সম্পাদকীয় ২

সূচকের সীমা

গৃহে বিদ্যুৎ সংযোগ হইলেও কার্যত বিদ্যুৎ না-ও মিলিতে পারে। লোডশেডিং, কম ভোল্টেজ, বিদ্যুৎ চুরি, এগুলি না দেখিলে প্রকৃত ছবি স্পষ্ট হইবে না। পশ্চিমবঙ্গ অবশ্য এ বিষয়ে কিছুটা কৃতিত্ব দাবি করিতে পারে।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৪ অগস্ট ২০১৭ ০১:৩০
Share:

কর্তা দেওয়াল লক্ষ্য করিয়া গুলি ছুড়িতেছেন। তাহার দাগকে মধ্যস্থলে রাখিয়া ভৃত্য ঝুলাইতেছে চাঁদমারি। ‘অব্যর্থ নিশানা’ দেখাইবার এই পদ্ধতি বলিউডি ছবিতে দেখিলে হাসি পায়। সরকারি নীতিতে তাহার নিদর্শন ভয়ংকর। সংসদের শক্তি বিষয়ক স্ট্যান্ডিং কমিটি সম্প্রতি বলিয়াছে, গ্রামে বিদ্যুতের খুঁটি পুঁতিয়া বিদ্যুদয়নের দাবি করা চলিবে না। কারণ গ্রামের অনেক বাড়ি রহিয়া যায় বিদ্যুৎহীন। ইহার সাক্ষ্য দিতেছে কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি রিপোর্ট। পশ্চিমবঙ্গ-সহ ভারতের ছয়টি রাজ্যে সমীক্ষার ফল, ছিয়ানব্বই শতাংশ গ্রামে বিদ্যুৎ আসিয়াছে, কিন্তু ৬৯ শতাংশ গৃহস্থালিতে বিদ্যুৎ সংযোগ আছে। বিহারে ৪৪ শতাংশ ঘরে এখনও বিদ্যুৎ আসে নাই। মাত্র বিশ শতাংশ গ্রামীণ গৃহস্থালিতে আলো জ্বলে বিদ্যুতে, আশি শতাংশের ভরসা কেরোসিন। ঝাড়খণ্ডে চারটি গ্রামীণ গৃহের তিনটিতেই বিদ্যুৎ নাই। উত্তরপ্রদেশে বিদ্যুৎ সংযোগ ষাট শতাংশ, তিন-চতুর্থাংশই বিদ্যুৎ পায় বারো ঘণ্টার কম। অর্থাৎ, খাতায়-কলমে গ্রামে বিদ্যুৎ ঢুকিলেও তাহা গৃহস্থের বাড়িতে না-ও ঢুকিতে পারে। এই করুণ ছবি ঢাকা প়ড়িতেছে, কারণ কেন্দ্রের গ্রামীণ বিদ্যুৎ যোজনাটিতে মাত্র দশ শতাংশ গৃহস্থালিতে সংযোগ থাকিলেই গ্রামের ‘বিদ্যুদয়ন’ হইয়াছে বলিয়া ধরিয়া লয়। এই সূচক বিভ্রান্তিকর। তাহারই সুযোগ লইয়া রাজ্য সরকারগুলি কেহ ৯৬ শতাংশ, কেহ ৯৮ শতাংশ বিদ্যুদয়নের আস্ফালন করিতেছে।

Advertisement

গৃহে বিদ্যুৎ সংযোগ হইলেও কার্যত বিদ্যুৎ না-ও মিলিতে পারে। লোডশেডিং, কম ভোল্টেজ, বিদ্যুৎ চুরি, এগুলি না দেখিলে প্রকৃত ছবি স্পষ্ট হইবে না। পশ্চিমবঙ্গ অবশ্য এ বিষয়ে কিছুটা কৃতিত্ব দাবি করিতে পারে। ২০১৫ সালের ওই সমীক্ষার রিপোর্টে প্রকাশ, এ রাজ্যে ৯৩ শতাংশ গ্রামীণ গৃহস্থালিতেই বিদ্যুৎ আসিয়াছে। কেরোসিনকে বহু পশ্চাতে ফেলিয়াছে বিদ্যুৎ। গ্রামীণ বিদ্যুৎ সংযোগের পরিকাঠামোও পূর্ব ভারতের অন্যান্য রাজ্যের তুলনায় পশ্চিমবঙ্গে এখন অধিক উন্নত। গত পাঁচ বৎসরে রাজ্যে দ্রুত বিদ্যুৎ সংযোগ বাড়িয়াছে। তবে লোডশেডিং এবং ভোল্টেজের অসমতা এখনও এ রাজ্যের গ্রামে একটি বড় অংশের নিকট মস্ত সমস্যা। রাজ্য সরকার দাবি করিয়াছে, চলতি বৎসরের রাজ্যের সকল গ্রামীণ গৃহে বিদ্যুৎ পৌঁছাইবে। তাহা অবশ্যই প্রশংসনীয়। কিন্তু যথেষ্ট নহে। বিদ্যুতের মান কেমন, কতক্ষণ বিদ্যুৎ সরবরাহ হইতেছে, সেই প্রশ্নও করিতে হইবে।

পরিমাপ ও মূল্যায়নের উদ্দেশ্যেই উন্নয়নের কিছু সূচক প্রস্তুত করিয়াছেন বিশেষজ্ঞরা। আক্ষেপের বিষয়, কখনও না বুঝিয়া, কখনও ভুল বুঝাইতে, নেতা-মন্ত্রী ও আমলারা সূচকগুলির ভ্রান্ত ব্যবহার করেন। খুঁটির হিসাব করিয়া যেমন বিদ্যুদয়নের হিসাব সম্ভব নয়, তেমনই এলপিজি-র গ্রাহক বা়ড়িলেও দাবি করা চলিবে না যে অস্বাস্থ্যকর জ্বালানির ব্যবহার কমিয়াছে। শিশুর মৃত্যুহারে উন্নতি দেখাইয়া শিশুস্বাস্থ্যে উন্নতি, কিংবা শিশুর স্কুলে নথিভুক্তি দেখাইয়া শিশুশিক্ষার উন্নতির দাবি করিলে ভুল হইবে। শৌচাগারের সংখ্যায় বৃদ্ধি উন্মুক্ত স্থানে শৌচের হ্রাস না-ও বুঝাইতে পারে। যাহা বস্তুত উন্নয়নের দ্যোতক, নিয়ত সেগুলির সন্ধান করিতে হইবে। কাজটি সরকারের। কিন্তু শিক্ষক-গবেষক মহল, তথা বৃহত্তর নাগরিক সমাজের দায়ও কম নহে।

Advertisement
(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন