এক নতুন ভারত গঠনের কথা বলছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। ২০২২ সালের মধ্যেই না কি এই ভারত গঠন হয়ে যাবে, এমনটাই ঘোষণা। ২০১৪ সালের ভোট প্রচারের সময় থেকে শুনে আসছি এক ‘নতুন ভারত’ নির্মাণে বদ্ধপরিকর তিনি। আপামর ভারতবাসী পুলকিত। গত তিন বছর ধরে প্রতি দিন তাঁর বক্তৃতা শুনছি। বিজ্ঞাপনে টিভি চ্যানেলে ফ্লেক্সে পোস্টারে ব্যানারে নিরন্তর দেখে চলেছি মোদীর ভারত-মহিমা। রেডিয়োর এফএম-এ শুনেছি, এ বার দিল্লির বিমানবন্দরে শুনলাম সুরেলা কণ্ঠে গান, মেরা ভারত বদল রহা হ্যায়।
মোদীর এই নতুন ভারতের বৈশিষ্ট্য কী?
মোদীর কথা অনুসারেই, নতুন ভারত মানে মানুষের কর্মহীনতার আবসান। ডিজিটাল আধুনিক ভারতের আর্থিক বৃদ্ধির হার হবে পৃথিবীর কাছে ঈর্ষণীয়। ধনীদরিদ্রের শ্রেণিবৈষম্য না কি ঘুচে যাবে। রাজ্যে রাজ্যে কর্মসংস্থানের পরিকাঠামো গড়ে উঠবে। নোটবদলির বৈপ্লবিক সিদ্ধান্তে কালো টাকার মজুতদাররা নিশ্চিহ্ন হবে। সন্ত্রাসবাদে জাল নোটের ব্যবহার বন্ধ। কৃষকরা আর আত্মহত্যা করবেনা, কৃষি উৎপাদনের বৃদ্ধি হবে। বিমানবন্দর থেকে কলকাতাগামী বিমানটি ছাড়ল যথা সময়ে। সিটবেল্ট বাঁধার পর কাগজ পড়তে গিয়ে চোখ আটকে গেল মধ্যপ্রদেশ সরকারের এক যুগান্তকারী ঘোষণায়: এখন থেকে সে রাজ্যে লাইসেন্সপ্রাপ্ত জ্যোতিষীরা রোগীদের চিকিৎসা করার অধিকার পাবে। জ্যোতিষীদের দিয়ে চিকিৎসা? নতুন ভারতের ভাবনায় যুগান্তকারী পদক্ষেপ বটে!
কিছু দিন আগে দাদরি গ্রামে গিয়েছিলাম। উত্তরপ্রদেশের এই গ্রামে গোমাংস ভক্ষণ সন্দেহে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিঘ্নিত হয়েছিল। দেখলাম সেখানে গরিব মানুষ, কি হিন্দু কি মুসলমান একই রকম আছে। হিন্দু কাপড় ব্যবসায়ী, মুসলমান কারিগর। তিন বছরে এই গ্রামের মৌলিক সমস্যাগুলির কোনও সমাধান হয়নি। পানীয় জল, জলনিকাশি সমস্যা অনুর্বর জমিতে ফসলের সমস্যা, মানুষের জীবন ও জীবিকার সমস্যা, কিছুরই মীমাংসা হয়নি। কর্দমাক্ত কাঁচা রাস্তা। অপরিচ্ছন্ন পাড়া থেকে ফেরার সময় ভাঙা মসজিদের দাওয়ায় বসে ভাবছিলাম, নতুন ভারতের ঠিকানাটা কী?
বহু বছর পর সে দিন শিয়ালদহ স্টেশনে। যাব গৌড় এক্সপ্রেসে মালদহ। বৃষ্টিস্নাত কলকাতার সন্ধ্যা। স্টেশনের ভিতর রাজ্য পুলিশের থানায় জল জমে থই থই। নোংরা আবর্জনা। পরিস্রুত জলের কল বসিয়েছে রেল কর্তৃপক্ষ, কিন্তু জল ডিঙিয়ে সেখানে পৌঁছনো যায় না। নিরাপত্তা? স্টেশনটি তো চার দিক খোলা, হাওড়ার মতো নয়। রাতে অনায়াসে মানুষ ঢোকে। প্ল্যাটফর্মে আশ্রয়গ্রহণকারী মানুষের সংখ্যা দ্বিগুণ হয়ে যায়। সমাজবিরোধী, চোর-ছ্যাঁচড়, মাদকাসক্ত, পথভোলা ভবঘুরে, ভিখারি, সকলের মেল্টিং পট এই স্টেশন। সকালে স্টেশনের মধ্যেই রেল দুর্ঘটনা। চালক নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারেনি। ট্রেনটি ধাক্কা মেরেছে স্টেশনের দেওয়ালে প্ল্যাটফর্মে ঢোকার সময়। মহিলা বগিটি লাইনচ্যুত। উন্মত্ত জনতা ড্রাইভারকে প্রহারের উদ্দেশ্যে কাচের জানলায় ঘুষি মারছে। চালক দরজা বন্ধ করে ভিতরে উপবিষ্ট। আহত মানুষকে মাড়িয়ে দৌড়চ্ছে যাত্রীরা। পুলিশ তাদের তুলে স্থানীয় হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছে। রেল পুলিশ আর রাজ্য পুলিশ নিজেদের মধ্যে বিবাদে ব্যস্ত। এ দিকে দিল্লিতে সংসদে শুনি, রেল মন্ত্রক আদর্শ স্টেশন, আদর্শ প্ল্যাটফর্মের কথা বলেই চলেছে। ভাবলাম, তিরিশ বছর পর শিয়ালদহ স্টেশনের ভিতর এসেছি যখন, দেখি কেমন আছে স্টেশনটি। আঙ্গিকে কিঞ্চিৎ পরিবর্তন, কিছু সাজগোজ চোখে পড়ল, কিন্তু শৌচালয়ে প্রবেশ করতে গিয়ে সে এক ভয়াবহ অভিজ্ঞতা। সে নরকে প্রবেশ অসম্ভব। তবু কাতারে কাতারে নিরুপায় মানুষ সেখানে যাচ্ছে। মনে হচ্ছিল বমি হয়ে যাবে। সুরেশ প্রভুকে অনুরোধ, একটি বার এখানে এসে দেখুন মোদীর স্বচ্ছ ভারতের নমুনা।
গৌড় বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগে আয়োজিত হয়েছিল এক আন্তর্জাতিক সেমিনার। আলোচনার বিষয়বস্তু ছিল ভারতীয় রাজনীতির চ্যালেঞ্জ। দেশবিদেশের বহু অধ্যাপক এসেছিলেন। এই বিশ্ববিদ্যালয়টি সম্পর্কে কেন্দ্রীয় শিক্ষা মন্ত্রকের রেটিং নজর কাড়া। গ্রন্থাগার ডিজিটাল হচ্ছে। আলোচনায় বার বার উঠে এল মোদীর ভারত গঠনের প্রসঙ্গ। ভারতের বহুত্ববাদী রাষ্ট্র ও সমাজব্যবস্থার ঐতিহ্য কী ভাবে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। সহিষ্ণুতা ও অসহিষ্ণুতা। সাম্প্রদায়িকতা বনাম ধর্মনিরপেক্ষতা। নেহরু থেকে মোদী। বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্য কি বিপন্ন?
রজনী কোঠারি যাকে বলেছিলেন ‘কংগ্রেস সিস্টেম’, সেই নেহরুবাদী ভারতীয়ত্বর মডেলটি এক চূড়ান্ত অবক্ষয়ের শিকার। কংগ্রেসের অবক্ষয়ে কোনও দল সে পরিসর কেড়ে নিতে পারেনি। ভারতের রাজনীতিতে কোনও দক্ষিণপন্থী বিশেষ পরিসরও তৈরি হয়নি। ধীরে ধীরে জনসংঘ থেকে বিজেপি রাজনীতির সেই বিকল্প পরিসর দখল করেছে। আজ মোদীর ভারত অতীতের নেহরুর ভারতের এক ‘কাউন্টার ন্যারেটিভ’।
বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবীণ অধ্যাপক কৌশল কিশোর মিশ্র মাথায় লম্বা টিকি। কপালে লাল টিপ। তাঁর বক্তব্যের বিষয় ছিল মোদীর ভারত। প্রবল চিৎকারে তিনি প্রমাণ করতে চাইলেন, আমরা যা বলছি সে সবই অপব্যাখ্যা। আসলে নেহরুর ‘কংগ্রেস সিস্টেম’ হল হিন্দু জাতীয়তাবাদী সংস্কৃতির বিকৃতি। নরেন্দ্র মোদীই আসলে প্রাচীন ভারতীয় সংস্কৃতির ঐতিহ্যকে পুনরুজ্জীবিত করছেন। বক্তব্য শেষে মধ্যাহ্নভোজনকালে তাঁকে একটাই প্রশ্ন করেছিলাম, প্রধানমন্ত্রীর নির্বাচনকেন্দ্র বেনারস থেকেই অশান্তির খবর পাচ্ছি। শ্রাবণ মাসে বাবা বিশ্বনাথের আবাসে শান্তি বিঘ্নিত হওয়া কি মোদীর নতুন ভারতের লক্ষণ? পণ্ডিতজি কিঞ্চিৎ থতমত খেয়ে বললেন, ‘আভি তো স্থিতি নিয়ন্ত্রণ মে হ্যায়।’ তার পরই তিনি রসগোল্লা ভক্ষণে মনোনিবেশ করলেন। অনেকেই পালটা বক্তব্যে বললেন, মোদীর ভারতে হিন্দুধর্মেরও উদারতা পরিত্যাগ করে ইসলামের মতো অনুশাসনে বাঁধার চেষ্টা হচ্ছে। আমরা নতুন ভারতে তালিবানি হিন্দু হয়ে উঠব?
সেমিনারের শেষে গৌড় মালদহ ঘুরে ঘুরে দেখলাম। বারোদুয়ারি মসজিদ থেকে আদিনা। সঙ্গে ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা। স্থানীয় সাংবাদিকরা বললেন, নোট বাতিলের সিদ্ধান্তের পর মাত্র কয়েক মাসের মধ্যেই আবার ২০০০ টাকার জাল নোট তৈরি শুরু হয়েছে। বাংলাদেশ সীমান্ত দিয়ে বিএসএফের একাংশের মদতে চলছে রমরমে চোরাচালান। দারিদ্র চরমে। ঐতিহাসিক সৌধ এলাকা ভেঙে প্রাচীন ইট চুরি করে নিজেদের মাটির বাড়িতে লাগানো হয়। উপরে মাটির প্রলেপ।
ভূতনির হীরানন্দপুরে কেশরপুরে মরশুমের প্রথম গঙ্গার ভাঙন শুরু হয়েছে। উদ্বেগে তীরের মানুষ। এর আগে ভেসে গিয়েছে স্থানীয় বিধায়কের বাড়িও। এই ভয়াবহ দারিদ্রের মধ্যেও সম্প্রীতি। ক’দিন আগে বামকেলী মেলায় তা দেখেছে সবাই। মোদীর দেশ-মানচিত্রে মালদহ নেই?
দাদরি অথবা মালদহ। অখণ্ড ভারতের দুই খণ্ড খণ্ড দৃশ্যপটই বলে দেয়, মোদীর নতুন ভারতদর্শন আজও বিজ্ঞাপনী মায়া। বাস্তবতার রুক্ষতা থেকে মুখ ঘোরাতেই হয়তো এত ভেদনীতি, সাম্প্রদায়িকতার মতাদর্শের আমদানি। ডিজিটাল ভারত নির্মাণ করেও যদি কেউ সতীদাহ সমর্থন করে, সাম্প্রদায়িকতাকে হিন্দু জাতীয়তাবাদ নাম দেয়, তবে সে ভারত যতই নতুন জামা গায়ে দিক না কেন, কখনওই আধুনিক হতে পারবে না।