প্রবন্ধ ২

সব গ্রামে সমান টাকা আসে না কেন?

সরকারি প্রকল্পে বেশি টাকা পেতে হলে চাই শাসক দলের বিধায়ক, আর সক্রিয় গ্রামবাসী। নিয়মিত নজরদারিই উন্নয়নের শর্ত।গ্রামের মানুষের দারিদ্র কমানোর নানা প্রকল্পে গত কয়েক দশকে কেন্দ্রীয় সরকার যত খরচ করেছে, ভারতের ইতিহাসে কখনও তেমন বিপুল খরচ হয়নি। কিন্তু তাতে কাজ কী হয়েছে? সে প্রশ্ন করলে ভাল-মন্দ মেশানো উত্তর মেলে।

Advertisement

আদিত্য দাশগুপ্ত

শেষ আপডেট: ৩১ মে ২০১৬ ০০:০৩
Share:

গ্রামের মানুষের দারিদ্র কমানোর নানা প্রকল্পে গত কয়েক দশকে কেন্দ্রীয় সরকার যত খরচ করেছে, ভারতের ইতিহাসে কখনও তেমন বিপুল খরচ হয়নি। কিন্তু তাতে কাজ কী হয়েছে? সে প্রশ্ন করলে ভাল-মন্দ মেশানো উত্তর মেলে। একশো দিনের কাজের প্রকল্পের কথাই ধরা যাক। কোনও কোনও গ্রামে মহাত্মা গাঁধী জাতীয় রোজগার নিশ্চয়তা প্রকল্প খুব ভাল কাজ করেছে, কোথাও ঠিক মতো পৌঁছতেই পারেনি। অনেক প্রকল্পের ক্ষেত্রেই এই ছবি দেখা যাচ্ছে।

Advertisement

কেন কোনও কোনও এলাকার মানুষ সরকারি প্রকল্পের টাকা বেশি পাচ্ছেন? অন্য এলাকার মানুষ কেন পাচ্ছেন না? এর চটজলদি উত্তর হল, নেতাদের জন্য। তাঁরাই রাজনীতির হিসেব কষে পছন্দের জায়গায় খরচ করেন বেশি, অন্যদের বাদ দেন। কিন্তু তা বললে ধরে নিতে হয়, এলাকার বাসিন্দারা সম্পূর্ণ নিষ্ক্রিয় এবং অসহায়। উপর থেকে কী টাকা এল, তার জন্য তাঁরা চুপচাপ অপেক্ষা করেন। ঘটনা কি তা-ই?

সেটা বুঝতে রাজস্থানে একটি গবেষণা করেছিলাম। তার ফল বলছে, গ্রামবাসী মোটেই টাকার আশায় হাত পেতে বসে নেই। শাসক দলের সঙ্গে সম্পর্ক অবশ্যই টাকা বরাদ্দের পরিমাণ ঠিক করে। কিন্তু সেই সঙ্গে পঞ্চায়েত স্তরে মানুষের সক্রিয়তার উপরেও নির্ভর করে, নেতা-আমলারা পরিষেবা দেওয়ার ব্যাপারে কতটা সজাগ হবেন। বিধানসভা নির্বাচন হয়ে গিয়েছে। কোন রাজনৈতিক দলকে ভোট দিতে হবে, তা নিয়ে চিন্তা শেষ। এ বার সময় দেখতে হবে, গ্রামে তৃণমূল স্তরে গণতান্ত্রিক সক্রিয়তার শক্তি কতটা। এই গবেষণা তা নিয়ে।

Advertisement

রাজস্থানে একশো দিনের কাজের প্রকল্প কেমন কাজ করছে, এই ছিল গবেষণার বিষয়। দেখা গেল, নানা গ্রামে প্রকল্পের কাজে পার্থক্য এতটাই যে চমকে যেতে হয়। উদয়পুর জেলার দুটি প্রত্যন্ত গ্রাম, দুটির দূরত্ব মাত্র ২০ কিলোমিটার। একটাতে একশো দিনের প্রকল্পের কাজের নিদর্শন চোখে পড়ে গ্রাম জুড়ে। তার মধ্যে রয়েছে একটা রাস্তা তৈরির প্রকল্প, যা পাহাড়ের চুড়োয় গ্রামের মন্দির অবধি গিয়েছে। বহু বাসিন্দা, বিশেষ করে মহিলারা জানালেন যে প্রকল্পে কাজ করে তাঁদের রোজগার বেড়েছে। ওই বাড়তি টাকাটা যে তাঁদের খুব দরকার ছিল, তা-ও বললেন তাঁরা। দ্বিতীয় গ্রামটিতে এমন লোক খুঁজে পাওয়াই ভার যে প্রকল্পে কাজ করেছে। দু-এক জন একান্তে জানালেন, পঞ্চায়েত সদস্যদের কাছে তাঁরা জব কার্ড দিয়ে রেখেছেন। ভুয়ো কাজের নথি দেখিয়ে দিনে ২০ টাকা দেওয়া হয় তাঁদের। সত্যিই কাজ করে বেশি টাকা রোজগার করতে পারলে তাঁরা খুশি হতেন, কিন্তু কী করবেন? কিছু করার ক্ষমতা তাঁদের নেই, মনে করেন তাঁরা।

কী পার্থক্য এই দুটি গ্রামে? দুটি ক্ষেত্রেই পঞ্চায়েত প্রধান এবং স্থানীয় বিধায়ক বিজেপি-র। রাজ্যে বিজেপিই ২০১৩ সাল থেকে ক্ষমতাসীন। একশো দিনের কাজের প্রকল্পে কাজ পেতে রাজনৈতিক যে যোগাযোগ দরকার, তা দুটি গ্রামেই সমান। তা হলে? তফাতটা ধরা পড়ল পঞ্চায়েতের কাজ নিয়ে স্থানীয় মানুষের সক্রিয়তায়। যে গ্রামে প্রকল্পটি ভাল কাজ করছে, সেখানে পঞ্চায়েতের কাজ সম্পর্কে স্থানীয় মানুষ রীতিমত ওয়াকিবহাল। অনেকেই জানালেন, তাঁরা পঞ্চায়েতের মিটিং-এ নিয়মিত যান। একটি রাস্তা তৈরির জন্য কত টাকা বরাদ্দ হয়েছিল তা জানতে এক প্রবীণ গ্রামবাসী তথ্যের অধিকার আইন মোতাবেক আবেদন করেছিলেন। তাঁর মনে হয়েছিল, কম টাকায় রাস্তার কাজ সেরে দেওয়া হয়েছে। গ্রামের বাসিন্দাদের এমন নজরদারি পঞ্চায়েত প্রধানের উপর চাপ তৈরি করে। সেই সঙ্গে উপরের স্তরের যে নেতার সঙ্গে প্রধানের চেনা-পরিচিতি, সেই নেতার উপরেও। তার ফলে গ্রামবাসীর যা প্রাপ্য, তা নিয়মিত আসে।

অন্য গ্রামটিতে কথা বলে জানা গেল, গ্রামবাসীদের নিয়ে পঞ্চায়েতের মিটিং হয় না বললেই চলে। নির্বাচন এগিয়ে এলে কয়েকটা লোক-দেখানো গ্রাম সভা হয়। স্থানীয় কিছু ‘দাদা’ গ্রামের রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করছেন, এমনই মনে করেন গ্রামবাসী। তার ফলে নেতাদের দায় এড়ানোর পথ খোলা, কোনও পরিষেবা না দিয়েও তাঁরা পার পেয়ে যাচ্ছেন।

গোটা রাজস্থানে এই নকশাই দেখা যাচ্ছে কি না, তা বুঝতে রাজ্যের ২২৫০ গ্রামীণ গৃহস্থালি নিয়ে একটি সমীক্ষা করি। যে সব নির্বাচনী এলাকায় বিজেপি সাম্প্রতিকতম বিধানসভা ভোটে অল্প ব্যবধানে জিতেছে বা হেরেছে, সেখান থেকে বেছে নেওয়া হয় ওই সব গৃহস্থালি। ফল থেকে দেখা যাচ্ছে, রাজনৈতিক যোগাযোগের সত্যিই গুরুত্ব রয়েছে। বিধায়ক শাসক দলের হলে একশো দিনের কাজের প্রকল্পে কাজের দিন বেশি মিলছে, তাই মজুরিও মিলছে বেশি। কিন্তু এটাও লক্ষণীয় যে, এই বাড়তি কাজ-মজুরি যে সব গ্রাম পাচ্ছে, তাদের প্রায় সকলেই এমন গ্রাম যেখানে পঞ্চায়েতের কাজে মানুষের সক্রিয়তা বেশি। এই সব গ্রামের মানুষদের বয়ান থেকে স্থানীয় প্রশাসনে বেশি যোগদান, বেশি প্রতিযোগিতার সাক্ষ্য মিলেছে।

যেখানে মানুষ বেশি তৎপর ও সরব, কেন সেখানে বেশি টাকা খরচ করছে রাজনৈতিক দলগুলো? এই গবেষণা ইঙ্গিত দিচ্ছে যে, যেখানে গ্রামবাসী সক্রিয় ভাবে গণতান্ত্রিক প্রশাসনে যোগ দিচ্ছেন, সেখানে তাঁরা স্থানীয় নেতাদের উপর চাপ তৈরি করতে পারছেন বেশি। তাঁদের রাজনৈতিক সংযোগ কাজে লাগিয়ে বেশি বরাদ্দ, উন্নত পরিষেবা আদায় করতে পারছেন। এটা গ্রামসভার বৈঠকের কথাবার্তা থেকে স্পষ্ট হয়। যে সব গ্রাম বেশি সক্রিয়, সেখানে সরকারি প্রকল্পে কতটা কাজ হচ্ছে তা নিয়ে আলোচনা হচ্ছে বেশি, গ্রামবাসীদের কথায় তা স্পষ্ট হচ্ছে।

ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে গ্রামের সংযোগের সঙ্গে সঙ্গে গ্রামবাসীর সক্রিয়তাও যে উন্নয়নের প্রকল্পের সফলতার একটি নির্ণায়ক, এ কথাটা আগে সে ভাবে সামনে আসেনি। সমাজ হিসেবে আমরা নির্বাচনের প্রক্রিয়া ও তার ফলাফলকে অত্যন্ত গুরুত্ব দিই। কিন্তু সরকারি পরিষেবা পেতে হলে গ্রাম-স্তরে গণতন্ত্রের শক্তি, গ্রামের মানুষের সক্রিয়তাও যে একটি চাবিকাঠি, সে কথাটা তুলনায় উপেক্ষিত থেকে যাচ্ছে।

কী করে গ্রামের গণতন্ত্রকে সজীব, সক্রিয় করা যায়? উত্তর সহজ নয়। তবে এই সমীক্ষা ইঙ্গিত দেয়, দারিদ্রের তীব্রতা, উচ্চবর্ণের আধিপত্য, সামাজিক বৈষম্য, এগুলো গণতান্ত্রিক সক্রিয়তার নির্ণায়ক নয়। যে গ্রামে মানুষের যোগদান বেশি, সেখানে রাজনৈতিক হিংসা কম, গ্রামবাসীর শিক্ষার হার বেশি। স্পষ্টতই, বুনিয়াদি শিক্ষা আর আইনের শাসন, এই দুটি মৌলিক শর্ত নিশ্চিত করা যে কোনও প্রকল্পের সাফল্যের জন্য জরুরি। রাজস্থানে গ্রামের স্তরে গণতন্ত্রকে সক্রিয় করার কাজটা অনেকটাই করেছে অরাজনৈতিক নাগরিক আন্দোলন। সাধারণ নাগরিকও কি এ বিষয়ে উদ্যোগ নিতে পারেন না?

গবেষক, হার্ভার্ড কেনেডি স্কুল অব গভর্নমেন্ট, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন