সভ্যতার সঙ্কট

ফিরোজ খান বলিয়াছেন, তিনি তো কোনও ধর্মশাস্ত্র পড়াইবেন না, তাঁহার বিষয় সংস্কৃত সাহিত্য।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৩ নভেম্বর ২০১৯ ০০:০৪
Share:

—ফাইল চিত্র।

বেনারস হিন্দু ইউনিভার্সিটির প্রতিটি ভবন পবিত্র গোময় এবং গোমূত্র দ্বারা শোধন করিবার দাবি এখনও উঠে নাই, তবে উঠিলে অবাক হইবার কিছু থাকিবে না। ২০১৯ সালের ভারতে সকলই সম্ভব। এই প্রাচীন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সংস্কৃত বিদ্যা ধর্ম বিজ্ঞান নিকায় নামক বিভাগে সম্প্রতি শিক্ষক নিযুক্ত হইয়াছেন ফিরোজ খান। সংস্কৃতের মেধাবী ছাত্র এবং সফল গবেষক ফিরোজ যোগ্যতা নির্ণায়ক সমস্ত সোপান অতিক্রম করিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার অধিকার অর্জন করিয়াছেন। কিন্তু তাঁহার শিক্ষকতার পথে বাধা হইয়া দাঁড়াইয়াছে মূর্তিমান অশিক্ষা ও অসহিষ্ণুতা। বিভাগটির কতিপয় ছাত্র ধুয়া তুলিয়াছে: ফিরোজ খান ওই বিভাগে শিক্ষকতা করিতে পারিবেন না, কারণ তিনি ধর্মে মুসলমান— এক জন মুসলমান ‘আমাদের ধর্ম ও ভাবনা’ বুঝিতে পারিবেন না। তাহারা উপাচার্যের বাসভবনের সামনে বিক্ষোভ দেখাইয়াছে, তাঁহার গাড়ি লক্ষ্য করিয়া বোতলও নিক্ষিপ্ত হইয়াছে। সনাতন ভারতের পান্ডারা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিতরে ‘হবন কুণ্ড’ বসাইয়া যজ্ঞও করিয়াছে। ম্লেচ্ছসংসর্গে দেবভাষার জাত গিয়াছে না?

Advertisement

ফিরোজ খান বলিয়াছেন, তিনি তো কোনও ধর্মশাস্ত্র পড়াইবেন না, তাঁহার বিষয় সংস্কৃত সাহিত্য। অভিজ্ঞানশকুন্তলম্-এর রসাস্বাদনে বা সাহিত্যবিচারে ধর্মপরিচয়ের প্রাসঙ্গিকতা কোথায়? এই যুক্তি ওই ‘ছাত্র ও গবেষক’দের নিকট অর্থহীন, তাহারা সংস্কৃত বলিতে হিন্দুধর্মের মন্ত্রপাঠ বোঝে ও তাহাদের ধর্মকে অনুক্ষণ ‘বিধর্মী’র স্পর্শদোষ হইতে বাঁচাইয়া রাখিতে হয়— মুসলমানে ছুঁইলেই সেই সনাতন ধর্ম তৎক্ষণাৎ পপাত চ মমার চ। সেই কারণেই ওই মহাপণ্ডিতদের এই কথাও বুঝাইবার কোনও অর্থ নাই যে, ধর্মশাস্ত্রের পঠনপাঠনেও ছাত্র বা শিক্ষকের ধর্মপরিচয় অপ্রাসঙ্গিক। এক ধর্মের মানুষ অন্য ধর্মের চর্চায় কৃতবিদ্য হইয়াছেন এমন দৃষ্টান্ত ইতিহাসে বিস্তর, কিন্তু ধর্মমোহ এবং ধর্মদ্রোহের বিকার যাহাদের গ্রাস করিয়াছে, তাহারা সেই ইতিহাসে কান দিবে কোন দুঃখে? দারাশুকো হইতে মুহম্মদ শহীদুল্লাহ— ধর্মপরিচয়-অতিক্রমী জ্ঞানচর্চার সমৃদ্ধ ঐতিহ্যের কথা শুনাইতে চাহিলে তাহারা বলিবে: বকওয়াস!

প্রশ্ন হইল, ‘আমাদের ধর্ম ও ভাবনা’র স্বনিযুক্ত ঠিকাদারদের গুন্ডামি কর্তৃপক্ষ কঠোর ভাবে দমন করিবে না কেন? ভরসার খবর, বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য-সহ একাধিক কর্তাব্যক্তি বলিয়াছেন, প্রতিবাদীদের অন্যায় দাবি মানিবার প্রশ্নই উঠে না, ফিরোজ খান ওই পদেই থাকিবেন। শিক্ষকের ধর্মীয় পরিচয় লইয়া মাথা ঘামানোর কুশিক্ষা এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহ্যে কখনও স্থান পায় নাই, এখনও পাইবে না। নরেন্দ্র মোদীর দেশে এবং যোগী আদিত্যনাথের রাজ্যে এইটুকুও কম নহে। বিএইচইউ মনে করাইতেছে যে, সব আলো এখনও নির্বাপিত হয় নাই— দেশের নানা স্থানে ধর্মপরিচয়ের বাধা না মানিয়া মানুষ ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি এবং ধর্মশাস্ত্রের চর্চা করিয়া চলিয়াছেন। জীবনে ও মননে বহুত্বের অবাধ সাধনা এখনও চলিতেছে। কিন্তু এই সুসংবাদে সন্তুষ্টির স্থান নাই। ধর্মদ্রোহের কারবারিরা এই সভ্যতাকেই বিনাশ করিতে তৎপর, তাহাদের পিছনে রহিয়াছে রাষ্ট্রক্ষমতার প্রবল প্রশ্রয়। সেই কারণেই ফিরোজ খানের বিড়ম্বনায় নিহিত রহিয়াছে ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক ভারতের সঙ্কট। সভ্যতার সঙ্কট।

Advertisement
(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন