কে বেকার, কে নয়

অনেকে সরকারি চাকরি খোঁজেন নিশ্চয়তার টানে, ফাঁকি দিতেও

গরিবরা বেকার হন না। এই অমোঘ সত্যটি নিয়ে অনেক দিন আগেই অর্থনীতির চত্বরে গবেষণা হয়েছে। বিশেষ করে ভারতের ক্ষেত্রে। খুঁটিনাটির মধ্যে না গিয়েও বলা যায় সেই গবেষণার মূল সিদ্ধান্ত ছিল ওপন আনএমপ্লয়মেন্ট বা যে বেকারত্ব আমাদের চোখের সামনে আসে, যেমন কাজ না পেয়ে মানুষ সর্বক্ষণ কাজ খুঁজে বেড়াচ্ছেন, এমন একটা অবস্থা, সেই মানুষেরা মূলত শিক্ষিত এবং খানিকটা সচ্ছল।

Advertisement

সুগত মারজিৎ

শেষ আপডেট: ০১ নভেম্বর ২০১৮ ০০:৫৩
Share:

অলঙ্করণ তিয়াশা দাস।

অর্থনীতির চত্বরে কর্মসংস্থানের সমস্যা নিয়ে বিস্তর গবেষণা চলে। আর, বাস্তবেও, আমাদের দেশ-সহ সমগ্র বিশ্বের প্রতিটি দেশের সরকার কর্মসংস্থান বাড়াতে বদ্ধপরিকর। সেটাই স্বাভাবিক, এক দিকে দেশের আয় ও মানুষের শ্রীবৃদ্ধি, অন্য দিকে ক্ষমতায় টিকে থাকা— দুই দিক থেকেই কর্মসংস্থানের সাফল্য একটি বিশেষ শর্ত। কিন্তু এই বিষয়ে অনেক সময়েই যে আলোচনা বা শোরগোল হয়, তাতে যুক্তির ভাগ কম থাকে। এই লেখা প্রধানত তা নিয়েই। এখানে মূলত দু’টি বিষয় নিয়ে আমি আলোচনা করব। প্রথমত, প্রায়ই দেখি, অল্পসংখ্যক সরকারি পদে প্রচুর আবেদন জমা পড়লে সেটাকে বেকার সমস্যার একটা পরিচায়ক হিসেবে গণ্য করা হয়। সেটা ঠিক নয়। সমস্যাটা অনেক সময়েই মনের মতো কাজ না পাওয়ার সমস্যা। এই ‘মনের মতো’ কাজের ব্যাপারটা অনেকাংশেই কাজকে অসম্মান বা উপেক্ষা করার মধ্যে নিহিত।

Advertisement

একটা দৃষ্টান্ত দিই। এক জন একটি কোম্পানিতে ভাল কাজ করে, বেশ খানিকটা মাইনে পায়। সে হঠাৎ বিশ্ববিদ্যালয়ে ল্যাব অ্যাসিস্ট্যান্টের চাকরি করার পরীক্ষায় বসল। তার সঙ্গে মাঝে মাঝে কথা হয়। কেন সে চাকরির আবেদন করছে, জিজ্ঞেস করায় বলল, সরকারি চাকরি, তাই পেনশন পাবে। তা ছাড়া, প্রতি দিন যেতে হবে না, দেরি করে গেলেও চলবে, কাজ না করলে চাকরি যাবে না, আর শুনেছে ‘সাইড’-এ টুকটাক কাজ করার সুযোগ থাকবে। সে অকপটে এগুলো আমাকে বলে গেল। একটু খোঁজ নিলেই দেখা যাবে যাঁরা সরকারি চাকরির আবেদন করছেন, তাঁদের মধ্যে অনেকে চাকরি করেন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে, অনেকে আবার স্বরোজগেরে, ছোটখাটো ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত। আবার, যাঁরা কিছুই করেন না তাঁদেরও অনেকেই সরকারি চাকরি ছাড়া কিছু করবেন না বলে মনস্থির করেছেন। তাঁরা মনে করেন কোনও ‘নিম্নতর কাজ’ তাঁদের শোভা পায় না, অন্তত সমাজ তাঁদের সেই শিক্ষাই দিয়েছে।

সে যা-ই হোক, ধরা যাক একশোটি পদের জন্য দশ হাজার মানুষ আবেদন করেছেন। এ বার যদি তাঁদের বলি, পেনশন কিন্তু পাবেন না? বস্তুত পক্ষে কেন্দ্রীয় সরকার এখন সে দিকেই গিয়েছে— নিজেরটা নিজেকেই সঞ্চয় করে ব্যবস্থা করতে হবে, দেশও সে দিকেই যাবে। তা হলেও কি তাঁরা এখনকার চাকরি ছেড়ে রোজগার ছেড়ে বা অংশত ছেড়ে সরকারি চাকরি করতে আসবেন? আসবেন। কারণ সেখানে চাকরি যাওয়ার ঝুঁকি কম। রাষ্ট্র দীর্ঘ কাল ধরে এই মানসিকতাকে সযত্নে লালনপালন করেছে এবং করছে। ওই দশ হাজার জনের সবাই এখন বেকার বলে সরকারি চাকরি করতে দৌড়চ্ছেন না, যাতে বেশি কাজ করতে না হয় সেই আশায় সরকারি চাকরি খুঁজছেন। এই সিদ্ধান্তটি উড়িয়ে দেওয়া যায় না।

Advertisement

আর আমাদের রাজ্যের ইতিহাস এ বিষয়ে আরওই সমৃদ্ধ। তখন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াই। নব্বইয়ের দশকের গোড়ার বা আশির দশকের শেষ ভাগের কথা। এক জনকে নিয়োগ করা হল, যিনি মূলত অধ্যাপকদের গবেষণাপত্র টাইপ করে সাহায্য করবেন। তাঁকে টাইপ করতে অনুরোধ করায় তিনি বলেছিলেন তাঁর বড় ‘সময়াভাব’, তা ছাড়া তিনি টাইপিস্ট হিসেবে চাকরি পেয়েছেন, সেখানে তো বলা নেই তাঁকে গবেষণাপত্রই টাইপ করতে হবে। অবশ্য দুপুর একটার আগে তিনি আসতেন না, ‘সংগঠন’-এর কাজ করতেন। আর অনেক দিন বিকেলে ‘পার্টির মিটিং’ থাকত। সরকারি চাকরি কে চাইবে না, বলুন।

আরও পড়ুন: সরকারি প্রকল্পে বিপুল বরাদ্দে ক্ষুব্ধ মুখ্যমন্ত্রী

তাই বলছি, ওই দশ হাজার সংখ্যাটি কোনও ভাবেই ভারতের বেকার সমস্যা চিহ্নিত করে না। আমাদের পাঠ্যপুস্তকে যা পড়ানো হয়, অর্থাৎ ওই মজুরিতে যত জন কাজ চাইছে আর যত জনকে কাজ দেওয়া যায়, তার ফারাকটাই বেকারত্বের পরিমাপ— এ ক্ষেত্রে এটি একটি ভ্রান্ত ধারণা। আমার অকর্মণ্যতা বা ফাঁকি কোনও ধরনের শাস্তির মুখোমুখি না হওয়ার যে নিশ্চয়তা, সেটা অর্জন করব, এর জন্যই আমি সরকারি চাকরি খুঁজছি। অর্থাৎ ভারতে সরকারি চাকরির আবেদনপত্রের সংখ্যা থেকে কিছুই বোঝা যাবে না।

আরও পড়ুন: আদিবাসী তরুণ-তরুণীদের পুলিশে চাকরির প্রশিক্ষণ

এ বার আর একটা কথায় আসি। গরিবরা বেকার হন না। এই অমোঘ সত্যটি নিয়ে অনেক দিন আগেই অর্থনীতির চত্বরে গবেষণা হয়েছে। বিশেষ করে ভারতের ক্ষেত্রে। খুঁটিনাটির মধ্যে না গিয়েও বলা যায় সেই গবেষণার মূল সিদ্ধান্ত ছিল ওপন আনএমপ্লয়মেন্ট বা যে বেকারত্ব আমাদের চোখের সামনে আসে, যেমন কাজ না পেয়ে মানুষ সর্বক্ষণ কাজ খুঁজে বেড়াচ্ছেন, এমন একটা অবস্থা, সেই মানুষেরা মূলত শিক্ষিত এবং খানিকটা সচ্ছল। অর্থাৎ কাজ না করলে খেতে পাবেন না, এমন নয়। অন্য দিকে গরিব মানুষেরা কাজ না করলে সত্যিই খেতে পাবেন না। না খেতে পেলে মারা যাবেন। এটাই চিরন্তন সত্য। তাই দরিদ্রদের মধ্যে বেকার দেখা যায় না। বেকার সমস্যা বলে সচরাচর যাকে আমরা চিনি, তা আসলে যাঁরা শিক্ষিত এবং যাঁদের বাড়িতে থাকা-খাওয়ার সংস্থান আছে তাঁদের সমস্যা। তাঁরা ‘মনের মতো’ কাজের জন্য অপেক্ষা করতে পারেন।

একটি উদাহরণ দিই। আশির দশক। এক বাঙালি ছাত্র মার্কিন মুলুকে পড়তে গিয়েছে। সীমিত জলপানি পায়। তার এক বন্ধু ভারতের এক বিশাল কোম্পানির মালিকের ছেলে। সে প্রায় কোনও স্কলারশিপই পায় না। বাঙালি ছেলেটি সপ্তাহে কিছু ঘণ্টা একটি চাকরি করত, গ্রীষ্মে বাড়ি আসার বিমান ভাড়া জোগাড় করতে। চাকরিটি ছিল মৃতদেহ মর্গে নিয়ে যাওয়ার চাকরি। আর অন্য ছেলেটি বাবার পাঠানো টিকিটে বাড়ি আসত। মার্কিন মুলুকটিকে যদি শুধু একটি কারণেই কুর্নিশ জানাতে হয়, তা হলে সেটি হবে সেখানে শৈশব থেকেই শ্রমের প্রতি এক ধরনের সামাজিক সম্মান প্রদর্শন করা হয়। মৃতদেহ মর্গে নিয়ে যাওয়ার চাকরিতে লজ্জার বালাই ছিল না। আসলে সমাজটাই অন্য রকম।

ভাল ভাবে বুঝতে হবে কেন বিভিন্ন ধরনের কাজে শ্রমের বাজারে চাহিদা আর জোগানে ফারাক হয়, কোথাও কাজের লোক পাওয়া যায় না আবার কিছু জায়গায় সবাই কাজের জন্য লাইন দেয়। রাজনৈতিক চাপানউতোর আমাদের বোধকে আচ্ছন্ন করে রাখে। শাসক দল ভুলক্রমেও বেকার সমস্যা আসলে কেন হচ্ছে, তা নিয়ে বিশ্লেষণ করে না, খানিকটা জ্ঞানের অভাব, খানিকটা ‘কী বেরিয়ে পড়ে’ সেই ভয়। আর বিরোধী পক্ষ আরও এক কাঠি ওপরে— ঠিক-ভুল কুছ পরোয়া নেই, শুধু প্রতিবাদ আর বিরোধিতা। এ শুধু এ দেশের সমস্যা নয়। তবে এ দেশে সমস্যাটা খুবই প্রবল।

কথায় কথায় আমরা দারিদ্র এবং বেকারত্বের কথা বলি, অথচ কলকাতায় বাড়ির কাজের লোক, জলের মিস্ত্রি, বিদ্যুতের কারিগর পেতে মধ্যবিত্ত জেরবার। কাজের লোকের চাহিদা একটা দরিদ্র দেশে পূরণ হয় না কেন? ভারত তো একটি বিরাট দেশ, সেখানে আঞ্চলিক মজুরির হারে সমতার কী অবস্থা? এ সবই বেকার সমস্যার সঙ্গে যুক্ত।

সবাইকে এমএ/এম এসসি পিএইচ ডি-র সুযোগ দিতে হবে— এই ‘সাম্যবাদী’ ধারণা দেশটাকে উচ্ছন্নে পাঠাচ্ছে। কারিগরি শিক্ষাকে দূরে সরিয়ে রাখা হচ্ছে কারণ সাবেকি শিক্ষার কাছে সে দলিত, অস্পৃশ্য। এমএ/এম এসসি-র শিক্ষা অনেক ক্ষেত্রেই ‘ডেফারড আনএমপ্লয়মেন্ট’ বা প্রলম্বিত বেকারত্বের অবস্থা— সবাইকে অমুক বিষয়ে এমএ পাশ করিয়ে এক দিকে শিক্ষিত বেকারের জোগান বাড়াচ্ছি, অন্য দিকে কাজের অসম্মান করে যে সমাজ, তাকে আরও প্রশ্রয় দিচ্ছি। ‘‘আমি এমএ পাশ করেছি অমুক কাজ কেন করব? লোকে বলবে কী?’’ এ রাজ্যে ‘ব্যবসায়ী’ হবে বললে শিক্ষিত ছেলেমেয়েদের ভর্ৎসনা করা হয়। অত্যন্ত আনন্দের কথা, ইদানীং সে আবহাওয়া কিছুটা পাল্টেছে। স্ব-রোজগেরে ব্যবসায়ী হওয়া ছাড়া এ দেশের বেকার সমস্যা মিটবে না। সরকার বেকার তৈরি করবে, কাজ দিতে পারবে না। এবং অকারণে অযোগ্য উচ্চাশায় বাতাস জোগাবে। আবার অন্য দিকে যোগ্য পেশার সন্ধানও দেবে না— পাছে লোকে কিছু বলে এবং ভোট মার খায়।

পরিশেষে একটা কথা না বলে পারছি না। একটা সময় ছিল যখন গড়িয়াহাট চত্বরে বেশ সচ্ছল অর্থাৎ নিজের বাড়ি আছে, ভাল রোজগার, এমন হকারবন্ধুদের প্রায় সবারই এমপ্লয়মেন্ট এক্সচেঞ্জে বেকার হিসেবে চিহ্নিত করার কার্ড ছিল। যে কোনও সরকারি তথ্যের বিশ্বাসযোগ্যতা সর্বজনবিদিত। ভারতের চেহারাটা অনেকটা পাল্টেছে। মানুষ অনেক সচ্ছল হয়েছে। শ্রমের বাজারও পাল্টেছে। কোন কাজ করব, সেটাও গুরুত্বপূর্ণ। কাজের মাসি তার ছেলে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করলে তাকে মোটর বাইক কিনে দেবে বলেছে। তাই দারিদ্র এবং অবাঞ্ছিত বেকারত্বের সম্পর্কের গল্পকে আরও সময়োপযোগী ও আধুনিক করতে হবে।

সেন্টার ফর স্টাডিজ় ইন সোশ্যাল সায়েন্সেস-এ অর্থনীতির অধ্যাপক

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন