২০১৯ আসছে, তাই কাশ্মীরে পেশিশক্তির বোধন

চুপ, কোনও প্রতিবাদ নয়

এ হেন অভিযোগের পিছনে যুক্তি বিশদ ও দৃঢ়। প্রথমেই এসেছে ২০১৬ সাল থেকে ভারতীয় সেনার পেলেট বন্দুকের বিপুল ব্যবহারের কথা।

Advertisement

সেমন্তী ঘোষ

শেষ আপডেট: ২২ জুন ২০১৮ ০০:২২
Share:

অতীত: প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এবং জম্মু ও কাশ্মীরের মুখ্যমন্ত্রী মেহবুবা মুফতি। জম্মু, ২ এপ্রিল ২০১৭। ছবি: পিটিআই

জ‌ম্মু ও কাশ্মীরে যে দিন পিডিপি-বিজেপি সরকার ভেঙে দিয়ে রাজ্যপালের শাসন ঘোষণা করা হল, বিজেপির জেনারেল সেক্রেটারি রাম মাধব যে দিন ঘোষণা করলেন যে পিডিপি-র সঙ্গে এক সরকারে থাকা কঠিন, কারণ উপত্যকা জুড়ে জঙ্গি উপদ্রবের মধ্যেও পিডিপি নেত্রী মুখ্যমন্ত্রী মেহবুবা মুফতি বিজেপিকে কেবলই সামরিক ‘পেশিশক্তি’ নিয়ন্ত্রণে রাখার কথা বলেন— তার ঠিক পাঁচ দিন আগে প্রকাশিত হয়েছে রাষ্ট্রপুঞ্জের মানবাধিকার কমিশনের সেই অভূতপূর্ব রিপোর্ট (১৪ জুন)। কাশ্মীরে যথেচ্ছ মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য ভারত সরকারের প্রবল সমালোচনা রিপোর্টে টগবগ করছে। সত্যিই রিপোর্টটি অভূতপূর্ব, রাষ্ট্রপুঞ্জ থেকে কাশ্মীর বিষয়ে এই ধরনের নথি আগে কখনও বার হয়নি। ৪৯ পাতার রিপোর্টের সারাৎসারটি তত কিছু নতুন নয়: গত সাত দশক ধরে কাশ্মীর উপত্যকা জুড়ে একাধিক প্রজন্মের জীবন দুর্বিষহ সঙ্কটাপন্ন হয়ে আছে— ভারত ও পাকিস্তানের উচিত আর একটুও দেরি না করে এর সমাধান করা— এই সব। নতুন কথাটা বরং এই রিপোর্টের কেন্দ্রীয় বক্তব্যে, যাকে বলে ‘ফোকাস’। সেখানে বলা হচ্ছে, ২০১৬ সালের জুন মাস থেকে ২০১৮ সালের এপ্রিলের মধ্যে কাশ্মীর উপত্যকায় যা যা ঘটেছে, তার জন্য প্রত্যক্ষ ভাবে দায়ী— ভারতীয় সেনাবাহিনী!

Advertisement

এ হেন অভিযোগের পিছনে যুক্তি বিশদ ও দৃঢ়। প্রথমেই এসেছে ২০১৬ সাল থেকে ভারতীয় সেনার পেলেট বন্দুকের বিপুল ব্যবহারের কথা। নাগরিকের উপর এই ধারাবাহিক শারীরিক আক্রমণ, যা পঙ্গুত্ব ও মৃত্যু পর্যন্ত নিয়ে যেতে পারে। আন্তর্জাতিক আইনে এটা সম্পূর্ণত অসিদ্ধ। রিপোর্ট বলছে, ২০১৬-র জুলাই থেকে ২০১৭-র অগস্ট পর্যন্ত ছররা বন্দুকের নিশানায় নিহত ১৭ জন, আর আহত প্রায় সাড়ে ছয় হাজার, সকলেই ‘সিভিলিয়ান’। এই সাড়ে ছয় হাজারের মধ্যে এক বিরাট সংখ্যক মানুষ আঘাতের চোটে স্থায়ী অন্ধত্বে উপনীত।

দ্বিতীয়ত, কাশ্মীরে কোনও নাগরিকের পক্ষে কোথাও অভিযোগ জানানো অসম্ভব। কেননা আফস্পা বা ‘আর্মড ফোর্সেস (জম্মু অ্যান্ড কাশ্মীর) স্পেশাল পাওয়ার্স অ্যাক্ট ১৯৯০’ এবং ‘জম্মু অ্যান্ড কাশ্মীর পাবলিক সেফটি অ্যাক্ট’-এর মাধ্যমে এমন ব্যবস্থা তৈরি করা হয়েছে, যাতে মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে অভিযোগ নিয়ে কেউ কোথাও বিচারের জন্য এগোতে না পারে। অর্থাৎ আইনের স্বাভাবিক সুরক্ষা বলতে সেখানে কিছু নেই। (যৌন নিগ্রহের বিরুদ্ধে সুরক্ষাও এর মধ্যে পড়ে।) উল্টো দিকে, সেনাবাহিনীর কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলা অসম্ভব, কারণ তাদের আছে ‘টোটাল ইমপিউনিটি’, আইনের চোখে সম্পূর্ণ ছাড়।

Advertisement

তৃতীয়ত, জঙ্গি কার্যক্রম বলতে কাশ্মীরে সরকার যা বোঝাতে চায়, তাতে ‘জঙ্গি’ শব্দটা বড্ড বেশি আলগা ও বিস্তৃত ভাবে ব্যবহৃত: ‘ভেরি ব্রড ডেফিনিশন অব টেররিজ়ম’। এর সূত্রেই জঙ্গি দমনের নামে নাগরিক পীড়ন চলতে থাকে। রাষ্ট্রপুঞ্জের উপদেশ: ভারতকে (এবং পাকিস্তানকে) আন্তর্জাতিক নিয়ম মেনে ‘ম্যাক্সিমাম রিস্ট্রেন্ট’ বা যথাসম্ভব সংযম প্রয়োগ করতে হবে।

ভারতের প্রতিক্রিয়া? দিল্লি থেকে ইতিমধ্যেই সজোর প্রতিবাদ: রিপোর্ট পুরোপুরি ‘মিথ্যে’! এই প্রতিক্রিয়া অপ্রত্যাশিত নয়। আন্তর্জাতিক মঞ্চ থেকে ভারত সরকারকে কাশ্মীর বিষয়ে এত কটু ভর্ৎসনা আগে শুনতে হয়নি। তাও আবার এমন এক সময়কাল সম্পর্কে, যে সময়টা নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের নিজের বক্তব্য সম্পূর্ণ উল্টো: জঙ্গি আক্রমণে বিধ্বস্ত উপত্যকায় পিডিপি-র ‘দৌরাত্ম্যে’ ভালমতো ‘পেশিশক্তি’ দেখানো যায়নি বলে জঙ্গিদেরও নাকি যথেষ্ট ‘ট্যাকল’ করা যায়নি। এই প্রেক্ষিতে রাজ্যপালের শাসন জারির অর্থ ধরে নেওয়া যায়, কেন্দ্রীয় শাসন পোক্ত করে সেনাবাহিনীকে ‘পেশিশক্তি’ দেখানোর উদার বন্দোবস্ত হল এ বার। ধরে নেওয়ার দরকার কী— সিদ্ধান্তই টানা যেতে পারে, না হলে আর রাজ্যপালের শাসন জারি হওয়ামাত্র রাজ্যপাল এন এন বোহরা ‘টপ কপ’ বিজয় কুমারকে উপদেষ্টা করে কাশ্মীরে নিয়ে এলেন কেন? এই বিজয় কুমারই বীরাপ্পনকে মেরেছিলেন, এ বার তিনিই কাশ্মীরে খেল দেখাবেন, এইটাই তো আশা?— নাগরিকদের উপর অত্যাচার ইত্যাদি প্রসঙ্গ? এ সব প্রসঙ্গ উঠতেই পারে না, কেননা সেনাবাহিনী যাদের ‘মোকাবিলা’ করছে, বিজেপি জানে— রাম মাধব বলেছেন, সেনাপ্রধান বিপিন রাবত বলেছেন— তারা সক্কলে পাকিস্তানি কিংবা পাকিস্তান সমর্থক। অর্থাৎ, বিক্ষোভকারী মানেই পাকিস্তানি, আর পাকিস্তানি হলেই বুলেট বা পেলেট!

রাম মাধবের একটি সাক্ষাৎকারে (দ্য টেলিগ্রাফ, ৯ এপ্রিল ২০১৭) পড়ছি, আজ যা বলছেন সেই একই কথা। হ্যাঁ, স্থানীয় মানুষ অশান্ত ঠিকই, কিন্তু সেটা তো পাকিস্তানি প্রচারের কারণে। ওদের জব্দ করাটাই পথ। জব্দ করার পথটা তো চেনা, কেবল সে পথটা কার্যকর হতে গেলে পুরোপুরি নিষ্ঠুর হওয়া চাই, ‘উইথ আটমোস্ট হার্শনেস’।

সেখানকার সাধারণ মানুষ কি সত্যিই পাকিস্তান প্রচারে বিপথগামী? সেনার অত্যাচারের মাত্রাটাই কি তাদের ‘বিপথগামী’ করেছে? সেই অত্যাচার না থাকলেও কি তারা প্রচারে ভুলত? সেই অত্যাচার কমলে কি তারা অমন প্রচার থেকে মুখ ঘুরিয়ে নেবে? এই সব প্রশ্নের উত্তর মেলে না, মিলবেও না। কেননা সেনা-অত্যাচার-মুক্ত একটা কাশ্মীরকে আর কখনও পাওয়া যাবে কি না, গত তিন বছরে মোদী সরকার সেই সম্ভাবনা ধাপে ধাপে কমিয়ে এখন একটা বৃহৎ শূন্যে নিয়ে এসেেছ! শুধু এইটুকু বলব, বিভিন্ন রিপোর্টে স্থানীয় মানুষের প্রতিক্রিয়া এই রকম: আগে গ্রামের দিকে সেনা আসছে শুনে তাঁরা ভয়ে লুকিয়ে পড়তেন, এখন সকলে মিলে সামনের দিকে ছুটতে থাকেন, সেনাবাহিনীকে জান দিয়ে ঠেকানোর জন্য। আগে জঙ্গিদের কবর দেওয়ার সময় সামান্য কিছু লোক জড়ো হতেন, এখন উজাড় করে ভিড় জমে। (সদ্য-নিহত শুজাত বুখারি লিখেছিলেন, ‘ফিউনেরাল প্রসেশন’গুলো মানুষকে ঠেলে দিচ্ছে জঙ্গিদের প্রতি সমব্যথার দিকে, কেননা সাধারণ ঘরের ছেলেরাই আজ বুলেটের টার্গেট।) ইতিহাস বলে, অত্যাচারে দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেলেই সমাজে এমন চরম মনোভাবের বিস্তার ঘটে। রাম মাধব ঠিকই বলছেন, কাশ্মীর সঙ্কট নতুন নয়, অনেক দিনের। কিন্তু তিনি যেটা বলছেন না, তা হল, কেন মাঝে কয়েক বছর তুলনায় শান্ত থাকার পর গত তিন বছরেই সাধারণ নাগরিকের চরমের দিকে আকর্ষণ এ ভাবে বাড়ল। প্রসঙ্গত সদ্য-প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী মেহবুবা মুফতির বিদায়কালীন মন্তব্যটাও মনে করে নিতে পারি: ‘হিলিং টাচ’ নীতিই আমাদের অ্যাজেন্ডা (ছিল), জম্মু ও কাশ্মীরকে আমরা ভারতের শত্রুভূমি বলে ভাবতে পারি না।

‘হিলিং টাচ’ বলতে কী বোঝাত পিডিপি, সেটা আজ একটু স্মরণ করে নেওয়া ভাল, কেননা স্থানীয় কাশ্মীরি মুসলিম সমাজের অন্যতম জরুরি প্রতিনিধি এই দলটির বক্তব্য ও নীতি প্রথম থেকেই রাজ্য বিজেপি ও কেন্দ্রীয় বিজেপির দৌলতে কার্পেটের তলায় মুখ লুকাতে বাধ্য হয়েছে। না, জঙ্গিদের ‘শুশ্রূষা’ নয়। জঙ্গিদের খতম করার (‘এলিমিনেটিং মিলিট্যান্টস’) পাশাপাশি সিভিলিয়ান সমাজের জন্য এই ‘নিরাময়ের স্পর্শ’ জরুরি, বলেছিল তাদের নীতি। ‘হিলিং টাচ’-এর মধ্যে প্রথমেই আসে নাগরিক অধিকারের সুরক্ষা। গত বছরের শেষে এক সাক্ষাৎকারে মেহবুবা মুফতি একটা নির্দিষ্ট উদাহরণও দিয়েছিলেন। বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতা মাসারাত আলমকে গ্রেফতারের পর উপত্যকায় বিক্ষোভ-বিদ্রোহের বান ডাকে। তখন প্রশ্ন উঠেছিল, তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগটা ঠিক কী? বিচ্ছিন্নতাবাদী বলেই তো তিনি জঙ্গি নন? ভারতের বিরুদ্ধে স্লোগান দিয়েছেন, কিন্তু বন্দুক তো হাতে তোলেননি? এই প্রসঙ্গে মুফতির মন্তব্য ছিল: এমনও তো হতে পারে যে কাল আলম গেলেন আদালতে বিচার চাইতে। হতে পারে, সুপ্রিম কোর্টও বলল ওঁকে ছেড়ে দিতে। কিন্তু আমরা তো ওঁকে আটকে রেখে বিচার চাইতেই দিচ্ছি না! আমাদের কাশ্মীর তো গণতান্ত্রিক ভারতের অংশ, সেখানে কি গণতন্ত্র বলে কিছুই নেই?

ইউএনএইচআরসি রিপোর্টই যাঁরা ‘মিথ্যে’ বলে উড়িয়ে দেন, কাশ্মীরি নেত্রীর এ সব কথা তাঁদের কাছে মিথ্যে জঞ্জাল মাত্র। কিন্তু আসল মিথ্যেটা অন্যত্র। ‘পুরোপুরি নিষ্ঠুর’ ভাবে নাগরিক অধিকার দমনে যাঁরা আমূল বিশ্বাসী, তাঁরাই আবার শুজাত- হত্যার পর ঘোষণা করলেন: ওঃ, এই ভাবে ‘নাগরিকের গণতান্ত্রিক অধিকার ও বাকস্বাধীনতার হরণ’ তাঁরা সহ্য করতে পারছেন না, এ বার কিছু একটা করা দরকার। ‘কিছু একটা’ মানে রাষ্ট্রপতির শাসন— কাশ্মীরকে সরাসরি দিল্লির মুঠোয় আনা।

আসলে, ২০১৫ সাল থেকে বিজেপি সমানেই যেখানে চলে আসতে চাইছে, অনেক দিনের প্রচেষ্টার পর আজ সেই বিন্দুটাতে পৌঁছনো গেল। পৌঁছতেই যে হত। দিন আগত ওই, ২০১৯ সাল উঁকি মারছে, আর বিলম্ব নয়, ভারত জুড়ে এখনই জাতীয়তাবাদের বান বওয়ানো দরকার। রাম মাধব যতই বলুন দেশের স্বার্থেই না এত সব কিছু করা— সত্যিটা চার দিকে ঝনঝন করে বাজছে— ভোটের স্বার্থে পাকিস্তান ও কাশ্মীর শব্দ দুটো এখনই ময়দানে নামিয়ে দেওয়া দরকার ছিল। উল্টো দিকে, জঙ্গিরা তো আছেই, তারা হামলা চালিয়ে চালিয়ে বিজেপির ভয়-কৌশলটাকে জোরদার করে যাবে। আর, মাঝখান থেকে নিহত-আহত-অন্ধ-প্রহৃত-ধর্ষিত কাশ্মীরি শিশুনারীপুরুষে উপত্যকা ছেয়ে যাবে। চুপ, শব্দ কোরো না, জাতীয়তাবাদ আর জঙ্গিবাদের যুদ্ধ চলছে, আর সব ‘মিথ্যে’!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন