বিশ্বভারতী: শুরুর ভাবনার শতবর্ষ

চার দেওয়ালের গণ্ডীতে আবদ্ধ, শৈশবে অন্তর থেকে অপছন্দ করা হৃদয়হীন শিক্ষাব্যবস্থার প্রতিবাদে গুটিকয়েক ছাত্র নিয়ে গড়ে তোলা তাঁর ব্রহ্মবিদ্যালয়ের একটি বড় রূপ প্রথম থেকেই কল্পনা করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। ১৯১৮-র ২৩ ডিসেম্বর (৮ পৌষ) শিশুবিভাগ সংলগ্ন মাঠে একটা গর্তে আতপচাল, কুশ, জল ইত্যাদি নিক্ষেপ করে রবীন্দ্রনাথ প্রতিষ্ঠা করলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিত্তি, যার নাম দিলেন ‘বিশ্বভারতী’। লিখছেন নীলাঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়।চার দেওয়ালের গণ্ডীতে আবদ্ধ, শৈশবে অন্তর থেকে অপছন্দ করা হৃদয়হীন শিক্ষাব্যবস্থার প্রতিবাদে গুটিকয়েক ছাত্র নিয়ে গড়ে তোলা তাঁর ব্রহ্মবিদ্যালয়ের একটি বড় রূপ প্রথম থেকেই কল্পনা করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। ১৯১৮-র ২৩ ডিসেম্বর (৮ পৌষ) শিশুবিভাগ সংলগ্ন মাঠে একটা গর্তে আতপচাল, কুশ, জল ইত্যাদি নিক্ষেপ করে রবীন্দ্রনাথ প্রতিষ্ঠা করলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিত্তি, যার নাম দিলেন ‘বিশ্বভারতী’। লিখছেন নীলাঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৩ ডিসেম্বর ২০১৮ ০০:৫৪
Share:

শান্তিনিকেতন আশ্রমে বিধুশেখর শাস্ত্রী পাঠ দিচ্ছেন অনন্ত শাস্ত্রীকে। ছবি: রবীন্দ্রভবনের সৌজন্যে

১৯০১ সালে তাঁর বড় ছেলে রথীন্দ্রনাথ-সহ পাঁচ জন ছাত্রকে নিয়ে শান্তিনিকেতনে, বাবা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের প্রতিষ্ঠা করা শান্তিনিকেতন আশ্রমে ব্রহ্মচর্যাশ্রমের প্রতিষ্ঠা করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। মহর্ষির পৌত্র বলেন্দ্রনাথ ঠাকুরই প্রথম শান্তিনিকেতনে একটি ব্রহ্মবিদ্যালয়ের সূচনা করেন। তাঁর মৃত্যুর পরে রবীন্দ্রনাথ আবার নতুন উদ্যমে সেই কাজ শুরু করেন। ১৯০১-এ প্রিয় বন্ধু বৈজ্ঞানিক জগদীশচন্দ্র বসুকে লেখা চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ তাঁর ব্রহ্মবিদ্যালয়ের আদর্শ ব্যাখ্যা করে লিখেছেন, “শান্তিনিকেতনে আমি একটি বিদ্যালয় খুলিবার জন্য বিশেষ চেষ্টা করিতেছি। সেখানে ঠিক প্রাচীনকালের গুরুগৃহবাসের মতো সমস্ত নিয়ম। বিলাসিতার নাম-গন্ধ থাকিবে না— ধনী, দরিদ্র সকলকেই কঠিন ব্রহ্মচর্য্যে দীক্ষিত হতে হইবে। ... অসংযত প্রবৃত্তি এবং বিলাসিতায় আমাদিগকে নষ্ট করিতেছে— দারিদ্র্যকে সহজে গ্রহণ করিতে পারিতেছি না বলিয়াই সকল প্রকার দৈন্যে আমাদিগকে পরাভূত করিতেছে!”

Advertisement

ত্যাগ স্বীকারী জ্ঞানতাপসদের সান্নিধ্যে, প্রকৃতির স্পর্শে, যুক্তির চর্চায় দীক্ষিত হয়ে, দারিদ্র্যকে বরণ করে নিয়ে শান্তিনিকেতনে তাঁর ব্রহ্মবিদ্যালয়ের ছাত্রেরা আত্মশক্তি-নির্ভর হবে এবং নিজেদের সহজ প্রকাশে পারদর্শী হবে— এমনটাই চেয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ।

অর্থের অভাব বারবার রবীন্দ্রনাথের বিদ্যালয়ের পথের বাধা হয়েছে, কিন্তু তার গতি রোধ করতে পারেনি। রথীন্দ্রনাথ তাঁর স্মৃতিকথায় মা মৃণালিনী দেবীর প্রসঙ্গে লিখেছেন, “যখনই বিশেষ প্রয়োজন হয়েছে, নিজের অলংকার একে একে বিক্রি করে বাবাকে টাকা দিয়েছেন। শেষ পর্যন্ত হাতে সামান্য কয়েকগাছা চুড়ি ও গলায় একটি চেন ছাড়া তাঁর কোনো গয়না অবশিষ্ট ছিল না। মা পেয়েছিলেন প্রচুর, বিবাহের যৌতুক ছাড়াও শাশুড়ির পুরানো আমলের ভারী গয়না ছিল অনেক। শান্তিনিকেতনের বিদ্যালয়ের খরচ জোগাতে সব অন্তর্ধান হল। বাবার নিজের যা-কিছু মূল্যবান সম্পত্তি তা আগেই তিনি বেচে দিয়েছিলেন।”

Advertisement

চার দেওয়ালের গণ্ডীতে আবদ্ধ, শৈশবে অন্তর থেকে অপছন্দ করা হৃদয়হীন শিক্ষাব্যবস্থার প্রতিবাদেই গুটিকয়েক ছাত্র নিয়ে গড়ে তোলা তাঁর ব্রহ্মবিদ্যালয়ের একটি বড় রূপ প্রথম থেকেই কিন্তু কল্পনা করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। ১৯০২-এ জগদীশচন্দ্র বসুর স্ত্রী অবলা বসুকে লেখা চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, “আমি এখন গুটিকয়েক বালক লইয়া এখানে নিভৃতে পড়াইতেছি। আশা করিতেছি এই অঙ্কুরটি ক্রমে বড় গাছ হইয়া ফলবান হইবে।”

১৯১৮। রবীন্দ্রনাথ অকালে হারালেন তাঁর বড় মেয়ে মাধুরীলতাকে। সে-বছরই যেমন আশ্রমের অন্ধকার ঘুচিয়ে সেই প্রথম কুষ্টিয়া থেকে নিয়ে আসা তেলে চলা ইঞ্জিনের সাহায্যে উত্পাদিত বৈদ্যুতিক আলো এল শান্তিনিকেতনে, রবীন্দ্রনাথের মনে আলোর মতোই এল বিশ্বভারতীর ভাবনা। ১৯১৮-র ২৩ ডিসেম্বর (৮ পৌষ) শিশুবিভাগ সংলগ্ন মাঠে একটা গর্তে আতপচাল, কুশ, জল ইত্যাদি নিক্ষেপ করে রবীন্দ্রনাথ প্রতিষ্ঠা করলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিত্তি, যার নাম দিলেন ‘বিশ্বভারতী’। কিন্তু ঠিক কবে থেকে তাঁর ছোট্ট আশ্রমবিদ্যালয়কে বিশ্বের সঙ্গে যুক্ত করার লক্ষ্যে একটি বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে তোলার চিন্তা শুরু করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ, তা নির্দিষ্ট করে বলা হয়তো কঠিন। তাঁর নিজের লেখা থেকে ধারণা করা যায়, শান্তিনিকেতন আশ্রমের সংস্কৃত শাস্ত্রজ্ঞ বিধুশেখর শাস্ত্রীর সঙ্গে আলোচনাই হয়ত রবীন্দ্রনাথকে প্রবুদ্ধ করেছিল তাঁর ব্রহ্মবিদ্যালয়কে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের মিলনায়তন হিসেবে, একটি বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে গড়ে তুলতে। জানা যায়, ১৯১৮-র ৮ অক্টোবর জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে একদল গুজরাতি ব্যবসায়ীর সভায় রবীন্দ্রনাথ জানিয়েছিলেন জাতীয় বিদ্যাচর্চার কেন্দ্র হিসেবে একটি বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে তোলার পরিকল্পনার কথা।

বিধুশেখর শাস্ত্রীর লেখা থেকে জানা যায়, রবীন্দ্রনাথই তাঁর বিশ্ববিদ্যালয়ের নামকরণ করেছিলেন ‘বিশ্বভারতী’। বিধুশেখর লিখেছেন, “বিশ্বের সঙ্গে ভারতের একটা আধ্যাত্মিক যোগ প্রতিষ্ঠা হোক, কবির এই আন্তরিক ইচ্ছাও হয়ত, ‘বিশ্বভারতী’ নামকরণের মধ্যে অন্তর্নিহিত রয়েছে।” তিনি আরও লিখেছেন, “বিশ্বভারতী নাম করিবার পূর্বে গুরুদেব ঐ সম্বন্ধে আমার সহিত অনেক আলোচনা করিয়াছিলেন।” বিধুশেখরই “যত্র বিশ্বং ভবত্যেকনীড়ম্” অর্থাৎ বিশ্ব যেখানে মিলেছে এক নীড়ে— এই বেদবাক্যটি রবীন্দ্রনাথকে দেখিয়েছিলেন, যা পরে বিশ্বভারতীর সঙ্কল্প-বাক্য হিসেবে গৃহীত ও ব্যবহৃত হয়।

১৯১৯-এ রবীন্দ্রনাথের ভাষণে সম্ভবত ‘বিশ্বভারতী’ শব্দটি প্রথম পাওয়া যায়। তিনি লিখেছিলেন, “এই বিদ্যালয় উত্কৃষ্ট আদর্শে চাষ করিবে, গোপালন করিবে, কাপড় বুনিবে এবং নিজের আর্থিক সম্বল-লাভের জন্য সমবায়-প্রণালী অবলম্বন করিয়া ছাত্র শিক্ষক ও চারিদিকের অধিবাসীদের সঙ্গে জীবিকার যোগে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত হইবে। এইরূপ আদর্শ বিদ্যালয়কে আমি ‘বিশ্বভারতী’ নাম দিবার প্রস্তাব করিয়াছি।” রবীন্দ্রনাথ মনে করতেন, বিশ্ববিদ্যালয় মূলত বিদ্যার উত্পাদনের কেন্দ্র, বিদ্যার বিতরণ তার গৌণ কাজ। যে জ্ঞানতাপসদের ঘিরে তাঁর আশ্রমবিদ্যালয়কে বিশ্বজনীন বিদ্যা উত্পাদনের কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ, ১৯১৯-এ সেই আদর্শ পরিবেশের একটা বর্ণনা দিয়েছেন তিনি নিজেই— “আমাদের আসনগুলি ভরে উঠেছে। সংস্কৃত পালি প্রাকৃতভাষা ও শাস্ত্র অধ্যাপনার জন্য বিধুশেখর শাস্ত্রী মহাশয় একটিতে বসেছেন, আর একটিতে আছেন সিংহলের মহাস্থবির; ক্ষিতিমোহনবাবু সমাগত, আর আছেন ভীমশাস্ত্রী মহাশয়। ওদিকে এন্ড্রুজদের চারিদিকে ইংরেজি সাহিত্যপিপাসুরা সমবেত। ভীমশাস্ত্রী এবং দিনেন্দ্রনাথ সংগীতের অধ্যাপনার ভার নিয়েছেন, আর বিষ্ণুপুরের নকুলেশ্বর গোস্বামী তাঁর সুরবাহার নিয়ে এঁদের সঙ্গে যোগ দিতে আসছেন। শ্রীমান নন্দলাল বসু ও সুরেন্দ্রনাথ কর চিত্রবিদ্যা শিক্ষা দিতে প্রস্তুত হয়েছেন। ... আমাদের একজন বিহারী বন্ধু সত্বর আসছেন। তিনি পারসি ও উরদু শিক্ষা দেবেন, ও ক্ষিতিমোহনবাবুর সহায়তায় প্রাচীন হিন্দিসাহিত্যের চর্চা করবেন। মাঝে মাঝে অন্যত্র হতে অধ্যাপক এসে আমাদের উপদেশ দিয়ে যাবেন এমনও আশা আছে।”

১৯০৫-এ শান্তিনিকেতন আশ্রমে জুজুত্সু শেখাতে জাপান থেকে এসেছিলেন জিন্.নোসুকে সানো। ১৯১৪-এর ১২ জুলাই এক চিঠিতে সেই সানো রবীন্দ্রনাথকে অনুরোধ করেছিলেন কবির আশ্রমবিদ্যালয়কে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের আকার দেওয়ার। হতেই পারে সানোর অনুরোধ রবীন্দ্রনাথের বিশ্বভারতীর ভাবনায় ইন্ধন জুগিয়েছিল। বিশ্বভারতী নিয়ে রবীন্দ্রনাথের দুর্ভাবনাও ছিল যথেষ্ট। ১৯১৮ সালে বিশ্বভারতীর ভিত্তি প্রতিষ্ঠা হলেও তার আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন হয়েছিল ২৩ ডিসেম্বর, (৮ পৌষ) ১৯২১-এ। শিক্ষাবিদ যদুনাথ সরকার বিশ্বভারতীর ‘গভর্নিং বডি’-এর সদস্য হওয়ার আহ্বান প্রত্যাখ্যান করলে খুবই ব্যথিত হয়ে রবীন্দ্রনাথ তাঁকে লিখেছিলেন, “আমার কাজের বিরুদ্ধে আমার দেশের লোকের একটা প্রতিকূল ধারণা আছে, ইহা আমার পক্ষে বিষম বাধা। ... আপনি বলিয়াছেন, বোলপুরের ছাত্রগণ exact knowledge ঘৃণা করিতে শেখে, এবং এইরূপ জ্ঞানের শিক্ষক ও সাধকগণকে “হৃদয়হীন, শুষ্কমস্তিষ্ক, ‘বিশ্বমানবের শত্রু’, বলিয়া উপহাস করিতে অভ্যস্ত হয়। একথা যদি সত্য হয় তবে আমার এই বিদ্যালয় কেবল যে নিষ্ফল তাহা নহে ইহার ফল বিষময়। কিন্তু একথার আপনি কোন প্রমাণ পাইয়াছেন?”

প্রশান্তচন্দ্র মহলানবীশকে লেখা চিঠিতে যেন বিশ্বভারতী প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যের জবাবদিহি করতে শোনা যায় রবীন্দ্রনাথকে : “তুমি বলেচ, আমার দেশের লোক জিজ্ঞাসা করচে আজকের দিনের দেশের বর্ত্তমান চিত্তক্ষোভের মধ্যে এই বিশ্বভারতী প্রতিষ্ঠার কি এমন প্রয়োজন? তার উত্তর এই যে বিশ্বভারতী আমার পক্ষে এবং আমার দেশের পক্ষে প্রয়োজনের সামগ্রী নয়— তার মধ্যে যে সত্য যে কল্যাণ আছে তা প্রয়োজনের অতীত— এইজন্যে তার পক্ষে কোনো সময়ই অসময় নয়— বরঞ্চ যে সময়ে বাহিরে তার প্রতিকূলতা, অর্থাৎ বাহিরের দিকে যেটা অসময়, সেইই তার প্রকৃত সময়।” পারস্পরিক শ্রদ্ধা অটুট রেখে বন্ধুত্বপূর্ণ পরিবেশে মনের দীনতা দূর করে নিখিল বিশ্বের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করবে তাঁর বিশ্বভারতী এই ছিল রবীন্দ্রনাথের ইচ্ছা। আর তার জন্য ধনের কালিমায় আশ্রমকে অশুচি না করে সহজ সরল, অনাড়ম্বর এক জীবনযাত্রাকেই বেছে নেওয়ার উপদেশ দিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। ১৯১৩ সালে সন্তোষচন্দ্র মজুমদারকে তাই লিখেছিলেন, “শান্তিনিকেতনের ঐ বিদ্যালয়ের প্রান্তটিকে তোমরা গরিব করে দাঁড় করাও নইলে তাঁর কাছে সত্যমনে ভিক্ষা চাইবে কেমন করে?” আর তাঁকেই ১৯২১-এ বিশ্বভারতীর আনুষ্ঠানিক প্রতিষ্ঠার বর্ষে স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন, “আমাদের শান্তিনিকেতন আয়তনে ছোট কিন্তু সমস্ত নিউইয়র্কের চেয়ে অনেক বড় একথা সেখানে থেকে তোমরা ঠিক বুঝতে পারবে না।”

লেখক বিশ্বভারতীর রবীন্দ্রভবনের প্রাধিকারিক (মতামত ব্যক্তিগত)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন