সিনেমা কখনও বা অন্য এক সম্ভাবনার সন্ধান দেয়

দুটো মানুষ একা লড়াই করতে করতে যখন বন্ধু হয়

আই হেট পিপল’, কথাটা তারা বলার সঙ্গে সঙ্গে শিব বলে, ‘আই হেট পিপল টু।’ আঁতকে ওঠার মতো কথাবার্তা, তাই না? এত বিপুল জনসংখ্যার দেশ আমাদের, এত গর্ব করার মতো গণতন্ত্র, সেখানে এক নবীনা আর এক প্রবীণ সংখ্যাগরিষ্ঠকে তাচ্ছিল্য করার মতো স্পর্ধা দেখায়!

Advertisement

শিলাদিত্য সেন

শেষ আপডেট: ০২ মে ২০১৭ ০০:৩৬
Share:

আই হেট পিপল’, কথাটা তারা বলার সঙ্গে সঙ্গে শিব বলে, ‘আই হেট পিপল টু।’ আঁতকে ওঠার মতো কথাবার্তা, তাই না? এত বিপুল জনসংখ্যার দেশ আমাদের, এত গর্ব করার মতো গণতন্ত্র, সেখানে এক নবীনা আর এক প্রবীণ সংখ্যাগরিষ্ঠকে তাচ্ছিল্য করার মতো স্পর্ধা দেখায়! কোন মিনারে বাস করে এরা? একা থাকার, একা বাঁচার, একলা লড়াইয়ের... আমার অন্তত তা-ই মনে হয়েছিল ‘ওয়েটিং’ দেখতে দেখতে।

Advertisement

ছবিটা ঠিক এক বছর আগে, এই মে মাসেই কলকাতায় এসেছিল। এতটাই স্মৃতিতে রয়ে গিয়েছে যে এখনও কথা বলা যাচ্ছে, হয়তো সময়ের পাকে আটকে পড়েনি বলেই। এত দিনে যাঁদের দেখা হয়ে গিয়েছে তাঁরা জানেন, নবীনা তারা দেশপাণ্ডের বর রজত ভয়াবহ গাড়ি দুর্ঘটনায় আইসিইউ-তে, আর প্রবীণ শিব নটরাজের স্ত্রী পঙ্কজা আকস্মিক সেরিব্রাল স্ট্রোকে আট মাস ধরে লাইফ সাপোর্টে। দু’জনেই কোমা-য়। আর এদের দু’জনেরই আত্মজন তারা আর শিবের প্রায়-পাগল হওয়ার মতোই মনের অবস্থা। এমতাবস্থায় পরিচালক অনু মেনন শুধু পর্যবেক্ষকদের মতো দেখতে থাকেন এবং আমাদেরও দেখাতে থাকেন, কতটা অন্তহীন অপেক্ষা এরা করতে পারে, অসহ্য দমবন্ধ পরিস্থিতির মধ্যেও কতটা আশায় এরা দিন গুনতে পারে, নিজেদের একার লড়াইটা কত দূর অবধি এরা এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে।

আর আমাদের মুখে কেবল দলবদ্ধ লড়াইয়ের বুলি, দল ছাড়া লড়াইয়ের কথা আমরা ভাবতেই পারি না, আরও স্পষ্ট করে বলা ভাল, ভাবতে শিখিনি। সমস্ত রাজনৈতিক পক্ষই, সংসদীয় গণতন্ত্রে জনসাধারণের মন পাওয়ার জন্য লড়াই করেন যাঁরা, সংখ্যাগরিষ্ঠের ভোটে জিতে ক্ষমতায় আসেন যাঁরা, সংখ্যালঘু বা প্রান্তিকদের ত্রাতা হয়ে ওঠেন যাঁরা, তাঁদেরও কিন্তু ভারী অপছন্দ এই একলা মানুষের লড়াই। ধ্বজা উড়িয়ে সমবেত লড়াইয়ের কথাই তো উচ্চকণ্ঠে হাঁকেন তাঁরা, তাঁদের কাছে সমষ্টিই শক্তি, ব্যক্তির ভিতর আবার শক্তি কোথায়?

Advertisement

অথচ সমাজ-সভ্যতা নিরপেক্ষ ভাবেই ব্যক্তির একটা দায় থাকে ব্যক্তি হয়ে-ওঠার, সে নিজেই নিজের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে সে-দায় কাঁধে তুলে নেয়। বাধাবিপত্তি সত্ত্বেও আত্মপ্রতিরোধের ভিতর দিয়ে তার অভিপ্রায়ের দিকে সে এগিয়ে চলে। ভুল হোক, ঠিক হোক, যত তুচ্ছ বা সামান্যই হোক, ব্যক্তি তার লড়াইটা জারি রাখে। মুশকিল হল, আমাদের সত্তর-ছুঁইছুঁই স্বাধীনতার জন্মলগ্ন থেকেই তো সমষ্টির অন্তর্ভুক্ত পরিচয়টাকে একমাত্র আত্মপরিচয় ঠাউরেছি আমরা। দীর্ঘ পরাধীনতা আমাদের আত্মপরিচয় অর্জনের প্রক্রিয়াটিকে জটিল করে ফেলেছে, স্বাধীনতার জন্য সমষ্টির জাগরণ এতটাই বড় হয়ে উঠেছিল যে, ব্যক্তি হয়ে-ওঠার চেষ্টা সে ভাবে করিনি আমরা। নাগরিক বলে দাবি করি বটে নিজেকে, ব্যক্তি হয়ে-ওঠার মতো, ব্যক্তি-কে বোঝার মতো নাগরিক-মনটাই নেই আমাদের।

তামাম মূলস্রোতের ভারতীয় ছবিতে তারই প্রতিফলন। ব্যক্তির ভিতর যে রহস্যময় মানুষটা বাস করে, তার মনের মধ্যে যে খাড়াই-উতরাই লড়াই, তা প্রায় কখনওই ধরা পড়ে না আমাদের ছবিতে। যে ব্যক্তিকে নিয়ত দেখি ফিল্মে, একটা গড় চেহারা ফুটে ওঠে তার মধ্যে। সিনেমার সেই গড় চেহারার মানুষটির জীবনে কোনও ব্যক্তিগত সংকটই তাকে ব্যক্তিগত ভাবে তত বিপন্ন করে না, যাতে বেদনায়-বিষাদে সে এক জন স্বতন্ত্র মানুষ হয়ে ওঠে।

অনু মেননের ছবি এই চলতি হাওয়ার পরিপন্থী। শিব প্রবল ভাবে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদী। কারও কোনও নাক গলানোই সে পছন্দ করে না, কেউ যদি তার উপকারে আসে, তাও। পঙ্কজার অনুপস্থিতিতে তার খাওয়ার অসুবিধের কথা ভেবে প্রতিবেশী খাবার পাঠালে প্রায়ই না খেয়ে ফেলে দেয়, শেষে এক দিন খাবারের ডিব্বা ফেরত দিতে গিয়ে বলে আসে ‘আমার খাবার আমি নিজেই বানিয়ে নেব।’ বৃথা জেনেও স্ত্রীর চিকিৎসা নিয়ে ডাক্তারের সঙ্গে তর্কে অনড় থাকে। তাদের চল্লিশ বছরের দাম্পত্যে মাধুর্যের কথা এড়িয়ে কেউ যদি সন্তানহীনতাজনিত শূন্যতার কথা তোলে, ভয়ানক রেগে যায়। প্রশ্ন করে, ‘ট্যুইটার’ কী, বা এর প্রয়োজনীয়তাই বা কী। বোঝাই যায়, মানুষটা তার ব্যক্তিগত পরিসর বা প্রাইভেট স্পেস-টাকে সকলের সামনে মেলে ধরতে নারাজ, ব্যক্তিগত ভাবে বাঁচতে চায়, নিজের লড়াইটা নিজেই লড়তে চায়। তারা-ও শিবের মতোই, বুঝতে পারে, লড়াইটা তার একার। সোশ্যাল মিডিয়া-নির্ভর হওয়া সত্ত্বেও সে টের পায়, ফেসবুক-এর বন্ধুরা তার পাশে নেই। ‘আই অ্যাম ইউজিং দ্য পাওয়ার অব সোশ্যাল মিডিয়া’, তার এই মন্তব্য তাকেই যেন পরিহাস করে!

আমাদের বেঁচে থাকার সমাজ-মুখাপেক্ষী ধরনধারন, রীতিনীতি নিয়েই প্রশ্ন তোলে ছবিটি। বিপন্ন বোধ করলেই চট করে আমরা সমষ্টিতে লগ্ন হতে চাই, চেনা বৃত্তের খোঁজ করতে থাকি, ঠিক যেমন এ-ছবিতে হাসপাতালের ডাক্তার বা বিমা কোম্পানির প্রতিনিধি শিব আর তারাকে ডেকে বলেন— পরিবারের সদস্য, বন্ধুবান্ধবদের ডেকে আনুন, এ বিপদ আপনি একা সামলাতে পারবেন না। নিজেদের চেনাজানার বাইরে পৃথিবীটাকে ভাবতেই পারি না আমরা!

শিব আর তারা কিন্তু পেরেছিল। বয়স, প্রজন্ম, চালচলন, রুচি, কথাবার্তার ধরন, কোত্থাও এতটুকু মিল নেই দু’জনার, ভিন্ন গ্রহের বাসিন্দা বললেও কম বলা হয়। তবু দুটো একা মানুষ, একা-একা লড়াই করতে-করতে চিনতে পারল পরস্পরের নিঃসঙ্গতাকে। তুমুল ঝগড়ার পরেও তারা কবুল করল শিবের কাছে— সে-ই একমাত্র বুঝতে পেরেছে তারাকে, এই বিপুল জনসমষ্টির দেশে।

মানুষ দু’টি ‘আইসোলেটেড ফ্রম দ্য ওয়ার্ল্ড ফাইন্ডিং কমফোর্ট ইন ইচ আদার’, পরিচালকের মত জানিয়েছেন অনু মেনন, আবার খেয়ালও করিয়ে দিয়েছেন, ‘ইট ইজ নট অ্যাবাউট রোমান্স।’ আর তারা চরিত্রের অভিনেত্রী, কল্কি কোয়েচলিন, তাঁর মনে হয়েছে ‘সামটাইমস উই জাস্ট ফল ইন লাভ উইথ আ পার্সন... ইট ডাজন্‌ট হ্যাভ টু বি রোমান্টিক লাভ।’ চেনা সমাজের ভরসায় না থেকে অজানা এক সম্পর্কে ভর করে দুঃসহ দিনগুলো পেরনো... আত্মজনের আরোগ্যের অনন্ত প্রতীক্ষায় পাশাপাশি দু’টি মানুষের এমন সম্পর্কের কোনও সংজ্ঞা হয় না, কোনও বাঁধাধরা ব্যাখ্যায় একে আঁটানোও যায় না।

প্রবীণ-নবীনার সম্পর্ক নতুন নয় ভারতীয় ছবিতে, ‘নিঃশব্দ’-য় দেখেছি অমিতাভ বচ্চনকে মেয়ের বন্ধুর সঙ্গে প্রেম করতে, আর ‘পিকু’তে মেয়ের সঙ্গে সেন্টিমেন্টাল হয়ে উঠতে। ঘুরেফিরে সেই প্রেম বা পিতৃত্বের গল্প, মূলস্রোতের ভারতীয় ছবি যে পরিবার প্রথার বাইরে বেরোতেই পারে না।

মূলস্রোতের ছক উল্টে দিয়েছেন অনু, কিন্তু থাকতে চান মূলস্রোতেই। ‘মেনস্ট্রিম সিনেমা নিডস আ ফিমেল ভয়েস’, বলেন তিনি। তাঁর ছবি কতটুকু মনে রাখবে মূলস্রোতের বাজার, জানি না। কারণ, দেশটা তো সংখ্যাগরিষ্ঠের গণতন্ত্রের। তবে, বাঁচার এই যে ব্যক্তিগত ধরন, সম্পর্কের এই অনির্দিষ্ট রকম, তার প্রণেতা হয়ে উঠতে পারলেন, নতুন ভাবে ভাবতে পারলেন অনু। মেয়ে বলেই কি?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন