বিদ্যালয় থেকে বিশ্ববিদ্যালয়, কবির ভাবনায় বিশ্বভারতী

ভবিষ্যৎদ্রষ্টা রবীন্দ্রনাথ কালের ভবিতব্যতা নিয়ে তাঁর সাহিত্যকৃতিতে এত প্রকাশ করেছেন, আর তাঁর বিদ্যালয় যে এক দিন বিশাল মহীরুহ হয়ে উঠবে— এটা দেখতে পাননি, তা কখনও হতে পারে? লিখছেন সুকুমার দাস।ভবিষ্যৎদ্রষ্টা রবীন্দ্রনাথ কালের ভবিতব্যতা নিয়ে তাঁর সাহিত্যকৃতিতে এত প্রকাশ করেছেন, আর তাঁর বিদ্যালয় যে এক দিন বিশাল মহীরুহ হয়ে উঠবে— এটা দেখতে পাননি, তা কখনও হতে পারে?

Advertisement
শেষ আপডেট: ০১ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ ০১:৩৭
Share:

স্মৃতি: গোড়ার দিকে ব্রহ্ম বিদ্যালয়। ছবি সৌজন্যে রবীন্দ্রভবন

মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন আমৃত্যু ধর্মভাবনায় আবিষ্ট, ব্রহ্মচিন্তায় মগ্ন। প্রথম জীবনে জমিদারিতে মন দিতে পারেননি। পরে পরিবারের গ্রাসাচ্ছদনের কথা ভেবে ঋণভারে জর্জরিত হয়েও তা রক্ষা করেন। দ্বারকানাথ নিজ বুদ্ধি এবং কর্মবলে একই সঙ্গে বহুমুখী ব্যবসা-বাণিজ্যে প্রভূত ভূ-সম্পত্তি আর বিপুল ঐশ্বর্যের অধিকারী হয়েছিলেন। উত্তরাধিকারসূত্রে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পিতা ও পিতামহের থেকে দুটি মহৎ গুণ অর্জন করেছিলেন। যদি মহর্ষির কাছ থেকে পেয়ে থাকেন আধ্যাত্মিক মুক্তির সাধনা, তবে দ্বারকানাথ থেকে পেয়েছিলেন একটি নীতি— কর্মের জয় অনিবার্য। বিশ্বভারতী গঠনপর্বে এই দুটি ছিল তাঁর একান্ত মূলধন। রবীন্দ্রনাথ নিজে এ কথা না বললেও বহু ঘটনা তার সাক্ষ্য বহন করে। দৈনন্দিনের আনন্দবাদ রবীন্দ্র–জীবন-দর্শনে এই দুইয়েরই অপরূপ সমন্বয় বললেও অত্যুক্তি হবে না।

Advertisement

মহর্ষি সন্ধান করেছিলেন বিচিত্র বিশ্বের মধ্যে বিশ্বাতীত এককে। যৌবন থেকে বার্ধক্যে হিমালয়ের শিখরে অথবা ধ্যানী যোগীদের তীর্থক্ষেত্রে তাঁর জীবনের কত স্তব্ধ দিন কেটেছে! সন্ধান করেছিলেন বিশ্বাতীতের ধ্যান করার একটি নিরালা স্থান। পিতার অমূল্য সান্নিধ্য রবীন্দ্রনাথকেও উজ্জীবিত করে। পরিণত বয়সে ‘আত্মপরিচয়ে’ বলেছিলেন, ‘আবাল্যকাল উপনিষদ আবৃত্তি করতে করতে আমার মন বিশ্বব্যাপী পরিপূর্ণতাকে অন্তরদৃষ্টিতে মানতে অভ্যাস করেছে।’(১)

বুঝতে পারি, পিতা-পুত্রের গন্তব্য প্রায় এক। কিন্তু রবীন্দ্রনাথে তার ব্যাপ্তি বহুধা বিস্তৃত। পিতার মাধ্যম ছিল ভক্তি আর পুত্র হলেন একই সঙ্গে কবি, কর্মী আর সাধক। অর্থাৎ একাধারে জ্ঞান কর্ম আর ভক্তির অভূতপূর্ব সমন্বয়। পাখি যেমন দিনের শেষে সন্ধ্যায় একটি নীড় খোঁজে, তেমনি মহর্ষিও জীবন সায়াহ্নে পেয়েছিলেন সেই নিস্তব্ধ আশ্রয়— শান্তিনিকেতন। পাতলেন ধ্যানের আসন। গড়লেন ধর্মসাধনার মন্দির। তৈরি হ’ল আশ্রম। আর পুত্র সেই দেউলের চারদিকের আশ্রমকে বেষ্টন করে আরম্ভ করলেন তপোবনের আদর্শে শিক্ষা। রচনা করলেন বিশ্ববিদ্যার তীর্থপ্রাঙ্গণ— বিশ্বভারতী।

Advertisement

১৯১৩ সাল। রবীন্দ্রনাথের জীবনে এক অন্য বাঁক, বলা যায় এক নতুন অধ্যায়। বিশ্বাতীতের সাধনা তাঁকে বিশ্ববোধের দিকে ধাবিত করে তুলেছিল। ব্রহ্মবিদ্যালয়ে তখন মরাঠা ছাত্র আশ্রয় নিচ্ছে। প্রবাস থেকে অনেক অতিথি অভ্যাগতেরা শান্তিনিকেতনে আসছেন। তাঁদেরকে যথার্থ সেবা দিয়ে আপ্যায়ন করা হচ্ছে— খবর পাচ্ছেন বিদেশের মাটিতে বসে। আনন্দে মন ব্যাকুল হয়ে উঠছে। সন্তোষচন্দ্রকে লিখছেন আবেগ ভরে, ‘আমি দূরে এসে আমাদের বিদ্যালয়ের আনন্দচ্ছবি আরো যেন নিবিড় করে দেখতে পাচ্ছি। যতদিন দিন যাচ্ছে ওখানে মধু জমে উঠবে ... দেড়শো দুশো ছেলের প্রাণের আনন্দ প্রতিদিন নানাভাবে ওখানকার (শান্তিনিকেতনের) বাতাসের সঙ্গে মাটির সঙ্গে গাছপালার সঙ্গে মিশিয়ে যাচ্ছে— ওখানে একটি অদৃশ্য আনন্দনিকেতন সৃষ্টি করে চলেছে ...।’(২)

বিদ্যালয় থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাবনা রবীন্দ্রনাথের মনে ঠিক এই সময় থেকে জাগতে শুরু করে। এক দিকে বিদেশ-ভ্রমণে লব্ধ অভিজ্ঞতার প্রয়োগ, অন্য দিকে, আশ্রম-বিদ্যালয়কে উন্নততর করে গড়ে তোলার নিরলস প্রয়াস— তাঁর ভাবনাকে রূপ দানে একটা তাগিদ তৈরি করছে। সেই তাগিদ প্রকাশ করে ফেলছেন জগদানন্দ রায়কে লেখা চিঠিতে। কেমব্রিজের ফেলটন হলে বসে লিখলেন, ‘ওখানে (শান্তিনিকেতনে) একটি টেকনিক্যাল বিভাগ স্থাপন করা, দুই একটি ল্যাবরেটরি পত্তন করা, পাকশালার সংস্কার এবং হাসপাতালের প্রসারসাধন খুব দরকার বলে মনে করি। আমার ইচ্ছা ওখানে দুই একজন যোগ্য লোক এক একটি ল্যাবরেটরি নিয়ে যদি নিজের মনে পরীক্ষার কাজে প্রবৃত্ত হন তা হোলে ক্রমশঃ আপনিই বিশ্ববিদ্যালয়ের সৃষ্টি হবে। ... এইটেই আমার অনেকদিনের সঙ্কল্প— ওখানে (শান্তিনিকেতনে) জ্ঞানানুশীলনের একটা হাওয়া বইয়ে দেওয়া চাই।’(৩)

‘গীতাঞ্জলি’র অনুবাদ বিদেশে সমাদৃত হচ্ছে। বহু গুণী-মানুষের সাহচর্য তাঁর প্রতিভাকে স্ফুরিত করে তুলছে। নোবেল পুরস্কার শুধু সময়ের অপেক্ষা। রবীন্দ্রনাথ কিন্তু দেশের বাইরে থেকেও ক্রমাগত নানা ধরনের উপদেশ আর পরামর্শ দিয়ে চলেছেন তাঁর বিদ্যালয়ের জন্য। বলছেন, প্রতিদিনের সঙ্কীর্ণতার দ্বারা ধ্যানদৃষ্টি যেন আবৃত না হয়, বাধা-বিরুদ্ধতাকে কেউ যেন বড় করে না দেখে। মানুষকে শ্রদ্ধা করাই বড় সেবা। ছেলেদের চিত্তকে এই শ্রদ্ধার দ্বারা জাগ্রত করতে হবে। বড়লোকের সন্তানেরা বেশি দামি খেলনা পায় বলে তাদের খেলায় যথার্থ সুখ থাকে না ইত্যাদি। বোঝা যায় তাঁর মন পড়ে আছে শান্তিনিকেতনে। মনোরঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়কেও তখন রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন যে, শান্তিনিকেতন বিদ্যালয় কেবলমাত্র বোলপুরের মাঠে অবস্থিত নয়, তাঁদের প্রত্যেকের জীবনের মধ্যেই তার প্রতিষ্ঠা হওয়া চাই। অর্থাৎ তিনি বোঝাতে চাইছেন, এখন এই বিদ্যালয়কে ছোট দেখালেও, সকলের জীবনের মধ্যেই তার জীবন আছে— তাই কখন এক দিন হঠাৎ করে বড় হয়ে উঠবে— কেউ বুঝতে পারবে না।

ভবিষ্যৎদ্রষ্টা রবীন্দ্রনাথ কালের ভবিতব্যতা নিয়ে তাঁর সাহিত্যকৃতিতে এত প্রকাশ করেছেন, আর তাঁর বিদ্যালয় যে এক দিন বিশাল মহীরুহ হয়ে উঠবে— এটা দেখতে পাননি, তা কখনও হতে পারে? এর পক্ষে আরও একটি যুক্তি দেওয়া যাক। তাঁর ওই অব্যক্ত মর্মকথা জানিয়ে অজিতকুমার চক্রবর্তীকে কবি লিখলেন, ‘... যখন থেকে বিদ্যালয়কে নিজের জীবনের ভিতর থেকে দেখতে আরম্ভ করলুম তখন থেকে তার সত্যকে উপলব্ধি করতে লাগলুম— সেই সত্যের স্বরূপ শান্তম্ শিবম্ অদ্বৈতম্। সে অবিচলিত, সে আপনাতে আপনি পূর্ণ ...।’(৪)

পাশাপাশি আর একটি চিঠি, দু’টিই ১৯১৩-র মার্চে লেখা— ‘...এখন সময় এসেছে যখন যোগের জন্য সাধনা করতে হবে। আমাদের বিদ্যালয়ে আমরা কি সেই যুগসাধনার প্রবর্তন করতে পারব না? মনুষ্যত্বকে বিশ্বের সঙ্গে যোগযুক্ত করে তার আদর্শ কি আমরা পৃথিবীর সামনে ধরব না?’(৫) আমরা অন্বেষণ করি, হয়তো নিঃসংশয়ও হতে পারি, বাল্য-শৈশব থেকে শেখা উপনিষদের বাণীর সঙ্গে এই বোধের কত সাযুজ্য! ঠিক একই ভাবে খুঁজে দেখলে হয়তো বিফল হব না, পরিণত বয়সে লেখা ‘আত্মপরিচয়ে’ এই সাজুয্যের প্রতিধ্বনি কতটা! ‘...আজ সত্তর বছর বয়সে সাধারণের কাছে আমার একটা পরিণামে এসেছে।... চরাচরকে বেষ্টন করে অনাদিকালের যে অনাহত বাণী অনন্তকালের অভিমুখে ধ্বনিত তাতে আমার মনপ্রাণ সাড়া দিয়েছে। মনে হয়েছে যুগে যুগে এই বিশ্ববাণী শুনে এলুম।’(৬)

লেখক গবেষক এবং বিশ্বভারতীর রবীন্দ্রভবন গ্রন্থাগার কর্মী (বন্ধনীতে উদ্ধৃতি ও তার বানান অপরিবর্তিত, মতামত নিজস্ব)

তথ্যসূত্র:

(১) রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, আত্মপরিচয়, বিশ্বভারতী, কলকাতা, ১৯৬১, পৃ. ৭৮।

(২)গৌরচন্দ্র সাহা সং, চিঠিপত্রে বিদ্যালয় প্রসঙ্গ, বিশ্বভারতী, রবীন্দ্রভবন, ১৪০৭, পৃ. ৮৫।

(৩) সুবিমল মিশ্র সম্পা., শান্তিনিকেতন ব্রহ্মবিদ্যালয় : জগদানন্দ ও রবীন্দ্রনাথ, দে বুক স্টোর, কলকাতা, ২০১৪, পৃ. ৪৩।

(৪) রুদ্রপ্রসাদ চক্রবর্তী সম্পা., ভক্ত ও কবি: অজিতকুমার চক্রবর্তী— রবীন্দ্রনাথ পত্রবিনিময়, পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি, কলকাতা, ২০০৭, পৃ. ১৪৫।

(৫) গৌরচন্দ্র সাহা সং, চিঠিপত্রে বিদ্যালয় প্রসঙ্গ, বিশ্বভারতী, রবীন্দ্রভবন, ১৪০৭, পৃ. ৯২।

(৬) রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, আত্মপরিচয়, বিশ্বভারতী, কলকাতা, ১৯৬১, পৃ. ৯২-৯৩।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন