প্রকাশ্যে মাতৃদুগ্ধ দান করা নিয়ে ছুঁৎমার্গ কবে ঘুচবে!

সন্তান কাঁখে নিয়ে তাকে মাতৃদুগ্ধ পান করাতে করাতে, মাথায় ঝুড়ি নিয়ে পথ হাঁটছেন মা। এ আমাদের গ্রামবাংলার এক চিরকালীন দৃশ্য। গ্রাম্য পরিবেশে যা সাবলীল, সহজাত, শহুরে পরিবেশে তা নিয়েই রাখঢাক। কটাক্ষ। এমন কেন! প্রশ্ন তুললেন প্রদীপ সিংহ গ্রামাঞ্চলে বিভিন্ন কর্মক্ষেত্রে, যেমন, ধানখেত, সবজি খেত, ইটভাটায়, হাটবাজারে এমনকি, বাস বা ট্রেনের মতো যানবাহনেও মায়েরা সন্তানকে প্রকাশ্যে স্তন্যদান করেন।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ ০০:০১
Share:

অস্ট্রেলিয়ার এক সেনেটর ল্যারিসা ওয়াটার্স।

দোলুদের বাড়িতেই রোজ সন্ধেবেলা মাস্টারমশাই পড়াতে আসেন। পাড়ার জনা পাঁচ ছাত্র বারান্দায় মাস্টারমশাইয়ের কাছে পড়ে। দোলু তাদের মধ্যে সবচেয়ে ছোট। বয়স আড়াই-তিন। ওর এখনও পড়ার বয়স হয়নি। তবুও দাদা দিদিদের সঙ্গে মা তাকে পড়তে বসিয়ে দেন, যাতে পড়ার অভ্যাসটা হয় অন্তত। তবে আজ হঠাৎই দোলুর খিদে খিদে পাচ্ছে। কী করবে, মা তো বাটনা বাটছে। যাবে নাকি একছুটে? মাস্টারমশাইয়ের দিকে তাকাল সে। মাস্টারমশাইও দোলুর চোখের আকুতি বুঝতে পারলেন। বললেন, ‘‘যা, তবে তাড়াতাড়ি আসবি।’’ দোলু দৌড়ে সামনেই বসে থাকা মায়ের কাছে গেল। মা-ও ছদ্ম রাগ দেখিয়ে ছেলের ক্ষুধা নিবারণ করলেন। মায়ের দুধ খেয়ে দোলু আবার পড়তে বসল।

Advertisement

এ সময় মাস্টারমশাই কিন্তু বারান্দাতেই বসেছিলেন। দোলুর বাবা ছিলেন উঠোনেরই কোণে রাখা দড়ির খাটিয়ার উপরে। কিন্তু কোথাও কোনও দৃশ্যই তাঁদের কাছে অশোভনীয় ঠেকল না। স্বাভাবিক দৈনন্দিন সারল্যে আপাদমস্তক মোড়া ছিল দোলুর মাতৃদুগ্ধ পান। অথচ, তথাকথিত ‘সভ্য’ সমাজে এই ঘটনাই কত না কটাক্ষের জন্ম দেয়।

প্রায় অর্ধশতক ধরে আমাদের এই দেশের একটি বিশেষ অংশের গ্রামীণ জীবনকে খুব কাছ থেকে যাপন করেছি। দেখেছি, গ্রামাঞ্চলে বিভিন্ন কর্মক্ষেত্রে, যেমন, ধানখেত, সবজি খেত, ইটভাটায়, হাটবাজারে এমনকি, বাস বা ট্রেনের মতো যানবাহনেও মায়েরা সন্তানকে প্রকাশ্যে স্তন্যদান করেন। স্তন্যদান করেন একরাশ পরিচিত-অপরিচিত নারী-পুরুষের চোখের সামনেই। কোথাও এতটুকু সমস্যা ঠেকে না। সন্তান কাঁখে নিয়ে তাকে মাতৃদুগ্ধ পান করাতে করাতে, মাথায় ঝুড়ি নিয়ে পথ হাঁটেন মা। এ আমাদের গ্রামবাংলার এক চিরকালীন দৃশ্য। পাশের মানুষগুলি তাঁরা পুরুষ বা মহিলা—যেই হন না কেন, সেই মাকে যতটা সম্ভব সহযোগিতাই করেন।

Advertisement

এ ধরনের দৃশ্য খুব একটা পুরনো তো নয়ই, বরং আজকের দিনেও প্রাত্যহিক হাঁটাচলার মধ্যে আমাদের চোখে পড়ে। সে কারণে শহুরে সমাজে যখন দেখি, কোনও মা’কে প্রকাশ্যে স্তন্যদানে বাধা দেওয়া হচ্ছে, কিংবা তাঁকে দেখিয়ে দেওয়া হচ্ছে আলাদা ঘেরা কোনও ঘর, অবাক হই। মনে পড়ে আমাদের সহজ, স্বাভাবিক, মাটির কাছাকাছি পড়ে থাকা অনুভূতিগুলোর কথা। তবে এ কথাও ঠিক, আজকের গ্রামবাংলায় হয়তো এই সারল্যকে এ ভাবে খুঁজে পাওয়া যাবে না। গ্রামবাংলাও পাল্টে গিয়েছে। তবু মনে হয়, আজও গ্রামবাংলার শিশুদের সামনে কোনও কিছুই সে ভাবে মাতৃদুগ্ধ পানে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়নি।

একটি শিশুর কাছে মাতৃদুগ্ধ কতখানি অপরিহার্য, সে বিষয়ে নতুন করে বলার কিছু নেই। মাতৃদুগ্ধই নবজাতকের প্রাথমিক রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে তোলে। এটি একটি পরীক্ষালব্ধ সত্য। বারবারই তা চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের দ্বারা আলোচিত ও সমর্থিত হয়েছে। কাজেই শিশুর সার্বিক স্বাস্থ্যোন্নতির জন্য তার জন্মের পরের মুহূর্ত থেকে কমপক্ষে এক বছর পর্যন্ত মাতৃস্তন্যদান যে বিকল্পহীন এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়। এর পরেও দেখি, তথাকথিত শিক্ষিত ও অভিজাত মহলে বিষয়টি নিয়ে নানা রকম কথাবার্তা হয়। এমনকি, ‘নিয়মে’র দোহাই দিয়ে বাধাদানও করা হয়। সম্প্রতি কলকাতার এক শপিং মলেই এমন একটি ঘটনা ঘটেছে বলে সংবাদে প্রকাশ।

অবাক হই। যে গ্রামবাংলায় দেখেছি, কোনও কারণে মা তার শিশুসন্তানকে মাতৃদুগ্ধপান করাতে না পারলে বাড়ির বা পাড়ার কাকিমা-জেঠিমারা নির্দ্বিধায় সে দায়িত্ব পালন করেন, সে রাজ্যেই এই বৈপরীত্য বিস্মিত করে। শিক্ষাদীক্ষা, আধুনিক সুখস্বাচ্ছন্দ্য কি সহজ, সরল মানবিক আচরণ থেকে আমাদের একাংশকে দূরে ঠেলে দিচ্ছে?

মনে হয়, মাতৃদুগ্ধের সঙ্গে মিশে থাকা সারল্যকেই সমাজের একাংশ হয়তো হারিয়ে ফেলছে ধীরে ধীরে। তার সঙ্গে মিশে যাচ্ছে লোকচক্ষু, লোকলজ্জা ইত্যাদির শব্দবন্ধের জটিলতা। বছর দুই আগে ‘সোশ্যাল মিডিয়ায়’ একটি খবর পড়ে চমৎকৃত হই। জেনেছিলাম, অস্ট্রেলিয়ার এক সেনেটর ল্যারিসা ওয়াটার্স তাঁর শিশুকে স্তন্যদান করাতে করাতেই সংসদে তাঁর প্রস্তাব রাখছেন। সে ছবি ‘ভাইরাল’ হয়েছিল সে সময়। তার পরেও বিদেশের বহু মহিলা রাজনীতিককে সংসদে তাঁদের শিশুদের নিয়ে যেতে দেখা গিয়েছে। কিন্তু এর ফলে সংসদের নিয়ম ভেঙে পড়ছে না বা কাজ বিঘ্নিত হচ্ছে না এক বিন্দুও। সব কিছুই স্বচ্ছন্দে চলেছে। কিন্তু এমন ধরনের ঘটনার কথা জানার পরেও অনেকের জ্ঞানচক্ষু উন্মীলিত হয়নি।

প্রশ্ন আসে, বিদেশের হাতে গোনা কয়েকটি ঘটনা, দেশের কোথাও কোনও কোণে এক-আধটা প্রতিবাদ জানানোর ঘটনা কি মাতৃস্তন্য দান সম্পর্কে তথাকথিত ‘সভ্য’ সমাজের একাংশের অকারণ ছুঁৎমার্গ মিটিয়ে দেবে? এখানে মেনে নিতেই হবে—তা সম্ভব নয়। প্রয়োজন আসলে সারল্য, সাহস এবং সচেতনতা।

শিশু চায় মাতৃদুগ্ধ ও মাতৃক্রোড়। এ চাহিদা শুধু যে শিশুর একার তা নয়, এ চাহিদা মায়েরও। এই চাহিদা প্রকৃতিক ও মানবিক। এ চাহিদা ‘পাবলিক প্লেস’-এর বাধ্যবাধকতা বোঝে না, কর্মক্ষেত্রের নিয়মকানুন মানে না। অথচ, এই চরম সত্যটি আমরা মাঝে মাঝে বিস্মৃত হই। বিস্মৃত হই কখনও ‘শিক্ষা’র চাপে, কখনও কর্তৃপক্ষের চাপে, আবার কখনও বা লোকচক্ষুর ভয়ে। তা না হলে গ্রাম যা পারে, বিদেশেও যা স্বাভাবিক—আমরা মাঝখানে থাকা নাগরিক সমাজ তা পারি না কেন? কেন নিজেরাই নিজেদের সহস্র যোজন পিছনে ঠেলে দিই?

লেখক পুরুলিয়ার সাহিত্যকর্মী

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন