তাঁহাদের দর্শন সম্পূর্ণ হইবার পর গর্ভগৃহের দরজা এক ঘণ্টা বন্ধ থাকিল। আয়াপ্পার মন্দিরের শুদ্ধিকরণ করিলেন পুরোহিতরা। তবুও কনকদুর্গা ও বিন্দু ইতিহাস রচনা করিলেন। সুপ্রিম কোর্ট শবরীমালার মন্দিরে ঋতুযোগ্য মহিলাদের প্রবেশাধিকার পুনঃস্থাপিত করিবার পর এই প্রথম দুই নারী পা দিলেন মন্দিরের অভ্যন্তরে। স্বীকার করা ভাল, পুরুষতন্ত্র পরাজয় স্বীকার করিয়া লয় নাই। মন্দিরের যেমন শুদ্ধিকরণ হইয়াছে, তেমনই রাজ্য জুড়িয়া ‘প্রতিবাদ’ করিয়াছে বিরোধী বিজেপি ও কংগ্রেস। এমনকী, দুই সাহসিনীর এক জনের পরিবার-সদস্যরা জানাইয়াছেন, মন্দিরের প্রথা ভঙ্গ হউক, তাঁহারা চাহেন নাই। কনকদুর্গা ও বিন্দুকে গোপন আস্তানায় থাকিতে হইয়াছে, পরিচিত পথের আঠারো ধাপ সিঁড়ি অতিক্রম করিয়া তাঁহারা মন্দিরে প্রবেশ করেন নাই। গোপন দরজা দিয়া, পুলিশি নিরাপত্তায় পৌঁছাইতে হইয়াছে মন্দিরে। তবুও তাঁহারা ইতিহাস রচনা করিলেন। নারীবাদী ইতিহাস। তাঁহারা দেখাইয়া দিলেন, পুরুষতন্ত্রের দুর্গ যতই দুর্ভেদ্য হউক না কেন, তাহা অজেয় নহে। লড়াই না ছাড়িলে, আঘাত করিতে থাকিলে দুর্গের গায়ে ফাটল ধরেই। গত কয়েক মাস শবরীমালা সেই সংগ্রামের সাক্ষী থাকিল। যত বার মহিলারা মন্দিরে প্রবেশ করিতে চাহিয়াছেন, কুৎসিত প্রতিরোধ হইয়াছে। বিন্দু আর কনকদুর্গাও প্রথম বার মন্দিরে প্রবেশ করিতে পারেন নাই। কিন্তু, সংগ্রাম জারি থাকিয়াছে। এক্ষণে কেহ প্রশ্ন করিতে পারেন, কোনও একটি মন্দিরে প্রবেশাধিকার পাওয়া মহিলাদের জন্য এমন গুরুতর প্রশ্ন হইবেই বা কেন? বহু জরুরিতর সংগ্রাম কি পড়়িয়া নাই? অবশ্যই আছে। কিন্তু, কোনও একটি পরিসর— তাহা যতই অকিঞ্চিৎকর হউক না কেন— মহিলাদের জন্য অবরুদ্ধ থাকিলে সেই বাধাটিকে চূর্ণ করা অন্য সংগ্রামগুলির সাফল্যের জন্যও জরুরি— সামাজিক পরিসরের এক প্রান্তের জয় অন্য প্রান্তের ল়ড়াইকে শক্তিশালী করে বলিয়াই।
মন্দিরে ঢুকিলেন দুই জন। কিন্তু, প্রায় পঞ্চাশ লক্ষ নারী রাজ্যের উত্তরতম প্রান্ত হইতে দক্ষিণতম বিন্দু অবধি ৬২০ কিলোমিটার দীর্ঘ ‘মানবী-প্রাচীর’ রচনা করিয়া জানাইলেন, এই লড়াই শুধু ওই দুই জনের ছিল না। পঞ্চাশ লক্ষ মানুষ এক সঙ্গে পথে নামিলেন— এই ঘটনাকে শুধু রাজনীতি দিয়া ব্যাখ্যা করা অসম্ভব। অনুমান করা চলে, শবরীমালা লইয়া ব্যক্তিগত ক্ষোভ দীর্ঘ দিন ধরিয়া পুঞ্জীভূত হইতেছিল। এত দিনে তাহা সমষ্টিগত প্রকাশের পথ খুঁজিয়া পাইয়াছে। ঠিক এই বিন্দুতেই সুপ্রিম কোর্টের রায়টির গুরুত্ব। যাঁহারা বলিয়াছিলেন, শুধুমাত্র রায় ঘোষণা করিয়াই সামাজিক বাস্তব বদলাইয়া দেওয়া যায় না, তাঁহারা অর্ধেকটি দেখিতে পাইয়াছিলেন। আদালতের রায়টি অনুঘটকের কাজ করিয়াছে। যাঁহারা এই দীর্ঘ দিনের অন্যায় প্রথার বিরুদ্ধে লড়িতে চাহিতেন, তাঁহারা নৈতিকতার অস্ত্র পাইয়াছেন। যাঁহারা ভাবিতেন, মহিলাদের বাহিরে রাখিবার এই কুপ্রথায় তাঁহাদের ক্ষোভ ব্যক্তিগত, এবং সামাজিক পরিসরে তাহা প্রকাশ করিবার উপায় নাই, ঔচিত্যও নাই— তাঁহারা বুঝিয়াছেন, লড়াইটিকে গণপরিসরে লইয়া আসা যায়। একটি প্রচলিত ধারণার সহিত প্রতিস্পর্ধী ধারণার সংঘাতে নূতন দিগন্ত খুলিয়া যাওয়া, নূতন সম্ভাবনার জন্ম— তাত্ত্বিকরা ইহাকেই ‘ডায়ালেক্টিক’ প্রক্রিয়া বলিবেন। বস্তুত, সমাজের পরিসরে রাষ্ট্রের অবস্থান ঠিক কী হওয়া বিধেয়, সুপ্রিম কোর্টের রায় তাহা দেখাইয়া দিল। কেরলের মুখ্যমন্ত্রী বলিয়াছেন, বিন্দু আর কনকদুর্গাকে হেলিকপ্টারে চ়ড়াইয়া মন্দিরে পৌঁছাইয়া দেওয়া হয় নাই— তাঁহারা পথটি হাঁটিয়াই গিয়াছেন। এত দিনের বাধা শেষ অবধি তাঁহাদের পথ আটকাইতে পারে নাই। শবরীমালার মন্দিরের পথে দুই নারী যে শেষ পর্যন্ত হাঁটিতে পারিলেন, ইহাই ইতিহাস। সুপ্রিম কোর্টের রায়ের গর্ভে সেই ইতিহাসের জন্ম।