প্রতীকী ছবি।
স্বাধীনতার অধিকার তাঁরই প্রাপ্য, যিনি স্বাধীনতার সীমাটাও জানেন। এ কথা আগেও লিখেছি। আবার লিখতে হচ্ছে। তবে সোশ্যাল মিডিয়ায় আমাদের আচরণে এবং বিচরণে আজকাল অপকর্ষের যে সাধনা প্রকট, তাতে আশঙ্কা হচ্ছে, এ কথা ভবিষ্যতেও বহুবার লেখার অবকাশ তৈরি হবে।
সোশ্যাল মিডিয়া উন্মুক্ত এক পরিসর। কোনও উদার, প্রগতিশীল গণতন্ত্রে যেমন সকলে স্বাধীন, সকলে সমকক্ষ, সোশ্যাল মিডিয়াতেও তেমনই। কিন্তু স্বাধীনতার অর্থ তো যা খুশি করার অধিকার নয়। আমার স্বাধীনতা তত দূর পর্যন্তই প্রসারিত হতে পারে, যত দূর পর্যন্ত প্রসারিত হলে তা অন্যের স্বাধীনতাকে সঙ্কুচিত করে না। উদার গণতন্ত্রের ক্ষেত্রে এ সত্য যতটা প্রযোজ্য, সোশ্যাল মিডিয়ার ক্ষেত্রেও ঠিক ততটাই। নিজের স্বাধীনতার সীমান্তটা তাই নিজেকেই চিনে নিতে হয় এই সব পরিসরে। যাঁরা পারেন না, ধরে নিতে হবে, তাঁরা স্বাধীনতার যোগ্য নন।
আমাদের দেশের গণতান্ত্রিক পরিসরে প্রত্যেকের স্বাধীন ভাবে ভাবার অধিকার রয়েছে, সে ভাবনা প্রকাশ করার অধিকারও রয়েছে। সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারকারীদের এক বিরাট অংশ সম্ভবত সে সত্য ভুলতে বসেছেন। সাধারণ স্রোতের বাইরে গিয়ে যিনি ভাবেন বা যাঁর ভাবনা স্রোতের বিপরীতে ছোটে, ফেসবুকে-টুইটারে মত প্রকাশ করলেই তিনি তুমুল ট্রোলিং-এর শিকার হচ্ছেন। যে আলোচনা বা যে তর্কের বিষয়বস্তুতে জাতীয়তাবাদ বা দেশপ্রেমের রং থাকে, সে আলোচনায় যোগ দিয়ে যদি সংখ্যাগরিষ্ঠের মতের বিপক্ষে দাঁড়ান কেউ, তা হলে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হয়ে ওঠে তাঁর জন্য। অরুন্ধতী রায় বা গুরমেহর কউর বা শেহলা রসিদ— সোশ্যাল মিডিয়ায় তুমুল হেনস্থা, অশালীন আক্রমণ, তীব্র বিদ্বেষের শিকার একের পর এক। তালিকাটা দীর্ঘতর হচ্ছে প্রত্যেক দিন।
গণতান্ত্রিক বা উদার পরিসরে সঙ্ঘাত থাকবেই। কিন্তু সে সঙ্ঘাত চিন্তার সঙ্গে চিন্তার, মননের সঙ্গে মননের। সে সঙ্ঘাতে শানিত যুক্তির লড়াই কাম্য। স্থূল আক্রমণ, অশালীন ভাষা আর চূড়ান্ত অসৌজন্যের কোনও স্থান সেখানে নেই। কিন্তু যাদের স্থান নেই, তারাই স্থান করে নিচ্ছে। সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারকারীদের মধ্যে কুৎসিত আদান-প্রদানের প্রতিযোগিতা চলছে যেন।
জাতীয়তাবাদ বা দেশপ্রেম সংক্রান্ত চর্চার জোয়ার এখন সোশ্যাল মিডিয়ায়। এ ধরনের আলোচনায় যখনই কারও মত সাধারণ স্রোতটার চেয়ে একটু ভিন্নধর্মী হচ্ছে, তখনই শুরু হচ্ছে তুমুল ট্রোলিং, তীব্র হেনস্থা। ভিন্নমত পোষণকারীকে ‘ছদ্ম-ধর্মনিরপেক্ষ’ এবং ‘দেশদ্রোহী’ আখ্যা দেওয়া হচ্ছে মুহূর্তে, তার পর চলছে অবর্ণনীয় অপমানের বর্ষণ।
উল্টো দিকে যাঁরা থাকছেন, তাঁরাও বোঝার চেষ্টা করছেন না যে এই তথাকথিত জাতীয়তাবাদী বা তথাকথিত দেশপ্রেমীদের বক্তব্যেও কখনও সারবত্তা থাকতে পারে, যৌক্তিকতা মিলতে পারে। দু’পক্ষ নিরন্তর যুযুধানের ভঙ্গিমায়, দু’পক্ষই পরস্পরকে অন্ধ আঘাত এবং দৃষ্টিহীন প্রত্যাঘাতে মত্ত।
এই সঙ্ঘাতে কিন্তু গণতন্ত্রের বিকাশ নেই। এই সঙ্ঘাত স্বাধীনতাকেও সুনিশ্চিত করে না। এতে শুধু ঘৃণার জন্ম হয়, বিদ্বেষ বাড়ে, অবিশ্বাসের বাতাবরণ ঘনিয়ে ওঠে, সামাজিক ফাটলগুলো আরও চওড়া হতে থাকে। সোশ্যাল মিডিয়া ফাটলগুলোকে এ ভাবে আরও বাড়িয়ে তোলার লক্ষ্যে জন্ম নেয়নি বোধ হয়। সামাজিক বন্ধনগুলো আরও দৃঢ় করার অঙ্গীকারই ছিল বরং। কিন্তু প্রবচন বলে, দশচক্রে ঈশ্বরও হয়ে উঠতে পারে প্রেত। গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের চূড়ান্ত অবক্ষয়ের চক্রে পড়ে তাই সামাজিক মাধ্যমও হয়ে ওঠে ভাঙনের আঁতুড়ঘর, স্বাধীনতা হয়ে ওঠে অধিকার হরণের হাতিয়ার।
এখনই যদি আয়নার সামনে না দাঁড়াই আমরা, সামনে আরও অন্ধকার দিন।