সম্পাদকীয় ২

বিরোধীর ভেক

বিধানসভা কিংবা লোকসভার দায়িত্ব ন্যস্ত অধ্যক্ষের উপর। সভার কার্যরীতি ও পদ্ধতি বিষয়ে তাঁহার সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত। তবে গণতন্ত্র চালিত হয় প্রচলিত রীতির দ্বারা।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০৫ সেপ্টেম্বর ২০১৭ ০০:০৮
Share:

বাঘরূপী ছিনাথ বহুরূপীর খড়ের লেজটি কাটিয়া লইয়াছিল দারোয়ান। সন্দেহ হয়, পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার পাবলিক অ্যাকাউন্টস কমিটির (পিএসি) দফতরে সেটি মিলিবে। না হইলে বিধানসভার বাহিরে অনুগত, ভিতরে বিরোধীর ভেক কী করিয়া ধরিতেছেন কমিটির চেয়ারম্যানরা? মানস ভুইঞা তৃণমূলে প্রবেশের পরেও কংগ্রেস বিধায়ক হিসাবে চার-পাঁচ মাস কাটাইয়াছেন। ওই সময়কালে তিনি ওই কমিটির চেয়ারম্যানের পদ ছাড়েন নাই। এ বার পালা শঙ্কর সিংহের। তিনি কংগ্রেসের প্রার্থী হিসাবে নির্বাচিত হইয়াছিলেন গত বিধানসভায়, কিন্তু গত জুন মাসে তৃণমূলে যোগ দিয়াছেন। খাস তৃণমূল ভবনে তাঁহার হাতে দলের পতাকা ধরাইয়াছিলেন তৃণমূলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায়। তিনিই এখন দাবি করিয়াছেন, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মঞ্চে আসিলেই কেহ তৃণমূল হয় না। শঙ্করবাবু পুরভোটেও লড়িয়াছেন। তাহা সত্ত্বেও তিনি এখন প্রশ্ন করিতেছেন, তিনি কি কংগ্রেসে নাই? যথার্থ প্রশ্নটি হইল, শঙ্করবাবু কি তৃণমূলে নাই? পিএসি সরকারের সকল দফতরের সকল হিসাব খতাইয়া দেখে। তাহার পরিচালনা করিয়া থাকেন বিরোধী নেতা। বিরোধীর মূল্যায়ন ও মতামতকে স্বাগত জানাইবে সরকার, ইহাই গণতন্ত্রের মৌলিক নীতি। বিরোধীদের প্রধান ভূমিকা সরকারের কাজে নজরদারি। শাসকদলের সদস্য, এমনকী শাসক-ঘনিষ্ঠ সদস্যও যদি বিরোধীর মুখোশ পরিয়া সরকারের মূল্যায়ন করিতে বসে, রাজ্যবাসীর পক্ষে তাহা এক প্রাণান্তকর প্রহসন দাঁড়ায়।

Advertisement

বিধানসভা কিংবা লোকসভার দায়িত্ব ন্যস্ত অধ্যক্ষের উপর। সভার কার্যরীতি ও পদ্ধতি বিষয়ে তাঁহার সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত। তবে গণতন্ত্র চালিত হয় প্রচলিত রীতির দ্বারা। আইন, নীতি বা লিখিত বিধি অপেক্ষা সেই রীতির গুরুত্ব কম নহে। এ দেশের রীতি অনুসারে বিরোধী দলগুলিই নির্ধারণ করিয়া থাকে, পিএসি-র চেয়ারম্যান কে হইবে। কিন্তু পর পর দুই বার বিরোধীদের বক্তব্য অগ্রাহ্য করিলেন স্পিকার বিমান বন্দ্যোপাধ্যায়। বাম বিধায়ক সুজন চক্রবর্তীকে পিএসি চেয়ারম্যান করিবার সম্মিলিত বিরোধী প্রস্তাব নাকচ করিয়াছিলেন তিনি। মানসবাবুর পদত্যাগের পর নূতন চেয়ারম্যান করিতে নির্বাচন করিবার, বা অন্তত বিরোধীদের সহিত আলোচনা করিবার অনুরোধও তিনি এড়াইয়াছেন, এমনই আক্ষেপ বিরোধী নেতাদের। তাঁহাদের সহিত আলোচনা না করিয়া শঙ্করবাবুকে মনোনীত করা হইয়াছে, এই অভিযোগ উঠিয়াছে।

বিরোধীদের বক্তব্যের সত্যাসত্য বিচারের বিষয়। কিন্তু সকল পক্ষের সহিত আলোচনা করিয়া সহমতের ভিত্তিতে কাজ করিবার সুযোগ যখন রহিয়াছে, তখন কেন একতরফা সিদ্ধান্ত ঘোষণা করিবার অভিযোগ উঠিবে? বিরোধী রাজনৈতিক দল ও তাহার নেতাদের পরিষদীয় ব্যবস্থায় গুরুত্ব দিবার মানসিকতা গণতন্ত্রের একটি মৌলিক অভিজ্ঞান। শাসকের আচরণে সেই মানসিকতাই প্রত্যাশিত। পশ্চিমবঙ্গে সেই প্রত্যাশা অপূর্ণ। শাসক বামফ্রন্ট বিরোধীদের মর্যাদা দিত, এমন অপবাদ তাহাকে কেহ দেয় নাই। কিন্তু অন্তত পিএসি-র মতো প্রতিষ্ঠানগুলিতে তাহারা সচরাচর রীতি মানিয়া চলিত। তৃণমূল কংগ্রেস সেইটুকুতেও নারাজ। তাহার পৌরোহিত্যে গণতন্ত্রের ষোলো কলা পূর্ণ হইয়াছে।

Advertisement
(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন