প্রবন্ধ ২

অস্ত্রের কিন্তু প্রাণ আছে

আবার বন্দুক। আবার আমেরিকা। তবে, দিন কয়েক আগেই সান বের্নার্দিনোর স্কুলে গুলি চলা এবং এক শিশু-সহ তিন জনের মৃত্যু নিয়ে তেমন হইচই হয়নি।

Advertisement

পৌলমী দাস চট্টোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ১৯ এপ্রিল ২০১৭ ০০:০০
Share:

আবার বন্দুক। আবার আমেরিকা। তবে, দিন কয়েক আগেই সান বের্নার্দিনোর স্কুলে গুলি চলা এবং এক শিশু-সহ তিন জনের মৃত্যু নিয়ে তেমন হইচই হয়নি। কারণটা অনুমেয়। আমেরিকায় থেকে থেকেই বন্দুকবাজের আবির্ভাবের বিষয়টি সাধারণ মানুষের যেন অনেকটা গা-সওয়া হয়ে গেছে। হিসেব বলছে, গত দু’বছরে এমন ঘটনার সংখ্যা তিরিশ ছাড়িয়েছে। টার্গেট কখনও স্কুল, কখনও সমকামীদের ক্লাব, কখনও রেস্তোরাঁ। খুনি যে সব সময় সন্ত্রাসের উদ্দেশ্য নিয়ে বা স্রেফ খুনে মানসিকতার তাড়নাতেই বন্দুক কাঁধে হানা দিয়েছে, তেমনটা নয়। বরং বেশ কিছু ক্ষেত্রে কারণগুলোও বিচিত্র। কখনও প্রেমিকাকে শায়েস্তা করা, কখনও বন্ধুর সঙ্গে ঝগড়া, কখনও আবার বদলার ইচ্ছে, কখনও ঘৃণা। মনের কোণে জমা ক্ষোভ, অবসাদ, বিদ্বেষকে উগরে দেওয়ার জন্য হামেশাই তারা বেছে নিয়েছে একেবারে নিরীহ, নিরস্ত্র কিছু মানুষকে।

Advertisement

এখন, কেন আমেরিকায় বিদ্বেষ বাড়ার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহার বাড়ছে, সেটা বোধ হয় বোঝা সহজ। সে দেশে আগ্নেয়াস্ত্রের মজুত বাড়ছে। আইনের চোখে অস্ত্র জমা করাটা সেখানে কোনও ভয়ংকর অপরাধ নয়। বরং নিজের কাছে অস্ত্র রাখার অধিকার মার্কিন সংবিধানের ‘সেকেন্ড অ্যামেন্ডমেন্ট’-এ স্বীকৃত। এর পিছনে রয়েছে মানুষের আত্মরক্ষার সহজাত অধিকারের ধারণা। যে ধারণা বলে, প্রত্যেক মানুষ নিজেই নিজেকে বাঁচানোর দায়িত্ব নেবে এবং আততায়ীকেও আগাম ভয় দেখিয়ে রাখবে— তুমি অস্ত্র দেখালে তার উত্তরটা আমার কাছেও রয়েছে। অবশ্য একে শুধুই অধিকার-অতিসচেতন মার্কিন মানসিকতা ভাবলে ভুল হবে। বিশ্বের সমস্ত মাস‌্ল-ফোলানো দেশগুলোই যখন পরমাণু বোমা থেকে শুরু করে সমস্ত মারাত্মক বোমা, ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা করে, আর অন্যান্য পড়শি দেশ প্রমাদ গোনে, তখন তাদের আশ্বস্ত করতে এই মোক্ষম যুক্তিই দেওয়া হয়। আহা, ও তো কেবল জমা রইল আত্মরক্ষার জন্য।

কিন্তু আত্মরক্ষা আর আগ্রাসনের সীমারেখাটি বড় সূক্ষ্ম। আজ যে অস্ত্র আত্মরক্ষার জন্য যত্ন করে বাড়ি নিয়ে আসা হল, কালই যে সেই একই অস্ত্র দিয়ে কাউকে কোতল করার ইচ্ছে জাগবে না, এমনটা জোর দিয়ে বলা চলে না। আইন অস্ত্রের ব্যবহারবিধি নির্দেশ করতে পারে। অস্ত্রধারীকে বলতে পারে, ওহে, তুমি শুধু আক্রান্ত হলে বা যুদ্ধেই ওটা বের করতে পারো। কিন্তু ওই পর্যন্তই। অস্ত্রধারীর মনের খাঁজখোঁজ আগাম পড়ে ফেলার বিদ্যে আইনের নেই। এখানেই আমেরিকার আইনি ব্যবস্থায় মস্ত ফাঁক থেকে গেছে। যত ক্ষণ সমাজে শুভবুদ্ধি আছে, তত ক্ষণ সব ঠিকঠাক। কিন্তু প্রজার শুভবুদ্ধি সরে শয়তানি বুদ্ধি ভর করলে উপায় কী হবে, সে দিশা আইন বইয়ে নেই। প্রায় প্রতি মাসে এই ফাঁকেরই মূল্য চোকাচ্ছে আমেরিকা।

Advertisement

বন্দুক-সংস্কৃতি বিচার্য হলে, দেখা যায় ‘সেকেন্ড অ্যামেন্ডমেন্ট’-এর দৌলতে আমেরিকা বহু পিছনে ফেলে দিয়েছে ব্রিটেন-সহ পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলোকে। অন্য নানা ব্যাপারে ব্রিটেন আমেরিকার দোসর বটে, কিন্তু ব্রিটেনে যত শতাংশ সাধারণ মানুষ বন্দুক রাখার অধিকারী, আমেরিকায় সেই সংখ্যা বহু গুণ বেশি। এ জন্য অনেকাংশে দায়ী আমেরিকার ইতিহাস। সদ্যগঠিত দেশকে আগলে রাখার জন্য জনগণের হাতে বন্দুক থাকা জরুরি— ভাবখানা ছিল এমনই। বন্দুক সেখানে সীমাহীন স্বাধীনতার নামান্তর। স্বাভাবিক ভাবেই, আমেরিকায় যেখানে বন্দুক হানা এবং মৃত-আহতের সংখ্যা লাফিয়ে বাড়ছে, সেখানে পশ্চিম ইউরোপে এখনও তা অনেক কম।

শুধু অতীতই নয়, মার্কিন মুলুকের আধুনিক সমাজও এ জন্য দায়ী। যে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যর ওপর অত্যধিক গুরুত্ব আমেরিকাকে ‘আমেরিকা’ বানিয়েছে, সেই ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যই সে দেশে কোনও সামাজিক বা পারিবারিক বন্ধন গড়ে তুলতে দেয়নি। মানুষ সেখানে বড্ড একা। বন্দুকবাজদের জীবন ঘাঁটলে দেখা যেত, অনেকেই তাদের ছোটবেলার ‘নিশ্চিন্ত ঘেরাটোপ’টুকু পায়নি। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে যে উগ্রতা বা বিকৃতি তাদের মধ্যে জন্ম নিয়েছে, তাকে নজর করা এবং বিগড়ে যাওয়া কৈশোরকে ঘেঁটি ধরে ঠিক রাস্তায় নিয়ে আসার মতো কেউ তাদের পাশে ছিল না। সামাজিক নিরাপত্তাহীনতার সঙ্গে জুড়েছে অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা, পৃথিবীর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে। যে অনিশ্চয়তার তাসটি চমৎকার খেলে ডোনাল্ড ট্রাম্প বিপুল ভোটে জিতেছেন।

মার্কিন যুবসমাজের আগ্রাসী মনোভাব এখনই কমার নয়। বরং বাড়াটাই স্বাভাবিক। আগ্রাসন এখন শুধু এক শ্রেণির অ-সুস্থ মানুষেরই কাণ্ড নয়। নতুন প্রেসিডেন্টের জমানায় তাকে কৌশলে চারিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে সমস্ত সমাজটার, সব শ্রেণির মধ্যে। কখনও বর্ণবিদ্বেষ, কখনও জাতিবিদ্বেষ আবার কখনও স্রেফ দেশবিদ্বেষের পোশাক পরিয়ে। এই ধারাকে আটকানো অসম্ভব। বরং যেটা করা যেতে পারে, তা হল অস্ত্র আইনে পরিবর্তন। এখনই। কারণ, সমাজ আগ্রাসী হোক বা নরম, অস্ত্র জমতে থাকলে তার ব্যবহার হবেই।

অস্ত্রের বাইরেটা নিষ্প্রাণ। কিন্তু হাতে উঠলে সে অস্ত্রই জীবন পায়। তখন সে নিজেই নিজেকে ব্যবহারের পথ খুঁজে নেয়।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন