গুজবের জেরে হিংসার ঘটনা ক্রমেই বেড়ে চলেছে।—প্রতীকী ছবি।
অবশেষে সংগঠিত প্রয়াসটা শুরু হল অনিয়ন্ত্রিত আগুনের মতো লেলিহান হয়ে উঠতে থাকা অস্থিরতাটার বিরুদ্ধে। ‘ছেলেধরা’ গুজবে একের পর এক অঘটনের খবর আসছিল রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে। নাগরিকদের পক্ষে ক্রমশ বিপজ্জনক হয়ে উঠছিল অবাধ বিচরণ। আজ না হোক কাল আমি-আপনিও হয়ে যাতে পারতাম এই উদ্দেশ্যপ্রণোদিত গুজবের শিকার। প্রশাসনিক ভাবে এর বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট এবং কঠোর পদক্ষেপ করা জরুরি ছিল। প্রতিরোধমূলক এবং সচেতনতামূলক পদক্ষেপের সাঁড়াশি কৌশলে এত দিনে সেই কাঙ্খিত বন্দোবস্তটা দৃশ্যমান হল।
সপ্তাহ দুয়েক ধরেই অস্থিরতাটা বাড়ছিল রাজ্যের নানা প্রান্তে। বাংলার প্রশাসনিক ভরকেন্দ্র থেকে অনেক দূরবর্তী অবস্থানে থাকা প্রান্তগুলোয় শুধু নয়, খোদ রাজধানী কলকাতা এবং সংলগ্ন অঞ্চলেও ‘ছেলেধরা’ গুজব বিপদ ডেকে আনছিল। এত দিন প্রশাসন তা নিয়ে নির্বিকার বা নিশ্চুপ ছিল, এমন নয়। কিন্তু এত দিন পর্যন্ত এই বিপজ্জনক প্রবণতার বিরুদ্ধে পদক্ষেপ করা হচ্ছিল বিক্ষিপ্ত ভাবে। বিক্ষিপ্ত ধরপাকড়, বিক্ষিপ্ত সতর্কবার্তা, বিক্ষিপ্ত সচেতনতামূলক প্রচার— এই ভাবেই চলছিল গুজব নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা। কিন্তু পরিকল্পিত ভাবে বিপদের বীজ যখন বুনে দেওয়ার চেষ্টা হয়, সংগঠিত ভাবে যখন অস্থিরতা তৈরির বড়সড় ছক কষে ফেলা হয়, তখন কোনও বিক্ষিপ্ত বা অসংগঠিত প্রয়াসে সে অস্থিরতাকে প্রতিরোধ করা যায় না। ঈষত্ বিলম্বে হলেও রাজ্য প্রশাসন সে কথা বুঝল এবং সংগঠিত ভাবে গোটা রাজ্য জুড়ে ব্যাপক সচেতনতামূলক প্রচার শুরু হল।
অঘটন বা গুজব রুখতে পুলিশ-প্রশাসনকে কঠোর হওয়ার নির্দেশ মুখ্যমন্ত্রী আগেই দিয়েছিলেন। তবে পুলিশ-প্রশাসন নির্দেশ পাওয়া মাত্রই দারুণ নড়েচড়ে বসেছিল, এমনটা সম্ভবত নয়। বিপজ্জনক গুজবের বিরুদ্ধে পূর্ণ মাত্রায় সক্রিয় হয়ে উঠতে প্রশাসনের একটু সময় লাগছিল কোনও অজ্ঞাত কারণে। গত কয়েক দিনে অবশ্য ছবিটা বদলে গিয়েছে, গুজবের বিরুদ্ধে দ্রুত কঠোরতা বেড়েছে। একই সঙ্গে সংবাদমাধ্যমে বা টেলিভিশনে সচেতনতামূলক প্রচারও দৃশ্যমান ভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। ফিল্ম এবং টেলিভিশনের জনপ্রিয় মুখগুলোকে সামনে এনেছে রাজ্য প্রশাসন, তাঁদের মাধ্যমে সচেতনতা ছড়িয়ে দেওয়ার প্রয়াস শুরু হয়েছে। ‘ছেলেধরা আতঙ্ক’ নেহাতই গুজব, এই গুজবকে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে, সবাই মিলে এর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে— জনপ্রিয় তারকারা রাজ্যবাসীর উদ্দেশে এই বার্তা দিচ্ছেন। রাজ্য সরকারের এই প্রচারকৌশল নিঃসন্দেহে ফলপ্রসূ হতে চলেছে।
সম্পাদক অঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা আপনার ইনবক্সে পেতে চান? সাবস্ক্রাইব করতে ক্লিক করুন
‘ছেলেধরা’ গুজব যে আসলে অস্থিরতা তৈরির কৌশল, এর নেপথ্যে যে বড়সড় দুষ্কৃতী চক্র সক্রিয়, সে কথা আমরা আগেও বলেছিলাম। অঙ্কুরেই যে চক্রান্তের বিনাশ ঘটানো জরুরি, সে উপলব্ধিও আমরা আগেই প্রকাশ করেছিলাম। রাজ্যের প্রশাসন যে বিপদ আগে আঁচ করতে পারেনি, তা নয়। তবে সংগঠিত মোকাবিলাটা শুরু করতে একটু সময় লাগল। এখনও অবশ্য খুব দেরি হয়ে যায়নি, প্রশাসন এবং নাগরিকের যৌথ প্রচেষ্টা অঙ্কুরিত হলে অনতিবিলম্বেই বিপন্মুক্তি ঘটবে বলে আশা করা যায়।
আরও পড়ুন: গুজব ঠেকাতে পথে-প্রচারে পুলিশ
যে অস্থিরতা সৃষ্টির চেষ্টা আমরা এ রাজ্যে দেখলাম, তা নতুন কিছু নয়। পশ্চিমবঙ্গে হোক, ভারতের অন্যান্য প্রান্তে হোক বা পৃথিবীর অন্যান্য অঞ্চলে— বিপজ্জনক গুজব ছড়িয়ে সামাজিক অস্থিরতা তৈরির চেষ্টা বিভিন্ন সময়ে দেখা গিয়েছে। আশু বিপদকে সময়মতো আঁচ করতে না পারায় বা উপযুক্ত পদ্ধতিতে তার মোকাবিলা করতে না পারায় কখনও কখনও বিপর্যয় ঘনিয়েছে। তাই বাংলার নানা প্রান্তে অঙ্কুরিত হতে থাকা বিপদের সম্ভাবনাটাকে আর বাড়তে দেওয়া যেত না কিছুতেই। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে যাওয়ার আগেই রাশটা হাতে নেওয়া জরুরি ছিল। তবে শুধু প্রশাসন নয়, সামাজিক ঐক্য ও সংহতি ধ্বংসের যে কোনও প্রয়াসের বিরুদ্ধে দার্ঢ্য দেখাতে হবে আমাদের প্রত্যেককেই।