অর্থনীতির প্রতিশ্রুতিরক্ষায় নরেন্দ্র মোদী ব্যর্থ হলেন কেন

‘অচ্ছে দিন’ আর এল না

গলদটা গোড়াতেই। এক দিকে প্রত্যাশার ফানুস আর অন্য দিকে তথ্য পরিসংখ্যান থেকে উঠে আসা বাস্তবের অমসৃণ ছবি।

Advertisement

মৈত্রীশ ঘটক

শেষ আপডেট: ২৯ ডিসেম্বর ২০১৮ ০০:০৭
Share:

২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদী স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন পাঁচ বছরে মোদীনমিক্স নামক একটি বুলেট ট্রেনে করে দেশকে উন্নয়নের চোখধাঁধানো এক স্টেশনে পৌঁছে দেবেন। আখ্যানটা দাঁড়িয়েছিল এই যে, দীর্ঘ দিন নেহরুবাদের মিশ্র অর্থনীতির গরুর গাড়ি গ্রাম্য এবড়োখেবড়ো পথে চলেছে শম্বুকগতিতে। মন্থর সেই যাত্রাপথ জটিলতর হয়ে উঠেছে দুর্নীতির কাদায়। তাই অসহিষ্ণু দেশবাসীর একটা বড় অংশ বিজেপির সমর্থক না হওয়া সত্ত্বেও বিশ্বাস করেছিলেন, মোদী তো মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে গুজরাতে উন্নয়নের জোয়ার এনেছেন দক্ষ ও স্বচ্ছ প্রশাসনের জোরে, আমরা ২০০২ সালের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বা হিন্দু মৌলবাদের বিপদ এই সব পুরনো কাসুন্দি না-ই বা ঘাঁটলাম। কে না চায় অচ্ছে দিনের স্বপ্ন দেখতে?

Advertisement

২০১৯ আসন্নপ্রায়। স্বপ্ন আর বাস্তবের মধ্যে তফাত যে এতটা শোচনীয় মাত্রার হবে, তা আমার মতো যাঁরা প্রথম থেকেই মোদীনমিক্সের জাদু নিয়ে অবিশ্বাসী, তাঁরাই ভাবতে পারেননি, তাই সমর্থকদের আশাভঙ্গের জ্বালা অনুমান করা কষ্টসাধ্য নয়। এর সর্বশেষ প্রমাণ হল সাম্প্রতিক রাজ্য নির্বাচনগুলির ফল। গো-বলয়ে গোহারা হয়ে বুলেট ট্রেন তো দূরের কথা, দেশের অর্থনীতির গরুর গাড়ির চাকাগুলো মোদীর আমলে একের পর এক ভুল নীতির ফলে খুলে এসেছে, ছাড়া গরুরা আক্ষরিক ভাবেই পথেঘাটে ঘুরে বেড়াচ্ছে, গোরক্ষকেরা নিরীহ মানুষকে ধরে মারছে, আর ভেল্কি দেখাতে গিয়ে গোলমাল হয়ে গেলে জাদুকরের যেমন হয়, চালককে সে রকমই উদ্ভ্রান্ত আর কোণঠাসা দেখাচ্ছে।

গলদটা গোড়াতেই। এক দিকে প্রত্যাশার ফানুস আর অন্য দিকে তথ্য পরিসংখ্যান থেকে উঠে আসা বাস্তবের অমসৃণ ছবি। যেমন, গুজরাতে আর্থিক বৃদ্ধির হার দেশের গড় বৃদ্ধির হারের থেকে বেশি সেটা ঠিক, কিন্তু এই ফারাকটা নব্বই দশকের গোড়া থেকেই স্পষ্ট ও দীর্ঘমেয়াদি ভাবে আছে, তাতে মোদীর মুখ্যমন্ত্রিত্বের আগে বা পরে উল্লেখযোগ্য কোনও তফাত নেই। আর্থিক উদারীকরণের সময় থেকেই গড়পড়তা আর্থিক আয় ও বৃদ্ধির হার অন্য রাজ্যগুলোর তুলনায় বেশি হলেও দারিদ্র, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও নানা সামাজিক সূচকে গুজরাতের রেকর্ড মাঝারি বা তারও কম। তাই, দোষগুণ নিয়ে গুজরাত মডেল সত্য, কিন্তু তার স্থপতি মোদী— এটা বলার কোনও তথ্যগত ভিত্তি নেই। কিন্তু এই ‘পোস্ট-ট্রুথ’ বা সত্য-উত্তর যুগে তথ্য, গুজব, প্রচার সবই মিলেমিশে কেমন যেন এক, তাই মোদীর মতো শক্তিশালী রাজনৈতিক প্রচারকের প্রতিশ্রুতিতে অনেকেই যে প্রভাবিত হবেন, আশ্চর্য কী।

Advertisement

কী কী ছিল মোদীর নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি? শুধু অর্থনৈতিক বিষয়েই যদি দেখি, প্রতিশ্রুতি আর বাস্তবের খতিয়ানটা খানিকটা এই রকম দাঁড়ায়।

প্রতিশ্রুতি: বিদেশে কালো টাকার ভাণ্ডার এক ঝটকায় নিয়ে এসে প্রতি ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে ১৫ লাখ টাকা জমা করা হবে।

বাস্তব: এই প্রতিশ্রুতিতে মোট যে অঙ্ক দাঁড়ায় তা ভারতের জাতীয় আয়ের ১৪ গুণ আর ভারত সরকারের কৃষ্ণধন নিয়ে শ্বেতপত্র নামক ২০১২ সালের রিপোর্ট অনুযায়ী সুইস ব্যাঙ্কে ভারতীয়দের মোট যে ধন গচ্ছিত আছে তার পঁচিশ হাজার গুণ। এক মুহূর্ত ভেবে দেখলে বোঝা যাবে এ রকম আজগুবি গপ্পো ফাঁদতে ঘনাদাও সাহস পেতেন না। আর, পরে এ নিয়ে প্রশ্ন করা হলে মোদীর ‘চাণক্য’ অমিত শাহ তো বেশ খোলাখুলিই বলেন ও তো ছিল নির্বাচনী জুমলা, অর্থাৎ ফাঁকা প্রতিশ্রুতি মাত্র।

প্রতিশ্রুতি: কায়েমি দুর্নীতির যে নাগপাশে আমাদের অর্থনীতি এবং সাধারণ মানুষের জীবন ঊর্ধ্বশ্বাস, তা থেকে তাকে উদ্ধার করে স্বচ্ছতা আর উদ্যমের জোয়ার আনা হবে।

বাস্তব: বিজয় মাল্য, নীরব মোদী, মেহুল চোক্সীর মতো নামগুলো আজ আমাদের অতিপরিচিত হয়ে উঠেছে, এঁরা সবাই সরকারের সদাজাগ্রত চোখ এড়িয়ে দেশ ছেড়ে পালিয়ে বিদেশে বিলাসবহুল জীবনযাপন করছেন। শুধু তা-ই নয়, রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের প্রাক্তন গভর্নর রঘুরাম রাজন ভারতীয় ব্যাঙ্কগুলির সবচেয়ে বড় জালিয়াতদের এক তালিকা (যার থেকে নেহাতই ঋণ শোধে ব্যর্থ কিন্তু জালিয়াতির কোনও প্রত্যক্ষ প্রমাণ নেই, এমন লোকদের বাদ দেওয়া হয়েছে) পেশ করেন খোদ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে ২০১৫ সালের গোড়ায়, তা আজও গোপনই আছে।

প্রতিশ্রুতি: প্রতি বছর এক কোটি নতুন চাকরি।

বাস্তব: প্রতি বছর চাকরির বাজারে এক থেকে দেড় কোটি সদ্য-প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিক যোগ দেন। শুধু সংগঠিত ক্ষেত্রেই যদি দেখি, সিএমআইই (সেন্টার ফর মনিটরিং ইন্ডিয়ান ইকনমি)-র পরিসংখ্যান অনুযায়ী ২০১৭-১৮ সালে বড়জোর ১৮ লক্ষ নতুন চাকরি হয়েছে, যা প্রতিশ্রুতির তুলনায় নিতান্তই সামান্য। চাকরির বাজারে চাহিদা আর জোগানের অসাম্যের মাত্রা বোঝা যায় সম্প্রতি রেল বিভাগে স্বল্পবেতনের ৯০ হাজার পদের জন্যে আবেদনকারীর সংখ্যা ছিল ২.৩ কোটি। এতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই, বিনিয়োগের হার যদি নিম্নগামী হয়, তা হলে আর ক্রমবর্ধনশীল জনসংখ্যার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চাকরির সংখ্যা বাড়বে কী করে?

প্রতিশ্রুতি: যে আর্থিক বৃদ্ধির হার ইউপিএ-র অন্তিম পর্যায়ে মনমোহন সিংহের বাচনভঙ্গির মতোই নিস্তেজ হয়ে পড়েছিল, তাকে মোদীনমিক্সের চাঙ্গায়নী সুধা খাইয়ে চাঙ্গা করে দেওয়া হবে।

বাস্তব: মোদীর আমলে গড় বৃদ্ধির হার ইউপিএ আমলের হারকে ছাড়াতে পারেনি। অনেক কসরত করে সিএসও (সেন্ট্রাল স্ট্যাটিস্টিক্স অফিস) যে সর্বশেষ পরিসংখ্যান পেশ করেছে তাতে ছবিটা একটু আলাদা, কিন্তু তার নির্ভরযোগ্যতা নিয়ে সকলেই প্রশ্ন তুলছেন, যার মধ্যে সিএসও-র সদ্য অবসরপ্রাপ্ত প্রধান পরিসংখ্যানবিদ টি সি এ অনন্ত-ও আছেন— পদাসীন থাকতে তিনি এই সর্বশেষ সিরিজ় প্রকাশ করার অনুমতি দেননি। বৃদ্ধির হার বাদ দিয়ে অন্য যে কোনও অর্থনৈতিক মাপকাঠি যদি নেওয়া হয়, যেমন বিনিয়োগের হার, কর-রাজস্ব বৃদ্ধির হার, বা নির্বাচিত ভোগ্যদ্রব্য বিক্রির হার, সব ক্ষেত্রেই আগের জমানার তুলনায় অবনতি বই উন্নতি হয়নি।

প্রতিশ্রুতি: কৃষকদের আয় আট বছরে দ্বিগুণ।

বাস্তব: জাতীয় আয়বৃদ্ধির হারে যা ধরা পড়ে না, তা হল গ্রামীণ অর্থনীতির ক্রমবর্ধমান সঙ্কট যার প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে সাম্প্রতিক রাজ্য নির্বাচনের ফলের মধ্যে। এক দিকে জনসংখ্যার অর্ধেক নিযুক্ত কৃষিতে, কিন্তু জাতীয় আয়ের বড়জোর ২০% কৃষি থেকে আসে। গত কয়েক বছরে আয় দ্বিগুণ হওয়া তো দূরের কথা, কৃষিপণ্যের মূল্য এবং মজুরি বৃদ্ধির হার সার্বিক মূল্যবৃদ্ধির হারের তুলনায় কম থাকায় বাস্তব নিরিখে আয় কমেছে বই বাড়েনি। তাই কৃষকদের মধ্যে বিক্ষোভও উত্তরোত্তর বাড়ছে। এক দিকে শিল্প ও পরিষেবায় যথেষ্ট চাকরি তৈরি হচ্ছে না, আর অন্য দিকে কৃষিক্ষেত্রে সঙ্কট— এই সাঁড়াশি চাপে মানুষের প্রাণ ওষ্ঠাগত।

এ তো গেল প্রতিশ্রুতি আর বাস্তবের ফারাক। প্রতিশ্রুতি পূরণ না করতে পারা এক ধরনের ব্যর্থতা ঠিকই, কিন্তু ক্ষতিকর নীতি অবলম্বন করার সম্ভাব্য বিপদ আরও বেশি। প্রধানমন্ত্রী মোদীর আমলে এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ হল নোট বাতিল। অর্থনীতির প্রাথমিক জ্ঞানসম্পন্ন কেউ, তিনি মুক্তবাজারপন্থীই হোন বা মার্ক্সবাদী, কখনও বলবেন না যে দেশে মোট যত মুদ্রা চালু আছে তার ৮৫% হঠাৎ সাময়িক ভাবে হলেও বাতিল জারি করে দেওয়ার ফল ভাল হবে, ঠিক যেমন কোনও ডাক্তার, বদ্যি, হাতুড়ে বা হাকিম কেউই বলবেন না রোগীর রোগ সারাতে তাঁর শরীরের ৮৫% রক্ত হঠাৎ বার করে নিলে ফল ভাল হবে। মুদ্রার ভূমিকা অর্থনীতির শরীরে রক্তের মতোই। তাই এই তুঘলকি নীতির নিট ফল— অন্তত এক বছরের জন্যে আর্থিক বৃদ্ধির হার প্রায় ২% কমে যাওয়া। এর জন্যে জাতীয় আয় যতটা কমেছে, তার পরিমাণ সামরিক অথবা স্বাস্থ্য খাতে মোট বরাদ্দ বাজেটের টাকার থেকে বেশি। আর সর্বশেষ হিসেব অনুযায়ী সংগঠিত ও অসংগঠিত ক্ষেত্র মিলিয়ে প্রায় সাড়ে তিন কোটি লোকের চাকরি এর ফলে যায়। আর এই নীতির মূল যে উদ্দেশ্য—কালো টাকার স্তূপে সার্জিকাল স্ট্রাইক— রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্ক ঘোষণা করেছে প্রায় সব বাতিল টাকা ফেরত এসেছে আর আর্থিক বৃদ্ধির হারে কোনও তেজ না থাকাতেও স্টক মার্কেটে রমরমা চলছে, কারণ কালো টাকা সাদা হয়ে এখন সিন্দুক আর সুটকেস ছেড়ে মিউচুয়াল ফান্ডে খাটছে।

তবে শেষ বিচারে অর্থনীতির স্বাস্থ্য তো শুধু সরকারি নীতি বা আয়ের সাময়িক ওঠাপড়া দিয়ে ধরা পড়ে না। ইতিহাসের শিক্ষা হল, ভিত যদি শক্ত হয়, উন্নয়নের পথ সুদীর্ঘ হলেও অপরিক্রমণীয় নয়, সে ট্রেনেই হোক কী গরুর গাড়িতে। মোদী জমানায় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের স্বাধীনতা বার বার যে ভাবে লঙ্ঘিত হয়েছে, যার সর্বশেষ উদাহরণ রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের গভর্নরের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই আকস্মিক পদত্যাগ, এবং নানা ভাবে সামাজিক সংহতি যে ভাবে বিপন্ন হয়েছে, দীর্ঘমেয়াদি হিসেবে সবচেয়ে বড় দুশ্চিন্তার কারণ সেখানেই।

লন্ডন স্কুল অব ইকনমিক্স-এ অর্থনীতির শিক্ষক

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন