সন্দেশের স্বত্ব কেন পেলাম না

রবীন্দ্রনাথও তাই লেখার মধ্যে ‘গদ্যজাতীয় ভোজ্য’দের এড়িয়ে যেতে চাইলেও ‘দুই বোন’ উপন্যাসে তাঁর লেখনীও ‘ভীম নাগের সন্দেশ’কে এড়াতে পারেনি।

Advertisement

অরুণিমা রায়চৌধুরী

শেষ আপডেট: ২৪ নভেম্বর ২০১৮ ০০:০৪
Share:

রসযুদ্ধে বাংলার ওড়িশাবিজয়ের এক বছর অতিক্রান্ত। ভৌগোলিক স্বত্বাধিকারের জোরে আমরা সগৌরবে বলতে পারছি, রসগোল্লা শুধুই বাংলার। এটা বলার জন্য জি আই ট্যাগের তকমার খুব প্রয়োজন হয়তো ছিল না। কারণ রসগোল্লার অবস্থান বাঙালির মনের গভীরে: তার সংস্কৃতির এক অনবদ্য প্রতীকচিহ্ন। তবুও বিজয় সব সময়েই গৌরবের। কিন্তু সেই বিজয়োল্লাসে আমাদের সংস্কৃতির আর এক অঙ্গ, রসগোল্লার সহধর্মিণী ছানার সন্দেশের অনুপস্থিতিতে বাঙালি মন খানিকটা উদাস। সন্দেশ মানে খবর। রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন বাঙালি নিরাকারকে করেছে সাকার, অর্থাৎ বাঙালির সন্দেশ নিছক খবর নয়, তা খাবারও বটে। তপ্ত কড়াইয়ে মিহি বাটা ছানার সঙ্গে চিনি বা গুড়ের মধুর এই মেলামেশা কবে কার হাতে যে প্রথম শুরু হয়েছিল তা বলা মুশকিল। বৈষ্ণব সাহিত্যে সন্দেশের উল্লেখ পাই মিষ্টান্ন গুণবাচক অর্থেই। তবে আজকে আমরা সন্দেশ বলতে মূলত যে ছানার সন্দেশ বুঝি, তার সঙ্গে বৈষ্ণব সাহিত্যের সন্দেশ এক নয়। ছানা দিয়ে বানানো সন্দেশের সূচনা কবে থেকে বলা শক্ত হলেও সম্ভবত হুগলি অঞ্চলই ছিল তার আদিভূমি। আঠারো শতকের শেষের দিকেই গুপ্তিপাড়ার গুপো সন্দেশ বেশ খ্যাতি অর্জন করেছিল। তবে কলকাতার বাজারই বোধ হয় সন্দেশের লীলাভূমি। রসের মিষ্টির রমরমা বরং কলকাতায় কিছুটা পরেই ঘটে, মোটামুটি উনিশ শতকের মাঝামাঝি থেকে।

Advertisement

ঔপনিবেশিক বাংলার প্রাণকেন্দ্র কলকাতায় ‘কিনে খাওয়া’র ক্ষেত্রে জাতপাত ছোঁয়াছুঁয়ির সমস্যার সুন্দর সমাধান ছিল এই সন্দেশ। এতে জলের ব্যবহার নেই, নেই নুনের ব্যবহারও; এমনকী চাল, ডাল, ময়দা— ‘বেজাত’-এর ছোঁয়ায় অশুদ্ধ হতে পারে এমন কোনও কিছুরই ব্যবহার লাগে না এতে। তাই খুব সহজেই এর জনপ্রিয়তা দেখা যায়।

প্রথমে সন্দেশ ছিল সাদামাটা। ছানা ও গুড় বা পাটা চিনির মেলবন্ধন: মাখা সন্দেশ, গোল্লা সন্দেশ, কাঁচা গোল্লা। মিষ্টির ইতিহাসের আদিপর্বে পরাণ ময়রার নাম আসবেই— আজকের ভীম চন্দ্র নাগ প্রতিষ্ঠানের প্রাণপুরুষ। তিনি ১৮২৩ সালে কলকাতায় এসে শুরু করেন সন্দেশের ব্যবসা। তাঁর সুযোগ্য পুত্র ভীম চন্দ্র নাগের হাত ধরে সন্দেশ সংস্কৃতি অন্য মাত্রা লাভ করে। রবীন্দ্রনাথও তাই লেখার মধ্যে ‘গদ্যজাতীয় ভোজ্য’দের এড়িয়ে যেতে চাইলেও ‘দুই বোন’ উপন্যাসে তাঁর লেখনীও ‘ভীম নাগের সন্দেশ’কে এড়াতে পারেনি। ‘সংগীতচিন্তা’ প্রবন্ধেও উল্লেখ পাই ‘ভীম নাগের সন্দেশ’এর। সন্দেশের ইতিহাসে আর এক অমর নাম গিরিশ চন্দ্র দে ও নকুড় চন্দ্র নন্দী। সম্পর্কে শ্বশুর-জামাই সন্দেশের জগতে পা রাখেন ১৮৪৪ সালে। আজ পর্যন্ত এই প্রতিষ্ঠান শুধু সন্দেশেই নিবেদিত, রসের মিষ্টির প্রবেশ সেখানে দেখা যায়নি। কারণ? ‘সন্দেশ শুদ্ধ, সন্দেশ সিদ্ধ, তাই সে দেবভোগ্য’।

Advertisement

বয়ে গিয়েছে অনেক সময়। সন্দেশ কিন্তু তার উৎকর্ষ হারিয়ে ফেলেনি, ক্রমশই বেড়েছে তার রূপ-গুণ। নতুন উপাদানের সংযোজনে লাভ করেছে নব কলেবর। কখনও এতে মিশেছে ফলের রস, কখনও বা ওয়াজিদ আলি শাহের অওয়ধ থেকে বয়ে আনা কেশর-পেস্তা-বাদাম। ফলের আকার ও প্রকারে একাধিক সন্দেশের আত্মপ্রকাশ দেখা যায় মধ্য-উনিশ শতকের মধ্যেই, আতা, আপেল, আম, তালশাঁস, কামরাঙা। মিহিছানার সন্দেশের মধ্যে গোলাপি পেঁড়া, দেদো মণ্ডা/সন্দেশ প্রভৃতিও উল্লেখযোগ্য। কিছু সন্দেশ আজও একই ভাবে জনপ্রিয়, আবার কোনওটি হয়তো বাজার জমাতে পারেনি। কেশর-পেস্তা-গোলাপজলের নবাবিয়ানার ফসল হল কস্তুরি, আবার খাবো, দিলখুশ, রোজ়ক্রিম, প্যারাডাইজ়, রয়্যাল স্যুট, জুবিলি। বিশ শতকে পাই স্মারক ও সম্মাননায় তৈরি নানান সন্দেশ, আশুভোগ, নেহরু সন্দেশ, স্বরাজ সন্দেশ। আর সন্দেশ সংস্কৃতির সর্বশেষ সংযোজন চকোলেট। সেই কবে মাখন ময়রার হেঁশেলে কোকো সন্দেশের মধ্যে দিয়ে তার অনুপ্রবেশ। আজ তো সন্দেশের জগতটাই চকোলেটময়।

সন্দেশের এই দীর্ঘ যাত্রাপথ ছিল না মসৃণ। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন বাধা এসেছে তার পথে। ১৯৬৫ সালে ছানার মিষ্টির উপর সরকারি নিষেধাজ্ঞা সন্দেশ-সংস্কৃতির বিকাশের পথে বড়সড় আঘাত হেনেছিল। দু’বছর পর নিষেধাজ্ঞা উঠলেও ক্ষয়ক্ষতি সামাল দিতে লেগে গিয়েছিল আরও বেশ অনেকটা সময়। বহু দোকান সাময়িক ভাবে বন্ধ হয়ে যায়। অনেক দোকান স্থায়ী ভাবেই বন্ধ হয়ে যায়। ছানার সন্দেশের এই সংস্কৃতির পথে প্রতিদ্বন্দ্বীর সংখ্যাও কম নয়। বিশেষত কেক-পেস্ট্রির মতো পশ্চিমি আগ্রাসন বার বার আক্রান্ত করেছে সন্দেশ-সংস্কৃতিকে। দেশি উত্তর ও পশ্চিম ভারতীয় লাড্ডু-বরফি সংস্কৃতির আগ্রাসনও কম গুরুত্বপূর্ণ ছিল না। তবুও সন্দেশ হারিয়ে যায়নি। রসগোল্লার মতো এখনও সন্দেশের জি আই ট্যাগ লাভ হয়নি। তবুও সে রসগোল্লার মতোই বাঙালিয়ানার প্রতীক।

সুন্দরবন মহাবিদ্যালয়ে ইতিহাসের শিক্ষক

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন