ছবি: পিটিআই।
চোখের জল লইয়া ভারতীয় সমাজে আবেগ বিস্তর, বিশেষত তাহা যদি পুরুষের চোখে দেখা দেয়। সেই পুরুষ যদি প্রবল পৌরুষের আধার এবং প্রতীক হিসাবে খ্যাত হন, তবে তো আর কোনও কথাই নাই। দেহরাদূনে এক সরকারি অনুষ্ঠানের সহিত ভিডিয়ো-যোগে সংযুক্ত ছিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত এক নারী বলিলেন, তিনি একটি ব্যাধিতে আক্রান্ত, তাহার চিকিৎসা ব্যয়বহুল। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী ভারতীয় জনৌষধি পরিযোজনা নামক প্রকল্পের কল্যাণে তিনি এখন সস্তায় ঔষধ কিনিতেছেন, তাঁহার অনেক সাশ্রয় হইয়াছে। অতঃপর তিনি অশ্রুরুদ্ধ কণ্ঠে জানাইলেন, তিনি কখনও ঈশ্বরকে দেখেন নাই, কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে তাঁহার ঈশ্বরদর্শন ঘটিয়াছে। এবং এই মন্তব্য শুনিবামাত্র প্রধানমন্ত্রীর দুই নয়ন বাষ্পাকুল হইয়া পড়িল। প্রধানমন্ত্রী পুরুষসিংহ হিসাবেই ভক্তসমাজে বন্দিত। বাল্যকালে কুমির ধরিবার কাহিনি হইতে পূর্ণবয়সে ছাতির মাপ— তাঁহার পৌরুষ বহুকীর্তিত। তাঁহার চোখে জল!
দুষ্ট লোকে বলিতেই পারেন, প্রধানমন্ত্রীর এমন আবেগ নূতন দেখা গেল না। ২০১৪ সালে লোকসভায় প্রথম প্রবেশের সময় সংসদ ভবনের সোপানে সেই ঐতিহাসিক প্রণামের পরে সেন্ট্রাল হলের বক্তৃতায় দুই-দুই বার তাঁহার গলা ধরিয়া আসিয়াছিল, গণতন্ত্রের মহিমায় আপ্লুত প্রধানমন্ত্রীর সেই প্রতিমা দেখিয়া এমনকি অনেক পোড়-খাওয়া দর্শকও ভাবিতে চাহিয়াছিলেন— এই অভাবিত রাজ্যাভিষেক বুঝি গুজরাতের নায়কের হৃদয় পরিবর্তন ঘটাইয়াছে! পরবর্তী ইতিহাস সর্বজনবিদিত। কিন্তু সেই প্রসঙ্গ থাকুক। দুষ্ট লোকের সংশয় আপাতত, তর্কের খাতিরে, অগ্রাহ্য হউক। হইতেই পারে, ওই অনুষ্ঠানে যাহা ঘটিয়াছে, তাহার ষোলো আনাই অকৃত্রিম, স্বতঃস্ফূর্ত, স্বাভাবিক। একটি অ-সচ্ছল পরিবারের এক অসুস্থ মহিলা সহসা কাঁদিতে কাঁদিতে ঈশ্বরের সমান বলিয়া বন্দনা করিলে অতি বড় কঠিন হৃদয়ও দ্রবীভূত হইতে পারে, স্বতঃস্ফূর্ত জলীয় বাষ্পে দুই চোখ আচ্ছন্ন হইতেই পারে। নরেন্দ্র মোদীর শরীরও, শেষ অবধি, রক্তমাংসেরই।
কিন্তু প্রশ্ন থাকিয়া যায়। আনন্দ এবং দুঃখ, দুই কারণেই চোখে জল আসে। আনন্দাশ্রু শব্দটি সেই সাধারণ অভিজ্ঞতার বাহক। এই আপাত-বিস্ময়ের সহজ উত্তর আছে বিজ্ঞানের কেতাবে। শারীরবৃত্তের বিচারে চোখের জল যে বিশেষ গ্রন্থির নিঃসরণ, তাহা দুঃখেও সাড়া দেয়, সুখেও। সুতরাং, বিশুদ্ধ বিজ্ঞানের অনুপ্রেরণায় প্রশ্ন উঠিবে: প্রধানমন্ত্রী সে দিন দুঃখে কাঁদিয়াছেন, না আনন্দে? এই প্রশ্নের অন্তরালে ব্যঙ্গ বা কটাক্ষ খুঁজিবার কারণ নাই, মনোবিজ্ঞান বলিয়া দিবে— ওই ঘটনায় সুখানুভূতিও এক অর্থে স্বাভাবিক। ভক্তের আরাধনায় পাষাণও গলিয়া যায়। তদুপরি, ভক্তজনের প্রতি নরেন্দ্র মোদীর হৃদয় উদাসীন, এমন অপবাদ তাঁহার অতি বড় সমালোচকও তাঁহাকে দিতে পারিবেন না। জনসমক্ষে, বিশেষত টেলিভিশনের পর্দায় বহুলপ্রচারিত অনুষ্ঠানে এক জন সাধারণ মানুষ তাঁহাকে ঈশ্বরস্বরূপ বলিয়া বন্দনা করিতেছেন— এই অভিজ্ঞতায় তাঁহার মনে যদি আনন্দ উৎপন্ন হয়, তবে ক্ষুদ্র সংশয় প্রসূত কটাক্ষ বা ব্যঙ্গ না করিয়া ভক্তিভরে বলিতে হইবে: আনন্দং ব্রহ্ম। সমমর্মিতার বেদনায় হউক অথবা ব্রহ্মানন্দের সুখে, নরেন্দ্র মোদীর চোখে জল আসিয়াছে, কম কথা নহে।