ধ্বংস: ধর্মতলায় দুষ্কৃতীরা গাড়িতে আগুন লাগিয়েছে। দাঙ্গায় আক্রান্ত কলকাতা, ১৯৪৬
কলকাতায় যে দাঙ্গা হয়েছিল ১৯৪৬ সালে, যাকে বলা হয় ‘দ্য গ্রেট ক্যালকাটা কিলিংস,’ তা বাংলা তথা গোটা উপমহাদেশের সাম্প্রদায়িক সম্পর্কের ধারণায় একটা বাঁক এনেছিল বলেই মনে করা হয়। সে বছর ১৬ অগস্ট কলকাতায় হিন্দু-মুসলিমদের মধ্যে হিংসার বিস্ফোরণে যত মানুষ খুন হল, যত সম্পত্তি ধ্বংস হল, অতীতে তার নজির মেলে না। দেশ জুড়ে দাঙ্গার জমি যেন তৈরি হয়ে গেল কলকাতায়, দেশভাগ অবধি এবং তার পরেও যা ক্রমাগত চলেছে। কলকাতার দাঙ্গার পরেই মুসলিম লিগ এবং জাতীয় কংগ্রেসের নেতারা ব্রিটিশের পরিকল্পনায় তড়িঘড়ি সায় দিয়ে দিলেন। মেনে নিলেন যে দেশভাগই ‘একমাত্র’ উত্তর। সেই নিরিখে কলকাতার দাঙ্গা যেমন দেশভাগের হিংসার গোড়াপত্তন, তেমনই দেশভাগের সপক্ষে রাজনৈতিক যুক্তিরও সূচনা।
কলকাতার মানুষের সামগ্রিক স্মৃতিতে গভীর ভাবে গেঁথে গিয়েছে কলকাতার দাঙ্গা। সে সব দিনের স্মৃতি, অনুভব, মনে ছাপ-পড়া ছবি প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে বয়ে চলেছে। পশ্চিমবঙ্গে সাম্প্রদায়িক সম্পর্কের ধারণাকে যা অনেকটাই প্রভাবিত করছে। কিন্তু সামগ্রিক স্মৃতি যে ভাবে দানা বাঁধে, তা ত্রুটিমুক্ত নয়। তাই প্রায়ই দেখা যায় অনেক জটিল, বহুমাত্রিক ঘটনার একটা সহজ, একমাত্রিক কারণ খাড়া হয়ে গিয়েছে। কলকাতার দাঙ্গার ক্ষেত্রেও তা-ই হয়েছে। চল্লিশের দশকের কলকাতা নিয়ে গবেষণার সময়ে আমি এমন অনেক লোকের সঙ্গে কথা বলেছি যাঁরা দাঙ্গা দেখেছেন, কিংবা তাঁদের উত্তরপুরুষ। তাঁরা দাঙ্গার যে ব্যাখ্যা দেন, তা সাধারণত দুটো কারণের চার পাশে ঘোরাফেরা করে। এক, রাজনৈতিক উসকানি; দুই, হিন্দু-মুসলিমদের পরস্পরের প্রতি ঘৃণা। বিশেষত পশ্চিমবঙ্গের হিন্দুরা এই ব্যাখ্যাই নিজেদের শুনিয়ে আসছে।
রাজনৈতিক উসকানির প্রসঙ্গে সবচেয়ে বেশি আঙুল ওঠে হুসেন শহিদ সুরাওয়ার্দির দিকে। অনেকে এমনও বলেন যে সুরাওয়ার্দিই দাঙ্গার রূপকার, তাঁর পরিকল্পনা-মাফিকই প্রায় সব কিছু ঘটেছে। সুরাওয়ার্দি কেন্দ্রে থাকলেও এঁদের নিশানায় থাকে গোটা মুসলিম লিগ। এর উৎস হিন্দু ও মুসলিমদের মধ্যে চরম হিংসাত্মক মনোবৃত্তি। প্রচলিত ধারণা, সুরাওয়ার্দি পুলিশের রাশ টেনে রেখেছিলেন, সেনার সাহায্য চাইতে দেরি করেছিলেন এবং পুলিশ নিয়ন্ত্রণ কক্ষ থেকে তাঁর দুর্বৃত্ত অনুচরদের নির্দেশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। এ ভাবে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষকে যেই সুযোগ দেওয়া হল, অমনি সে তার অন্ধকার আস্তানা থেকে লাফ দিয়ে বেরিয়ে এসে গোটা শহরটাকে গ্রাস করল।
কিন্তু যে সাক্ষ্য আমি নিজে সংগ্রহ করেছি, এবং সে সময়ের নথিপত্রে যা পাওয়া যায়, তা এই দুটি সংকীর্ণ ব্যাখ্যাকে সমর্থন করে না। প্রত্যক্ষদর্শীর স্মৃতি ও সে যুগের নথিপত্র থেকে যে ছবি মেলে, তা সুপরিকল্পিত হিংসার ছবি নয়। তা সম্পূর্ণ অরাজক, বিস্ফোরক এক পরিস্থিতির ছবি, যার গতিপ্রকৃতি আগাগোড়াই ছিল অনিশ্চিত। কখন তা কোন দিকে ঘুরে যাবে, তা বোঝা প্রায় অসম্ভব ছিল। অবাধে লুটতরাজ চলেছিল, যাতে অংশ নিয়েছিল পুলিশ অফিসাররাও। সোনার গয়নার দোকান একেবারে খালি করে সব লুটেপুটে নিয়ে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়েছিল। রেশনের দোকান লুট, গলিতে পিছন থেকে ছুরি মেরে খুন, প্রতিবেশীদের বাঁচাতে পাড়ায় পাড়ায় পিকেট, শহর জুড়ে পর পর অগ্নিকাণ্ড। ফাঁকা শেড খুঁজে জড়ো হত হিংস্র জনতা, হাতের কাছে যা মেলে, তা দিয়ে অস্ত্র বানানো হত। প্রোমোটারদের চক্রান্তে সংখ্যালঘু মধ্যবিত্ত বাড়িগুলিতে নৃশংস হত্যালীলা চলতে থাকে। আক্রমণের প্রতিশোধ নিতে পাল্টা আক্রমণ চলে। সেই সঙ্গে অনবরত ঘুরপাক-খাওয়া গুজব, যা আরও ভয় ছড়াল, আরও হিংসা উসকে দিল, এক চরম পরিণামের আশঙ্কায় সবাইকে অস্থির করে তুলল।
এ কথা সত্য যে বাংলার মুখ্যমন্ত্রী সুরাওয়র্দি দাঙ্গার প্রথম দিন পুলিশ কন্ট্রোল রুমে বসে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ করছিলেন। কিন্তু সে সময়ের নথিপত্র স্পষ্ট করে দেয় যে ১৬ অগস্ট দুপুরের পর থেকেই পরিস্থিতির উপর সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছিল পুলিশ, কারণ তাদের সংখ্যা ছিল প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম। পুলিশ থানাগুলোর উপরেই আক্রমণ শুরু হয়, রাস্তায় রাস্তায় হিংস্র জনতার সঙ্গে পুলিশের খণ্ডযুদ্ধ চলতে থাকে। কলকাতা দ্রুত চলে যায় নিয়ন্ত্রণের বাইরে। ‘ডায়রেক্ট অ্যাকশন’ মিছিল ময়দানে হওয়ার কথা ছিল বিকেল চারটেয়। তার আগেই, বিকেল তিনটের মধ্যে পুলিশ কমিশনার ফোন করে গভর্নরকে অনুরোধ করেন সেনা নামাতে। অনুরোধ খারিজ করা হল। ব্রিগেডিয়ার সিক্সস্মিথ, যিনি সেনা সাহায্য পাঠানোর অনুরোধকে স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত নেন, পরবর্তী কালে বিবৃতি দেন যে তিনি ভয় পেয়েছিলেন, ‘মিলিটারি শক্তির ব্যবহার হয়তো এই দলে দলে আসা জনতার অভিমুখকে ঘুরিয়ে দিতে পারে... আমরা জানতাম ১৬ তারিখের পরিস্থিতি পালটে হয়তো সরকার-বিরোধী দাঙ্গার রূপও নিতে পারে।’
অতএব সুরাওয়ার্দি যে পুলিশকে চেপে রেখেছিলেন, সেনা সহায়তার আবেদনে ইচ্ছে করে বিলম্ব করেছিলেন, এই ধারণা ধোপে টিকছে না। পুলিশ কমিশনার নিজেই বুঝেছিলেন যে পরিস্থিতি পুলিশের আয়ত্তের বাইরে চলে যাচ্ছে। সেনা সহায়তা দিতে অস্বীকার করেছিল ব্রিটিশ, সুরাওয়ার্দি নন। এ-ও স্পষ্ট যে ব্রিটিশরা বুঝেছিল পরিস্থিতি অত্যন্ত অনিশ্চিত, রাস্তায় সেনা নামালে তা ঔপনিবেশিক সরকারের বিরুদ্ধেও বাঁক নিতে পারে। অর্থাৎ সেই প্রথম দিনটিতে হিংসার কোনও নির্দিষ্ট রূপ ছিল না, তা যে কোনও দিকে ঘুরে যেতে পারত। তা ছিল একটা নিয়ন্ত্রণহীন, বিস্ফোরক পরিস্থিতি, সুকৌশলে পরিকল্পিত ঘটনা নয়।
তা হলে কলকাতায় হিংসার যে উন্মত্ততা দেখা দিল, তাকে আমরা কী করে ব্যাখ্যা করব? আমার মনে হয়, তা বুঝতে হলে কলকাতার ইতিহাসকে আর একটু বড় পরিসরে দেখতে হবে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে জনসংখ্যার প্রবল চাপ তৈরি হয় কলকাতার উপর। ১৯৩৯ থেকে ১৯৪৬ সালের মধ্যে কলকাতার জনসংখ্যা প্রায় দ্বিগুণ হয়ে গিয়েছিল। গৃহস্থের বাসস্থানের আকাল দেখা দিল, অল্প জায়গায় প্রচুর লোক চাপাচাপি করে থাকতে বাধ্য হল, ব্রিটিশ এবং মার্কিন সেনারা যুদ্ধের বাজারে সব জিনিসের উপর দখল কায়েম করল। ১৯৪৩ সালের মধ্যে গ্রামে গ্রামে শুরু হয়ে গেল দুর্ভিক্ষ। উপবাসক্লিষ্ট মানুষ দলে দলে গ্রাম থেকে কলকাতা আসতে শুরু করল। শহরের রাস্তায় রাস্তায় তাদের দেহ পড়ে থাকতে দেখল শহরবাসী। সেই চরম কালোবাজারির দিনে সরকারি বাঁধা দামে জিনিস পাচ্ছিলেন কেবল কলকাতার সাবেক বাসিন্দারা, সরকারি খাতায় যাঁদের নাম রয়েছে। কলকাতা তখন বাঁচার একমাত্র আশ্রয়, কোনও মতে শহরের উপর একটু দখল কায়েম করার জন্য হুড়োহুড়ি চলছে। ১৯৪৬ সালের মধ্যে যে পরিস্থিতি তৈরি হল কলকাতায়, তা হিংসার জন্য সম্পূর্ণ প্রস্তুত। গোটা বাংলার মানুষই এক অসহনীয় দশক কাটিয়েছেন তত দিনে। কলকাতার ঘটনাকে বুঝতে গেলে তাদের হিসেবে না ধরলে ভুল হবে।
আমি এ কথা বলছি না যে ছেচল্লিশের দাঙ্গার ব্যাখ্যা খুঁজতে গিয়ে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ বা উসকানিকে সম্পূর্ণ বাদ দেওয়া উচিত। এ দুটোই দাঙ্গার হিংস্রতাকে বাড়িয়েছিল, কিন্তু দাঙ্গাকে বুঝতে হলে কেবল আলাদা করে এ দুটো কারণকে চিহ্নিত করাই যথেষ্ট নয়। আরও নানা বিষয়ের দিকে তাকাতে হবে। যেমন, সেই সময়ের আর্থিক ও সামাজিক কাঠামো, জনসংখ্যার চাপ, শহরের এলাকার উপর দখল ও তার ব্যবহারের নকশায় পরিবর্তন প্রভৃতি। এগুলো ধরলে দাঙ্গার ব্যাখ্যা অত সরল মনে হবে না। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে এখন সাম্প্রদায়িক সম্পর্ক যেখানে দাঁড়িয়ে আছে, তাকে বুঝতে হলে সে-দিনের দাঙ্গার কারণগুলো বোঝা জরুরি। ফের আমরা হিংসার প্রতি রাজনৈতিক প্রণোদনা লক্ষ করছি, সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষের জোয়ার এসেছে। কিন্তু যত গুরুত্বপূর্ণই হোক, কেবল এই দুটির দিকে আঙুল তুললেই হবে না। সম্প্রতি যে সব সংঘর্ষ আমরা দেখলাম, তাদের প্রেক্ষিত খুঁজতে আমাদের ভাবতে হবে কলকাতার আশেপাশে এক বিস্তীর্ণ এলাকায় আর্থিক অনুন্নয়নের কথা, কয়েক লক্ষ রাজ্যবাসীর দারিদ্রের সঙ্গে হাড়ভাঙা লড়াই, চাকরি-জমি-টাকাপয়সা পাওয়ার জন্য তীব্র প্রতিযোগিতা, এক এমন সামাজিক ব্যবস্থা যা বৈষম্যকে প্রায় অশ্লীল পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছে। কখনও ধনী-দরিদ্র, কখনও হিন্দু-মুসলমান, এমন নানা খাতে সেই বৈষম্যকে দেখা যায়। বাংলার মানুষ উসকানিদাতা নেতাদের হাতের পুতুল, এমন নয়। উসকানিতে উত্তেজিত হওয়ার জন্য মানুষকে প্রস্তুত করতে হয়। কী ভাবে বাংলার দুই সম্প্রদায়কে আজ প্রস্তুত করা হচ্ছে, তা এক বহুমাত্রিক প্রশ্ন, যা বহুমাত্রিক উত্তর দাবি করে। তাকে এড়িয়ে গেলে আমাদেরই সমস্যায় পড়তে হবে।
কানাডার রায়ার্সন বিশ্ববিদ্যালয়ে
ইতিহাসের শিক্ষক