ইন্দোনেশিয়ায় এশিয়ান গেমসের উদ্বোধনে নীল-সাদা দলটিকে লইয়া কিছু অধিক উৎসাহের সঞ্চার হইয়াছিল। এই দল কোনও একটি দেশের নহে, সংযুক্ত উত্তর ও দক্ষিণ কোরিয়ার। গত শতাব্দীর পঞ্চাশের দশকে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের পরবর্তী কালে দুই দেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রে বৈরিতা ব্যতীত আর কোনও শব্দ প্রয়োগ করা চলিত না। সাম্প্রতিক দিনগুলিতে কূটনৈতিক ক্ষেত্রে তাহা মিত্রতায় পরিণত হইয়াছে। এবং গত এপ্রিলে দুই রাষ্ট্রপ্রধানের ঐতিহাসিক বৈঠকে বন্ধন সুদৃঢ় করিবার সঙ্কল্পে বাহন হিসাবে নির্বাচন করা হইয়াছিল ক্রী়ড়াক্ষেত্র। সেই অনুসারে, বাস্কেটবল, রোয়িং-সহ বহু ইভেন্টে হাতে হাত ধরিয়া রণক্ষেত্রে অবতীর্ণ হইয়াছে অতীতের দুই যুযুধান শক্তি। ময়দানের সেই সম্প্রীতিই উন্মাদনার চেহারা লইয়া সমর্থকদের মনে সঞ্চারিত হইয়াছিল। দুই দেশের মন্ত্রীদের উপস্থিতিতে উদ্বোধনী শোভাযাত্রায় কোরিয়ার বৈচিত্রময় সংস্কৃতির চিত্রটি তুলিয়া ধরা হইয়াছিল। নেতৃত্বে ছিলেন দক্ষিণের বাস্কেটবল খেলোয়াড় লিম ইয়ুং-হুই এবং উত্তরের ফুটবলার জু কিয়ং-চোল। তাঁহারা দুই জন শ্বেত পতাকায় অঙ্কিত নীল বর্ণের সংযুক্ত কোরিয়ার মানচিত্রটিকে সকলের উপরে আন্দোলিত করিতেছিলেন।
ক্রীড়াক্ষেত্রে ধ্বজার ভূমিকা অতীব গুরুত্বপূর্ণ। বলিউডের ছবিতে ত্রিবর্ণ পতাকার মাধ্যমেই দেশপ্রেম বুঝানোর চল। উহা দেখাইয়া ক্রীড়াবিদদের অন্তরে জয়ের ক্ষুধা জাগাইয়া তোলা হয়। জাকার্তায় উৎসাহের ছবিটি দেখিলে এই পদ্ধতি সম্পর্কে প্রশ্ন জাগিতে পারে। বিজয়ের তাগিদ যদি কেবল আপন ধ্বজাতেই জাগরূক হইত, তবে সংযুক্ত কোরিয়া লইয়া উন্মাদনা থাকিবার কারণ নাই। বলিউডের যুক্তি মানিলে, এই ক্রীড়াবিদেরা এত কাল উত্তর কিংবা দক্ষিণের পতাকায় জয়ের উৎসাহ পাইত। সুতরাং, ধ্বজা বদলাইলে প্রেরণায় ভাটা দেখা দিবার কথা। বাস্তবে হইয়াছে তাহার বিপরীত। এই চিত্র অন্যত্রও বর্তমান। বিশ্বকাপার সামান ঘোদ্দোস এবং কেভিন বোয়াতেং দুইটি দেশের হইয়া ফুটবল খেলিয়াছেন। জয়ের তাগিদ অনুভব করিতে তাঁহাদের সঙ্কট জাগে নাই। সুইডেনে জন্মগ্রহণ করা ইরানি ঘোদ্দোস জানাইয়াছিলেন, ফুটবলারের নিকট দেশ নির্বাচন প্রকৃত অর্থে ক্লাব নির্বাচনেরই শামিল। সুতরাং, পতাকা বদলাইবার পরেও কোরিয়া কী করিয়া দেশপ্রেম জাগাইল, তাহার অন্বেষণ জরুরি।
অতি-জাতীয়তার এই কালে সীমানা অতিক্রমের ক্ষমতাটি আশা জাগায়। কিয়ৎকাল পূর্বে যাহা কল্পনা করা যাইত না, তাহা হইয়াছে, আশা সেই কারণে। এবং, ইতিহাসে এমন ঘটনা অপ্রত্যাশিত হইলেও সম্পূর্ণ বিরল নহে। এক কালে এক অমোঘ প্রাচীর দ্বিখণ্ডিত করিত বার্লিন শহরকে। দুই মেরুর দ্বৈরথের চিহ্ন হিসাবে তাহা দণ্ডায়মান ছিল প্রায় তিন দশক। উহাকে অমোঘ মনে করিয়া, অপর পারে কী হইতেছে, তাহা লইয়া গল্পকথাও রচিত হইত পূর্ব ও পশ্চিমে। তবু শেষাবধি জনসাধারণের শুভাকাঙ্ক্ষার নিকটে ধ্বংসপ্রাপ্ত হইয়াছিল বার্লিন প্রাচীর। কোরীয় উপদ্বীপকে দ্বিখণ্ডিত করিয়া অবস্থিত ‘ডিমিলিটারাইজ়ড জ়োন’টিও তদ্রূপ। ছয় দশক পরে ধীরে ধীরে তাহার অসীম গরিমা নির্বাপিত হইতে শুরু করিয়াছে। কূটনীতি হইতে ক্রীড়াক্ষেত্র— জ়োনটির দীর্ঘ ছায়া অপসরণের প্রক্রিয়াটির সূত্রপাত ঘটিয়াছে। ইতিহাসের শিক্ষা: ছায়াটি বিলীন হইবার প্রত্যাশা অলীক নহে।