প্রাপ্তি ও তৃপ্তি

এই উৎসব যে প্রায় সাত-আট দিন চলিয়া ইংরাজি বর্ষশেষ এবং নববর্ষকেও আলিঙ্গন করিবে, ভাবিয়া কর্মপ্রাণ লোকেরা আঁতকাইয়া উঠিলেন। কিন্তু বাঙালির কর্ম করিবার সময় কোথায়, তাহার অবসর তো দুরন্ত বৈচিত্রে ভরিয়া উঠিয়াছে!

Advertisement
শেষ আপডেট: ৩১ ডিসেম্বর ২০১৭ ০১:১৮
Share:

বাঙালির এই বৎসরেও প্রাপ্তি তেমন নাই বলিয়া নিন্দুকেরা ভ্রু কুঞ্চিত করিতেছেন। তাঁহারা বুঝেন না, কথাটি প্রাপ্তি লইয়া নহে, তৃপ্তি লইয়া। বাঙালির তৃপ্তি ঘটে কী করিয়া? না, কেবল অর্থ সংগ্রহ করিয়া নহে, এই জাতির নিকট সর্বাধিক লোভনীয়: উত্তেজিত আলোচনার মুখরোচক বিষয়ের অনর্গল সরবরাহ। বৎসরের প্রথমটুকু কাটিল পয়সা-গর্ভ এটিএম-সন্ধানে। মোদী গত বৎসরের শেষ ভাগে যে অসামান্য খেলায় দেশবাসীকে শামিল করিয়াছিলেন, তাহার রেশ এই সময়েও চলিতেছিল। হাঁটিতে হাঁটিতে উড়ো খবর শুনিতে পাওয়া: কোন পাড়ায় বেড়াইতে গিয়া কে এক এটিএম দেখিয়াছে, যাহার সম্মুখে মাইলখানেক লাইন নাই, তাহা তড়িৎগতিতে ফোন ও মেসেজ করিয়া বন্ধুদের জানাইয়া দেওয়া, নিজে সেই স্থান হইতে পাঁচ শত টাকার নোট সংগ্রহ করা ও বিশ্বকাপ জয়ের আস্বাদ অনুভব, এই ছিল নূতন ক্রীড়ার ব্যস্ত প্রণালী। ইহার দোসর ছিল মোদীর কার্যটির পক্ষে ও বিপক্ষে উচ্চৈঃস্বরে তর্কাতর্কি। তর্ক আরও চলিত, কিন্তু ডাক্তারদের প্রতি, বিশেষত বেসরকারি নার্সিং হোমগুলির প্রতি সহসা এমন ক্ষোভ তৈয়ারি হইল, লোকে আকুল হইয়া উঠিল। অনেকেই বলিল, নার্সিং হোমগুলির প্রবণতায় চিকিৎসা গৌণ, নীতিহীন বাণিজ্যই প্রধান। ডাক্তারেরা তাহার উৎসাহী দোসর। কিছু নার্সিং হোম ভাঙচুর হইল, চিকিৎসায় গাফিলতির অভিযোগে কিছু মামলা হইল। ডাক্তারেরা বিপন্ন বোধ করিলেন, বলিলেন, কয়েক জন ডাক্তারের কুকাজের জন্য অকস্মাৎ সমগ্র পেশাটির বদনাম হইতেছে কেন, কিন্তু সে সব ভুলিয়া প্রায় সকলেই রাগিয়া উঠিল। ফলে দুর্গাপূজায় পর্যন্ত বিখ্যাত মণ্ডপে অসুরকে ডাক্তার সাজানো হইল।

Advertisement

মেট্রো গড়িবার জন্য জলতলে টানেল নির্মিত হইতেছে, জানিয়া অনেকে প্রতিজ্ঞা করিল, আর মেট্রোয় চড়িবার প্রশ্নই উঠে না। কেহ তাহার বাসস্থানের সম্মুখে মেট্রোর সুড়ঙ্গ তৈয়ারি হইতেছে বলিয়া, দিন চার-পাঁচের জন্য সরকারি খরচে হোটেলে বাস করিয়া মহা উল্লসিত হইয়া উঠিল। এই পুলক ভাঙিয়া গেল, যখন বিখ্যাত অভিনেতা তাঁহার সুন্দরী মডেল বান্ধবীকে লইয়া রাত্রিকালে গাড়ি দুর্ঘটনা ঘটাইয়া বসিলেন। বান্ধবীটি মারা যাইলেন। অভিনেতা মত্ত অবস্থায় ছিলেন কি না, মৃতার সহিত তাঁহার সম্পর্ক ঠিক কী ছিল, অমুক নিশি-আড্ডা হইতে তমুক রাস্তা যাইতে এত ক্ষণ লাগিল কেন, মধ্যবর্তী সময়ে তাঁহারা কোথায় ছিলেন কী করিতেছিলেন, উত্তুঙ্গ আলোচনা চলিল। বড়লোকের সন্তানেরা কেমন তীব্র বেপরোয়া ফুর্তিতে জীবন কাটাইতেছে, অনুমান করিয়া অনেকে ক্ষোভে ফুটিলেন, কেহ ঈর্ষায় ফাটিলেন। তাহার পর, বাংলা ভাষা প্রতিটি বিদ্যালয়ে বাধ্যতামূলক হইবে কি না, সেই বিতর্ক আসিয়া অনেককে জাত্যভিমান প্রদর্শনের সুযোগ করিয়া দিল। মোদের গরব মোদের আশা লইয়া তাঁহারা সরব হইলেন, কিন্তু এই স্ফুলিঙ্গটুকু ব্যবহার করিয়া বাংলার পাহাড় দাউদাউ জ্বলিয়া উঠিবে, হিসাবের বাহিরে ছিল। তখন অনেকে ভাষা চাপাইয়া দিবার বিরুদ্ধে সওয়াল করিলেন, কিন্তু তত ক্ষণে দার্জিলিং বেড়াইতে যাইবার গুড়ে বহু পরিমাণ বালি পড়িয়া গিয়াছে। ছুটিতে বেড়াইবার অন্য গন্তব্য খুঁজিয়া বাহির করিতে হইল, যাঁহারা ব্যাংকক যাইতে পারিলেন না তাঁহারা ঘাটশিলা যাইলেন, সেই সব স্থানের হোটেল-মালিকেরা ঈশ্বরকে প্রণাম করিতে করিতে পৃষ্ঠে বাত বাধাইলেন। ভাষা যে ভ্রমণ-নিয়ন্ত্রক, জানিয়া ভাষাবিদেরা স্তম্ভিত হইলেন।

ইহার পর আসিল শিশুর যৌন নিগ্রহের অভিযোগে উত্তপ্ত আন্দোলন, বিদ্যালয়ের সম্মুখে হাততালি দিয়া অনেকে বিপ্লব করিতে উৎসাহী হইলেন। এই আবহ হইতে ত্রাণ করিল বিরাট কোহালি অনুষ্কা শর্মার বিবাহ, তাহা বিদেশে ঘটিলেও, পাত্রপাত্রী এক বাঙালি ফ্যাশন ডিজাইনারের সৃষ্ট পোশাকে উজ্জ্বল! গর্বের মেয়াদ না-ফুরাইতেই আসিয়া পড়িল বড়দিনের উৎসব, এবং দেখা যাইল, উহাকেও বাঙালিরা স্বভাবসিদ্ধ উদারতায়, দুর্গাপূজা বানাইয়া ছাড়িয়াছে। সমান উচ্চণ্ড উল্লাস, সমান জনজীবনের সর্বনাশ। হাসপাতালে ডাক্তারেরা সদলে অনুপস্থিত, বেড়াইতে গিয়াছেন, শহরে প্রকাণ্ড যানজট, কারণ পার্ক স্ট্রিটে সমষ্টি-ফুর্তি। এই উৎসব যে প্রায় সাত-আট দিন চলিয়া ইংরাজি বর্ষশেষ এবং নববর্ষকেও আলিঙ্গন করিবে, ভাবিয়া কর্মপ্রাণ লোকেরা আঁতকাইয়া উঠিলেন। কিন্তু বাঙালির কর্ম করিবার সময় কোথায়, তাহার অবসর তো দুরন্ত বৈচিত্রে ভরিয়া উঠিয়াছে!

Advertisement

যৎকিঞ্চিৎ

কম্বোডিয়ায় দু’টি মোরগ-লড়াই চক্রকে গ্রেফতার করা হল, সেখানে বাজি-ধরাধরিতে বেআইনি জুয়া চলছিল। অভিযুক্তরা অধিকাংশই জামিনে ছাড়া পেল, কিন্তু যে ৯২টি মোরগ গ্রেফতার হল, আদালতের আদেশে তাদের সবাইকে কেটে খেয়ে নিল পুলিশ! আরে, মোরগেরা কি স্বেচ্ছায় লড়ছিল? জুয়ায় প্রশ্রয় দিচ্ছিল? মানুষ তাদের বাধ্য করল লড়তে, মানুষই তাদের জবাই করল! অবশ্য পুলিশরা নিশ্চয় খুশি, ভূরিভোজ! সাট্টা-চক্র ধরলে, তাদের শুকনো তাস চিবোতে হত!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন