একটু আগেও তো ছোট্ট প্রাণটা ধুকপুক করছিল, খাটের ওপর চনমন করছিল ওর জীবন। এর মধ্যে এমন কী হয়ে গেল যে বাচ্চাটা আর চোখই খুলল না! মা-বাবা তো এ প্রশ্ন করবেনই ডাক্তারকে, কর্তৃপক্ষকে। তাঁরা তো ভরসা করে হাসপাতালের হাতে সন্তানকে তুলে দিয়েছিলেন। হাসপাতাল মুখ ফিরিয়ে নিলে, কী কারণে এমন হল সেটা না বুঝিয়ে বললে, ক্ষোভ ফুটে ও ফেটে বেরোবেই।
আমরা সাধারণ লোক। আমরা জানতে চাইবই, সাধারণ বুদ্ধি দিয়ে, হৃদয়-নিংড়োনো যন্ত্রণা নিয়ে। প্রিয়জনের চলে যাওয়াটা আমাদেরই সইতে হবে প্রতি পলে, জীবনের প্রতিটি খাঁজে, হাসপাতালকে নয়। হাসপাতালের কাছে তো সে ‘আরও এক জন পেশেন্ট’। সেটা দোষের কিছু নয়। এ ভাবেই তো তৈরি পুরো গঠনটা। কিন্তু তার মধ্যে কি একটু মমতা, একটু মায়া থাকতে পারে না? ভুল সবারই হতে পারে, ডাক্তাররাও মানুষ, নার্সরাও মানুষ। হাসপাতাল, ডাক্তার, নার্সদের ক্ষেত্রে এ ভুল কোনও সাধারণ ভুল নয়, এখানে কেয়ারলেস মিসটেক-এর জায়গা নেই। তবু যদি ভুল হয় বা ভুল না হলেও, অনিবার্য কারণে একটা বিপর্যয় ঘটে, সেটাও পরিবার-পরিজনকে বুঝিয়ে বলতে হয়। হাসপাতাল তাঁদের অবজ্ঞা করতে পারে না।
আর, যখন বুকে হাহাকার নিয়ে রোগীর পরিবার প্রশ্ন করে, হয়তো-বা বিক্ষোভ জানায়, তখন অভব্যতা করে তাঁদের হটিয়ে দেওয়াটা অন্যায়। ভুল নয়, অপরাধ। আসলে যাঁরা হাতে ক্ষমতা নিয়ে ও-পারে থাকেন, তাঁরা হয়তো ক্ষমতাহীনের অসহায়তা বোঝেন না, বুঝতে চান না। বিপদে পড়লে, একটা ঘেরাটোপ বানিয়ে নিজেদের দোষ ঝেড়ে ফেলতে তৎপর হন। এটা হয়তো অধিকাংশ মানুষের ক্ষেত্রে সত্য। কিন্তু কয়েকটা জায়গা আছে, যেখানে সাধারণ নিয়ম খাটবে না, কারণ সমাজের চোখে তারা অ-সাধারণ কাজে যুক্ত, যেমন হাসপাতাল, পুলিশ, দমকল।
সুতরাং এই সব প্রতিষ্ঠানের পরিচালক ও কর্মীদের অতিরিক্ত সতর্ক ও সজাগ থাকতেই হবে। মুশকিল হল, অনেক সময়েই এঁরা তা থাকেন না। বহু বড় বড় হাসপাতালেই দেখা যায়, রোগীর পরিজনদের সঙ্গে ঠিক মতো ব্যবহার করার, ঠিক মতো তথ্য সরবরাহ করার না আছে ঠিকঠাক ব্যবস্থা, না আছে ইচ্ছে। সাধারণত ফ্রন্ট ডেস্ক হল রোগীর পরিজনদের সব জানবার, জানাবার জায়গা। তার বাইরে এঁদের এক্তিয়ার নেই কাউকে কিছু জিজ্ঞেস করার। অথচ সেখানে যাঁরা কাজ করেন, তাঁদের কাছে প্রায়শই পুরো তথ্য থাকে না, তার ওপর এক বারের বেশি দু’বার জিজ্ঞেস করতে গেলে তাঁরা বিরক্ত হন। রোগীর পরিজন যেহেতু নরম মাটিতে, অর্ধেক সময় তাঁরা ভয়ে কিছু জিজ্ঞেস করেন না। এমনকী রোগী মারা গেলে, হাসপাতালের লোকজন অনেক সময় মমতা নিয়ে পরিজনের সঙ্গে কথা বলেন না, ঠিক মতো তথ্য দেন না। আর তথ্যের আদানপ্রদানের ফাঁক থেকে, উপরন্তু রূঢ় ব্যবহারের জন্য তৈরি হয় ভয়ানক সব পরিস্থিতি।
হাসপাতালের কর্মীরা বলবেন, ‘এখানে তো রোজই এমন ঘটে, আমরা রোজই কী করে একই রকম ভাবে চাপ সামলে যাব?’ উত্তর হল, সামলাতে হবে, নিজেকে সেই ভাবে তৈরি করতে হবে। এটা দশটা-পাঁচটার রুটিন-বাঁধা কাজ নয়, এখানে তীব্র অনুভূতিগুলো জড়িয়ে থাকে, সব হারাবার ভয় থাকে। এই অনুভূতিকে সম্মান করতে হবে। কিন্তু হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ সেই ভাবে তাঁদের কর্মীদের তৈরি করেন না। বার বার মনে করিয়ে দেন না যে, সহমর্মিতা, মায়া— এটাও তাঁদের কাজ। যদি ভেতর থেকে না আসে, রোজ অভ্যাস করে আয়ত্ত করতে হবে এই নিপুণতা। একটা কথা আছে, ‘ফেক ইট, আনটিল ইউ মেক ইট।’ ভেতর থেকে না চাইলেও অন্যের কথা ভেবে কাজটা করে যেতে হবে। তাতে হয়তো এক সময় তাগিদটা চলে আসবে।
তাই, হাসপাতালকে তৈরি করতে হবে রোগীর পাশে দাঁড়ানোর জন্য প্রয়োজনীয় কাঠামো। কোথায় গেলে ঠিকঠাক খবর পাওয়া যাবে, জানা যাবে চিকিৎসার আদ্যোপান্ত, কী ভুল হয়েছিল বা কোন ওষুধের জন্য রোগীর অবস্থা হঠাৎ খারাপ হল, কেন খারাপ হল— সমস্ত জানাতে হবে। জানালেই কি রোগীর পরিজন বুঝবেন? হয়তো বুঝবেন, হয়তো না। কিন্তু এটুকু নিশ্চয়ই বুঝবেন যে হাসপাতালের পক্ষ থেকে একটা সৎ চেষ্টা ছিল। অভাব সেখানেই।
অথচ গত বছরের মে মাসে ওয়েস্ট বেঙ্গল ক্লিনিক্যাল এস্টাবলিশমেন্ট রেগুলেটরি কমিশন নির্দেশ দিয়েছিল, প্রতিটি হাসপাতালে পাবলিক গ্রিভান্স সেল থাকতে হবে। অভিযোগ এলে অভিযোগকারীকে সে বিষয়ে বিশদ খবরাখবর জানাতে হবে। বিক্ষোভ, অভিযোগ সামলানোর জন্য এক জন পরামর্শদাতা নিয়োগ করতে হবে, যাঁর সঙ্গে সাধারণ মানুষ যোগাযোগ করতে পারবেন। সেই নির্দেশ কার্যত নির্দেশই থেকে গিয়েছে।
খেয়াল করা ভাল, সরকারি হাসপাতালের তুলনায় বেসরকারি হাসপাতালেই যেন সমস্যাটা বেশি করে নজরে পড়ছে ইদানীং। অথচ বেসরকারি হাসপাতালে রোগীর চাপ কম এবং খরচ বেশি। ফলে তাদের পক্ষে পরিকাঠামো তৈরি করা, কর্মীদের ঠিকঠাক ট্রেনিং দেওয়াটা তুলনায় সহজ। প্রয়োজন সদিচ্ছার। সেই সদিচ্ছার প্রয়োগ ঠিক কী কী কারণের ওপর নির্ভর করে, সে কথা কেবল বেসরকারি হাসপাতালের কর্তৃপক্ষরাই বলতে পারবেন। বলার দায়টাও কিন্তু তাঁদেরই।