ধার্মিক: ইয়াসিন পাঠান। এক প্রাচীন মন্দির রক্ষা করেছেন তিনি। মেদিনীপুর, ২০০২
বিবেকানন্দ যখন শিকাগোর ধর্মসভায় বক্তৃতা দিয়েছেন, তখন বলছেন, আমরা শুধু সহিষ্ণুতাতে বিশ্বাস করি তা-ই নয়, আমরা সব ধর্মকে সত্য বলে মনে করি। এ কেবল কথার কথা নয়। সম্রাট অশোকের দ্বাদশ ও ত্রয়োদশ শিলালেখ’তে বলা হচ্ছে, প্রত্যেক জনপদে যেন বিচিত্র ধর্মের অনুষ্ঠান করা হয়, কোনও একটা ধর্মের যেন না করা হয়। নিজের ধর্মের প্রশংসা, আর অপরের ধর্মের নিন্দা করা চলবে না। যে যত বেশি নিজের ধর্মের প্রশংসা করে, তার ধর্ম তত শুকিয়ে যায়। মহাভারতেও বলা হচ্ছে, নিজের বর্গের (শ্রেণি, গোষ্ঠী) প্রশংসা করা চলবে না। এখানে বৌদ্ধ অশোক আর মহাভারত এক। তাঁরা নির্দিষ্ট করে বলছেন, নৈতিক আত্মশ্লাঘা অসহিষ্ণুতার মূল। পরধর্মের নিন্দা চলবে না। যদি সে ধর্মে অসহিষ্ণুতা আছে বলে মনে হয়, তবুও না।
আজ ‘হিন্দুত্ববাদী’ বলে পরিচিতরা যা করছেন, তা এর বিপরীত। অপর সকল ধর্ম, নীতি, খাদ্যাভ্যাস তাঁরা নির্বিচার নস্যাৎ করছেন। এবং ভয় ছড়াচ্ছেন: অন্য ধর্ম বা সম্প্রদায়ের লোকসংখ্যা বেশি হয়ে গেল। ওদের বংশবৃদ্ধির হার বেশি, সম্পদ বেশি, এই অভিযোগ তুলে হিন্দুদের এক করার চেষ্টা করছেন। মহাভারতে এমন ধর্মের হিসেব-কষা লোকদের বলা হয়েছে ‘ধর্মবণিক’, যে ধর্ম বেচে খায়। কার বেশি, কার কম, এটা ধর্মের বিষয় নয়। যে ধর্ম আচরণ করে, সে তা নিয়ে চিন্তা করে না।
ধর্ম রক্ষার জন্যও অপর ধর্মকে আঘাত করা চলে না। ‘ধর্মো রক্ষতি রক্ষিতঃ’ কথাটা আজকাল ভুল ব্যাখ্যা করা হয়। এর অর্থ নিজের জীবনে ধর্ম রক্ষা। ধর্মাচরণ থেকে বিচ্যুত না হওয়া। বিধর্মীর হাত থেকে ধর্মকে রক্ষা করার কথা বলা হয়নি। বিধর্মীদের হাতে কাশ্মীরে ক্ষীরভবানী মন্দির ধূলিসাৎ হয়েছিল শুনে বিবেকানন্দ মনে মনে ভেবেছিলেন, তিনি থাকলে মন্দির রক্ষা করতেন। তখন তিনি শুনলেন, দেবী ভবানী যেন বলছেন, দেবীর ইচ্ছাতেই মন্দির হয়েছিল, তাঁর ইচ্ছাতেই বিধর্মীরা তা ধ্বংস করেছে, ইচ্ছা করলে তিনিই ফের সাততলা সোনার মন্দির গড়তে পারেন। বিবেকানন্দ তাঁকে রক্ষা করার কে? যা থেকে ইঙ্গিত মেলে, প্রকৃত ধার্মিক মন্দির রক্ষার জন্য, নির্মাণের জন্য, হিংসা করবে না। তাতে একটাও হিন্দু মন্দির যদি না থাকে, তা-ও ভাল। নিজের নিজের জীবনে নৈতিক ধর্ম আচরণ করলে ধর্মই তাকে, তার সমাজকে রক্ষা করবে।
তা বলে জৈন বা বৌদ্ধরা যে অর্থে অহিংসাকে ধর্ম বলে গ্রহণ করেছে, বৈদিক হিন্দু ধর্ম তা করেনি। ক্রোধী ব্রাহ্মণ কৌশিককে শিক্ষা নিতে হল ধর্মব্যাধের কাছে। সেখানে মাংসবিক্রেতা কিন্তু মহাজ্ঞানী ধর্মব্যাধ বলছেন, অহিংসা না করে কেউ থাকতে পারে না। তিনি ‘ধর্ম’ বলতে বোঝালেন ‘আনৃশংস্য’। শান্তিপর্বেও যুধিষ্ঠির ভীষ্মকে বলছেন, নৃশংস কে? ভীষ্ম বলছেন, যে সবাইকে ক্ষুধার্ত দেখে নিজে চর্বচোষ্য খায়। অসাম্য সহ্য করাই নৃশংসতা। মহাভারতে ‘ধর্ম’-এর সংজ্ঞা হল, উৎকট অসাম্য সহ্য না করা। সমতাই যোগ। কিন্তু সমতা মানে সব রুচি বা পন্থার বৈচিত্র, বৈশিষ্ট্য লোপ করে ‘ইউনিফর্ম’-এ ফেলে একই ছাঁদে কোটি কোটি লোককে দিয়ে ধর্মধ্বজী কুচকাওয়াজ করানো নয়।
ব্যক্তির ধর্মাচরণ সমাজকে রক্ষা করতে পারে, কারণ ভারতে ‘ধর্মাচরণ’ মানে দিনে কেবল পাঁচ বার প্রার্থনা, প্রাণায়াম বা যোগাভ্যাস নয়। অন্যের প্রতি আমার কী আচরণ হবে, বলে দেয় ধর্ম। পতঞ্জলির যোগসূত্র (সূত্র ১.৩৩) বলছে, ব্যক্তির সন্তোষ ও প্রসন্নতার চারটি উপায়: মৈত্রী, করুণা, মুদিতা এবং উপেক্ষা। সমানের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা নয়, মিত্রতা। দুঃখী, হীনবলের প্রতি তাচ্ছিল্য, উদাসীনতা নয়, করুণা। অধিক সম্পন্নের প্রতি ঈর্ষা নয়, আনন্দিত মনে তার সাফল্যের উদযাপন। এবং নৈতিক দৃষ্টিতে যে হীন, তার প্রতি ঔদাসীন্য। অন্য লোক কতটা দুষ্টচরিত্র তা নিয়ে উদ্বেজিত না হওয়া। তার অপরাধের শাস্তির ভার রাজার, বিচারব্যবস্থার। সেখানে জানালেই যথেষ্ট, শাস্তির দায়িত্ব নেওয়ার দরকার নেই। বুদ্ধদেবও বৈদিক-শ্রমণিক ধারা থেকে এই চারটিকে গ্রহণ করেছেন, তাদের ‘ব্রহ্মবিহার’ বলে অভিহিত করেছেন (দীঘ নিকায়)।
যখন গেরুয়াধারী সাধুরা পলিটিক্সে নেমে পড়েছেন ব্যাপক ভাবে, রাসপুটিনের মতো, ধীরেন্দ্র ব্রহ্মচারীর মতো; যখন ব্র্যান্ড-বেচা যোগী আর ত্যাগের ধ্বজা-ওড়ানো ভোগী গুরুদের সঙ্গে বহুজাতিক বিশ্ববণিকদের আঁতাতে গড়ে-ওঠা পরধর্মদ্বেষী শাসককুলের জিঘাংসু ‘স্বাজাত্যবোধ’-এর ঝড়ে শহর-গ্রামে ভারতের নিম্নবিত্তদের ঘরে-ঘরে নির্লোভ অতিথিপরায়ণ গৃহস্থের সন্ধ্যাপ্রদীপগুলি নিবু নিবু, তখন ‘ধর্মরক্ষা’র মানে নতুন করে ভাবার সময় এসেছে বুঝতে হবে।
সকলের উপর এক খাদ্যাভ্যাস চাপিয়ে, মসজিদ ভেঙে মন্দির বানালে ধর্মরক্ষা হয় না, এমনকী যদি সেই মসজিদ কোনও কালে মন্দির ভেঙেও তৈরি হয়ে থাকে। কেবল নবরাত্রি বা জন্মাষ্টমীতে নয়, প্রতিদিন ঈর্ষা না করা, ইন্দ্রিয়সংযম, কারও মনে আঘাত না দিয়ে সত্য কথা বলা, নিরীশ্বর যোগ মনে-বনে-কোণে অভ্যাস করা অথবা ঈশ্বরের নামকীর্তনের দ্বারা সর্বজীবের কল্যাণ কামনা করলে ধর্মরক্ষা হয়। এই রকম ধর্মকে নিজেদের জীবনচর্যায় বাঁচিয়ে রাখতে গেলে প্রতিবেশী ভিন্নধর্মীর সংস্কৃতি, দর্শন ও ধর্মতত্ত্বের বিষয়ে সাগ্রহে সশ্রদ্ধভাবে জানবার চেষ্টা করা চাই। নিজের ধর্মের ‘পাষণ্ড’দের (সম্রাট অশোকের দ্বাদশ শিলালেখে আত্মপ্রশংসাকারীদের বোঝাতে শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে) অন্যায় ও ত্রুটিগুলির প্রতিবাদ করতে হয়। নিজের জাতি, বর্ণ, শ্রেণি, বর্গকে প্রশংসা করাটা স্বধর্মনিষ্ঠার লক্ষণ নয়। মহাভারতের ভাষায় ‘বর্গপ্রশংসী’ (যারা প্রচার করে বেড়ায় ‘আমার গোষ্ঠী সবার থেকে ভাল’) হল নৃশংস। আর ধর্মের লক্ষণ অনৃশংসতা।
(শেষ)
ইউনিভার্সিটি অব হাওয়াই’তে দর্শনের অধ্যাপক