মধ্য তিরিশের ব্যস্ত কর্পোরেট। কিন্তু কেমন একটা আলস্য ঘিরে থাকত সারাক্ষণ। খেতে ইচ্ছে করত না, অফিস যেতে ইচ্ছে করত না, মাঝেমধ্যেই ছুটি নিয়ে বসে থাকতেন বাড়িতে। এক বন্ধুর পরামর্শে মনোবিদের কাছে গিয়ে বুঝলেন, অপছন্দের কাজের চাপে হাঁপিয়ে উঠে অবসাদে ডুবে গিয়েছেন তিনি। নিয়মিত ওষুধপত্র, কাউন্সেলিংয়ে সমস্যা কেটেছে অনেকটাই। এখন অন্যদের সমস্যা দেখলে মনোবিদের সাহায্য নেওয়ার পরামর্শ দেন ছত্রিশের যুবক।
বছর তিনেক আগে আচমকা বাবাকে হারানোর দুঃখটা অজান্তেই মানসিক সমস্যার বীজ বুনে দিচ্ছে, তা আঁচ করেননি তিরিশের তরুণী। যখন-তখন অহেতুক উদ্বেগ ঘিরে ধরত। শরীর খারাপ লাগত যখন-তখন। এক সময় সেই দুশ্চিন্তার বোঝা দু’দিনের জন্য শয্যাশায়ী করে ফেলল। অগত্যা মনোবিদের কাছে। এবং বুঝলেন, উদ্বেগের এই সমস্যাটা আসলে বাবাকে হারিয়ে ফেলার ধাক্কা, নিরাপত্তাহীনতার জেরে। চিকিৎসার গুণে ঘুরে দাঁড়িয়ে এখন একটু একটু করে ঘুরে দাঁড়াচ্ছেন তিনি। সকলের সঙ্গে ভাগ করে নিচ্ছেন নিজের অভিজ্ঞতা। এবং তা করতে গিয়েই বুঝছেন, অবসাদ-মানসিক চাপে ভুগছেন তাঁর আশপাশের অনেকেই। কেউ কেউ হয়তো বা বড়সড় কারণ ছাড়াই।
মনোবিদ মানে ‘পাগলের ডাক্তার’। তাঁর কাছে না যাওয়াই শ্রেয়। এবং যদি বা মনোবিদের দ্বারস্থ হতে হয়, তা-ও চুপিসাড়ে। কাউকে জানানো বা পরামর্শ নেওয়া নৈব নৈব চ। ফলে ছোটখাটো মানসিক সমস্যা, যা সামান্য ওষুধপত্র বা কাউন্সেলিংয়েই মিটে যেতে পারত, তাকে এড়াতে এড়াতে সমস্যার শিকড় মনের গভীরে গেঁথে ফেলা। সেই ‘অসুস্থতা’ সারানোর লড়াইয়ে সমাজকে অনেকটা এগিয়ে দিচ্ছেন এখনকার প্রজন্ম। যাঁদের বয়স কুড়ি থেকে চল্লিশের কোঠায়, যাদের কাছে মানসিক চাপ, অবসাদ বা অতিরিক্ত উদ্বেগের মতো সমস্যা এখন প্রায় জলভাত, সমস্যার আঁচ পেলে অনেকে এখন একা একাই চলে যাচ্ছেন মনোবিদের কাছে। অন্যদের সঙ্গে তা নিয়ে খোলামেলা আলোচনা করছেন। সম্পর্ক বা বিয়ে ভাঙার পরে কিংবা চাকরি থেকে অবসরের অবসাদ কাটাতে চিকিৎসার পথে হাঁটতেও দেখা যাচ্ছে অনেককেই।
মনের চিকিৎসা করালে লোকে কী বলবে, বিয়ে হবে না-র মতো ভুল ধারণাগুলোকে সমাজ থেকে উপড়ে ফেলতে খোলাখুলি আলোচনাও যে অনেকটাই সাহায্য করছে, তা মানছেন মনোবিদেরা। বলছেন, এতেই অর্ধেক যুদ্ধ জেতা হয়ে যাচ্ছে। অন্যের অভিজ্ঞতা শুনে বুঝতে পারছেন, আর পাঁচটা অসুস্থতার মতোই মানসিক সমস্যাও স্রেফ একটা রোগ। উপযুক্ত চিকিৎসা হলে তা থেকেও দিব্যি বেরিয়ে আসা যায়। ঘরে-বাইরে কাজের পাহাড়ে চাপা পড়ে থাকা ব্যস্ত জীবনযাপনে, প্রিয়জনদের সঙ্গে মেলামেশার সুযোগ না পেয়ে মানসিক চাপ, অবসাদ বা দুশ্চিন্তার মতো সমস্যা হতেই পারে এবং তা সারাতে মনোবিদের সাহায্য নেওয়া জরুরি, সেই সচেতনতাটাও ক্রমেই বাড়ছে।
মনোবিদ অনুত্তমা বন্দ্যোপাধ্যায় বললেন, ‘২০ থেকে ৪০-এর প্রজন্মের মধ্যে মানসিক সমস্যা নিয়ে খোলামেলা আলোচনা এবং একে-অন্যকে পরামর্শ দেওয়ার প্রবণতা সত্যিই বাড়ছে। তাতে নিজের সমস্যা নিজেই চিনতে পারা যেমন সহজ হচ্ছে, তেমনই সাপোর্ট সিস্টেমও তৈরি থাকছে।’
মনস্তত্ত্বের শিক্ষক নীলাঞ্জনা সান্যালের মতেও, ‘অবসাদ, নিরাপত্তাহীনতা, উদ্বেগের মতো মানসিক সমস্যা এখন জ্বর-সর্দিকাশির মতোই সাধারণ হয়ে উঠেছে। ফলে তা নিয়ে আলোচনায় দ্বিধাও থাকছে না মানুষের। এটাতে মানসিক সমস্যাকে সহজে চিহ্নিত করাটাও সহজ হচ্ছে নিঃসন্দেহে।’ তবে আলোচনার জন্য ভরসাযোগ্য মানুষদেরই বেছে নেওয়া জরুরি বলে জানিয়েছেন তিনি।
মনোবিদ অনিরুদ্ধ দেবের মতে, ‘‘নিজেদের মধ্যে আলোচনার স্বাচ্ছন্দ্য যে বাড়ছে, সেটা কিছুটা বলাই যায়। তবে এখনও মনোবিদের কাছে চিকিৎসার কথা গোপন রাখতে চাওয়া মানুষের সংখ্যাই বেশি। আলোচনায় স্বাচ্ছন্দ্যের পরিমাণটাও এখনও অনেকটাই কম। তবে আগামী দিনে তা বাড়বে বলেই আশা রাখি।’’