আজ থেকে প্রায় একশো বছর আগে বাংলায় বিজ্ঞানের কদর ছিল। বিজ্ঞানের জগৎসভায় বাংলা থেকে যে বিজ্ঞানচর্চা এবং আবিষ্কারের উৎকৃষ্টতা, সেটা প্রথম দিকে ছিল। স্যর সি ভি রমন, মেঘনাদ সাহা, সত্যেন্দ্রনাথ বসু, প্রশান্তচন্দ্র মহলানবীশ, আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় প্রভৃতি বহু বিজ্ঞানী সারা পৃথিবীতে সমাদৃত ছিলেন।
স্যর সি ভি রমনের ‘রমন এফেক্ট’ নিয়ে এখনও পৃথিবীর কোনায় কোনায় গবেষণা হচ্ছে, ভারতে তো বটেই। মেঘনাদ সাহার ‘সাহা আয়নাইজেশান তত্ত্ব’ জগৎবিখ্যাত; এখনও পর্যন্ত এই সমীকরণ দিয়ে অনেক উঁচু মাপের কাজ হয়। রকেটগুলির আকাশে বিচরণ বোঝার জন্যে ‘সাহা সমীকরণ’ লাগানো হয়। আবার ব্রহ্মাণ্ডের আদি মুহূর্তে সৃষ্টির মাইক্রোসেকেন্ড পরেই কী করে পদার্থ এল, হাইড্রোজেন, হিলিয়াম ইত্যাদি সৃষ্টি হল, তাতেও ‘সাহা সমীকরণ’ লাগানো হয়। অন্য দিকে, সত্যেন্দ্রনাথ বসুর গবেষণা থেকে উৎপত্তি হয়েছিল বোস-আইনস্টাইন সংখ্যায়নের। বিরাট আবিষ্কার। আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু শুধু রেডিয়ো তরঙ্গই আবিষ্কার করেননি, যে কল থেকে এই তরঙ্গ বেরিয়ে আসছে সেই কলটি সমস্তটাই কলকাতায় নিজে হাতে তৈরি করেছিলেন, যেটা কিনা সারা পৃথিবীতে আলোড়ন তুলেছিল। আচার্য উদ্ভিদ নিয়েও নতুন নতুন আবিষ্কার করেছিলেন। সেই কাজে যে সব যন্ত্রপাতি ব্যবহার করেছিলেন, তারা অতি সূক্ষ্ম ও আধুনিক, এবং কলকাতাতেই তৈরি।
এই উদাহরণগুলি দিয়ে বোঝাতে চাইছি যে, ওই সময়ে বাংলায় শুধু বিজ্ঞানচর্চাই হত না, তা ছিল শ্রেষ্ঠ মানের, কিন্তু আবিষ্কারগুলি যাঁরা করেছিলেন তাঁরা বাংলাতেই থাকতেন, যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন সেগুলিরও পৃথিবীতে প্রচুর নামডাক হয়েছিল। বিদেশে এঁরা বহু বার গিয়েছিলেন, কিন্তু ভারতেই তাঁদের বাস। অর্থাৎ, পৃথিবীতে আমরাও দাঁড়াব সেরা বৈজ্ঞানিকদের সঙ্গে, কিন্তু ভারত তথা বাংলায় বসেই।
এই প্রেক্ষিতে আজকের বাংলায় বিজ্ঞান কোথায়? বাংলায় বিজ্ঞানচর্চার যে সমাদর ছিল তার ধারে কাছে আজকের বাংলার বিজ্ঞানচর্চা আসতে পারে না। কোণঠাসা হয়ে বসে আছে। দু’এক জন মানুষ এই বাংলা থেকে পৃথিবীর অন্য জায়গায় গিয়ে নাম করেছেন, কিন্তু সেটা ভারতের অন্য জায়গায় কিংবা বিদেশে। একটা ব্যাপার হল, বাংলায় তরুণ বিজ্ঞানীরা এখনও পৃথিবীর ধারাটা ঠিক বুঝতে পারেননি। এখন বিজ্ঞানের জগতে সকলে মিলে কাজ করেন, কিন্তু বাঙালি সকলের সঙ্গে মিলেমিশে কাজ করবে সেই অধ্যায় আসতে দেরি আছে।
আমি যখন কুড়ি বছর পরে কলকাতায় কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করি, বিজ্ঞানসংস্থায় বাঙালির বাঙালিপনা দেখে আমার অবাক লেগেছিল। বাঙালি কলকাতা তথা বাংলাকে ধরে স্বস্তি পায়। বাইরে গেলে বেশির ভাগ বাঙালি নিজেকে অসহায় মনে করতে থাকে। এ দিকে এখানকার সমাজের ধারাগুলি তাকে চেপে ধরে। কী করা উচিত, সেটা শুনতে শুনতে তার স্মৃতিশক্তির ক্ষয় তো হয়ই, অকালে লোপও পায় মাঝে মধ্যে। কী করবে সেটা নিরাশার ঘন মেঘে ঢাকা; কিছুই হবে না, এই মনে হয় তাদের।
শিক্ষিত মধ্যবিত্ত বাঙালি বাবা-মা কোনও রকমে ছেলেপুলেদের আমেরিকা পাঠাতে পারলেই পরম শান্তিতে থাকে, বাংলায় তথা ভারতে কী হল না হল, সেটা নিয়ে মাথাব্যথা করে না।
যে প্রবৃত্তি বা চিন্তাধারা একশো বছর আগে একেবারেই ছিল না, সত্যেন বসু, মেঘনাদ সাহা, প্রশান্তচন্দ্র মহলানবীশ প্রভৃতির বিদেশের সঙ্গে যোগাযোগ তো ছিলই কিন্তু ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেশের মাটি কামড়ে পড়ে থাকতেন। আমার নিজের দেশ জগৎসভায় শ্রেষ্ঠ আসন লবে— এই ভাবনাটি তাঁদের প্রেরণা দিয়েছে, আর তার সঙ্গে দৃঢ় সংকল্প। মনের এই প্রসার আজ লোপ পেয়েছে। যে দেশ থেকে তাঁরা শিক্ষা পেয়েছেন, সেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলিকে বাইরে যাওয়ার পরে এঁরা এড়িয়ে তো চলেনই, মনে মনে হয়তো ভাবেন এই প্রতিষ্ঠানগুলি কি নিম্নস্তরের?
এই প্রতিষ্ঠানগুলি ধাপে ধাপে নীচে নামতে শুরু করেছে। শিক্ষার যে একটা কৃষ্টি আছে, তার মধ্যে যে সভ্যতার আলো ফুটে ওঠে, সেটা এক কালে ছিল, এগুলি মুখস্থ করার কারখানা হয়ে দাঁড়িয়েছে। পরবর্তী জীবনে সেই বাঙালি মার খায়। ইংরেজি না পারে ভাল করে বলতে, না পারে ভাল করে লিখতে, ভারতেই যেখানে বিজ্ঞানের জগতে ইংরেজির প্রচলন সেখানেই এরা মুখ খুলতে ভয় পায়।
তবে একটা ব্যাপার খুবই আমাদের সমাজকে বসিয়ে রেখেছে, সেটা হল আর্থিক অবনতি। বিজ্ঞানের উন্নতি আর আর্থিক সচ্ছলতা ওতপ্রোত জড়িয়ে আছে, পৃথিবীর যে দিকেই দেখা যাক না কেন, এটা সত্য। আমেরিকা যে আজ বিজ্ঞানের শিখরে, বলা যেতে পারে শ্রেষ্ঠ, সেটার একটা কারণ আর্থিক সচ্ছলতা আর সেই সঙ্গে কাজের স্বাধীনতা— সরকার এর মধ্যে ঢোকে না।
বাঙালি নিজেদের মধ্যে খেয়োখেয়ি করে, প্রতিষ্ঠানগুলিকে একশো ভাগ সরকারের হাতে সমর্পণ করেছে, আর তাঁরা রাজনীতির ধাক্কায় শিক্ষার কতটা উন্নতি করতে পেরেছেন, সেটা বলা শক্ত। উল্টে শিক্ষার মান দিন দিন নীচে চলেছে। এর সঙ্গে সঙ্গে বিজ্ঞানের কদরও কমেছে আজকের বাঙালি সমাজে। ক্রিকেট, ফুটবল, সিনেমায় কারা নায়ক, বাঙালি যুবক খুব ভাল করে জানে বা জানতে ইচ্ছুক। কিন্তু বিজ্ঞানের জগতে কী হচ্ছে, এই বাংলায় সেটা জানবার কোনও স্পৃহা নেই।
বাংলায় মেধাবী ছাত্রছাত্রীর অভাব নেই, কিন্তু সে একা কাজ করবে, সম্মিলিত ভাবে কাজ করা তার ধাতে নেই। আর, সামাজিক এবং রাজনৈতিক কাঠামোটাই এমন হয়েছে যে সেই মেধা পালিয়ে বাঁচে। কোনও এক জন মানুষকে দোষ দিয়ে লাভ নেই।