মেদিনীপুরে জীবিত ‘মেল ফিমেল’ অভিনেতার সংখ্যা প্রায় দু’হাজারের কাছাকাছি। কেমন আছেন সেই অভিনেতারা? পশ্চিম মেদিনীপুরের খড়্গপুর গ্রামীণ থানার তেঁতুলমুড়ি গ্রামের বাসিন্দা খগেনরানি। প্রকৃত নাম খগেন্দ্রনাথ পাল। বয়স ৬৭ বছর। খড়্গপুরে এক চালের দোকানে কাজ করেন। ১৯৬০ সালের শেষ দিক থেকে অভিনয়ে আসেন। প্রথম অভিনয় একটি ঐতিহাসিক পালায়। রানির ভূমিকায়। এখনও সেই পালার সংলাপ শোনাতে অবাধ। শোনালেন রোজনামচা। সকালবেলা ২০ কিলোমিটার সাইকেল চালিয়ে চালের দোকানে যান। সন্ধ্যায় আবার সাইকেল চালিয়ে বাড়ি ফেরা। দিন চলে যায় কোনও মতে।
নারায়ণ দাস অধিকারী
খড়্গপুরের সাঁকোয়ালকের বনমালী ঘোড়াইয়ের বয়স ৬২ বছর। যাত্রা জগতে তিনি বনমালীরানি হিসেবে পরিচিত ছিলেন। বনমালীবাবুর স্পষ্ট মনে আছে প্রথম দিনের ঘটনা। ১৯৭১ সাল। অষ্টম শ্রেণিতে পড়তেন। সেই বছরে স্থানীয় বাড়হিন্দু বিবিটিআই ক্লাবে ঐতিহাসিক পালা নেমেছিল ‘রাজবন্দি’। পালায় তিনি আর্জুবানুর চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন। প্রশংসা পেয়েছিল তাঁর অভিনয়। বনমালীবাবু বলেন, ‘‘আমি তখন অষ্টম শ্রেণিতে পড়ি। বাবা-মাকে অনেক অনুরোধ স্থানীয় ক্লাবের যাত্রাশিল্পী সুশান্ত দাশ, রামকান্ত দে, রবীন্দ্রনাথ দে-রা আমাকে যাত্রার আসরে এনেছিলেন।’’ তারপর ২০ বছরের বেশি সময় ধরে প্রতিষ্ঠিত যাত্রাদলে নায়িকার চরিত্রে অভিনয় করেছেন। পারিশ্রমিক তেমন ছিল না। কিন্তু অভিনয়ের প্রতি ভালবাসায় মঞ্চ ছাড়েননি। এখনও যাত্রা-নাটকে মেকআপম্যানের কাজ করে চলেছেন।
নারায়ণ দাস অধিকারীর বয়স ৬৫ বছর। তিনি সাঁকোয়া গ্রামের বাসিন্দা। ২৫ বছর ধরে মহিলা চরিত্রে অভিনয় করেছেন। সত্তরের দশকে স্কুলে পড়ার সময়েই স্থানীয় ক্লাবের যাত্রায় অভিনয়ে হাতেখড়ি। প্রথম যাত্রা পালা ‘কুরুক্ষেত্রে কৃষ্ণ’এ গান্ধারীর চরিত্রে অভিনয় করেন। এখন কার্যত বেকার তিনি। মাঝে মাঝে জমি কেনাবেচায় মধ্যস্থতা করে কিছু টাকা উপার্জনের চেষ্টা করেন। তাতে কোনও রকমে দিন চলে যায়। পাঁশকুড়ার সুন্দরনগরের ‘মেল ফিমেল’ অভিনেতা নিরঞ্জন বেরা সম্প্রতি প্রয়াত হয়েছেন। ১৯৬০ সালের শেষ দিক থেকে নিয়মিত মহিলার চরিত্রে অভিনয় করেছেন। শেষ বয়সে খুব অসহায় অবস্থায় দিন কেটেছে তাঁর। অন্যের চায়ের দোকানে কাজ করতেন। খড়্গপুরের চকতুড়িয়া গ্রামের ‘মেল ফিমেল’ বিষ্ণুপদ মাইতির শেষ জীবন অসহায়তার মধ্যেই কেটেছে। পাঁশকুড়ার রবি মণ্ডলের অবস্থাও ভাল নয়।
পাঁশকুড়ার পুতুলরানি অর্থাৎ সীতারাম বেরার বয়স এখন ৬৩ বছর। মহিলা চরিত্রে অভিনয় করে সারা রাজ্যেই সুনাম পেয়েছিলেন। দেখতেও সুন্দর ছিলেন। রাজ্যের বড় বড় যাত্রা দলে অভিনয় করতেন তিনি। নবম শ্রেণিতে পড়ার সময়ে যাত্রা দলে যোগ দেন। তারপর টানা ২৫ বছর ধরে অভিনয়। ‘ক্ষুধিত হারেম’, ‘প্রেমের সমাধি তীরে’, ‘সারথি’, ‘লীলাবসান’ প্রভৃতি যাত্রাপালায় তাঁর অভিনয় দর্শকদের মুগ্ধ করেছিল। এই পুতুলরানি তথা সীতারামকেই অভিনয়ের পরে তুলে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছিল কয়েকজন। বৃদ্ধ বয়সে এসে বিপাকে পড়েছেন। পেট চালাতে মেকআপম্যানের কাজ করেন। তাতে সংসার চলে না। তাই মাঝে মাঝে কীর্তন দলে যোগ দিয়ে নামগান করেন। কোনওমতে সংসার চলে যায়।
পুতুলরানি, বনমালীরানি, খগেনরানিরা কয়েকটি নাম। দুই মেদিনীপুরে আরও বহু ‘মেল ফিমেল’ অভিনেতা রয়েছেন। মঞ্চ ছাড়ার পরে যাঁদের অবস্থা এখন খুব একটা ভাল নয়। সরকারি ভাতা পান না অনেকেই। যখন সুসময় ছিল তখনও পারিশ্রমিক খুব বেশি ছিল না। এক সময়ে দর্শকেরা মুগ্ধ হতেন তাঁদের অভিনয়ে। শেষ জীবন কিছুটা সম্মানজনক হোক। চান পুতুলরানিরা।
লেখক শিক্ষক-প্রাবন্ধিক