প্রবন্ধ ১

পাকিস্তানকে সমুচিত জবাব? থাকলে তো!

এমন কোনও জবাব দিল্লির হাতে নেই, যা পাকিস্তানের সেনানায়কদের নিরস্ত করতে পারে। বরং শাহ-মোদীর রাজত্বে পাকিস্তান-বিরোধিতা যে ভাবে গণ-উন্মত্ততার চেহারা নিচ্ছে, তাতে সীমান্তের ও পারে উর্দির প্রতিপত্তি আরও বাড়বে।এমন কোনও জবাব দিল্লির হাতে নেই, যা পাকিস্তানের সেনানায়কদের নিরস্ত করতে পারে। বরং শাহ-মোদীর রাজত্বে পাকিস্তান-বিরোধিতা যে ভাবে গণ-উন্মত্ততার চেহারা নিচ্ছে, তাতে সীমান্তের ও পারে উর্দির প্রতিপত্তি আরও বাড়বে।

Advertisement

অনির্বাণ চট্টোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ১৮ অক্টোবর ২০১৬ ০০:০০
Share:

নিশানা। নিয়ন্ত্রণরেখার ও পারে পাকিস্তানের সেনা। অক্টোবর ২০১৬। ছবি: এপি।

দিকে দিকে সেই বার্তা রটি গেল ক্রমে। পাকিস্তানকে সমুচিত জবাব দিতে হবে। বলিউডি বয়কট থেকে সার্জিকাল স্ট্রাইক, নানান ফ্রন্টে নানান জবাব অব্যাহত। তার কতটা বাস্তব, কতটা চিত্রনাট্য, তেনারাই জানবেন। জঙ্গি হানা রুখতে গিয়ে গোটা দেশটাকেই মনে মনে জঙ্গি করে তোলার জন্যে ধুন্ধুমার চেষ্টাও চলছে, চলবে। একা রাষ্ট্রে রক্ষে নেই মিডিয়া দোসর।

Advertisement

কিন্তু দৈনন্দিন চিৎকার থেকে ঈষৎ তফাতে দাঁড়ালে মনে একটা সংশয় দেখা দেয়। জবাব কখন সমুচিত হয়? মোদী-শাহ— না কি, শাহ-মোদী— যাকে সমুচিত জবাব বলে মনে করছেন, যাদের জবাব দেওয়া হল তারাও তেমনটাই মনে করছে কি? তা যদি না হয়? আমরা ভাবলাম ওদের মুখে ঝামা ঘষে দিয়েছি আর ওরা তাতে ভ্রূক্ষেপ করল না, সে তো বেশ করুণ ব্যাপার। অতএব দিল্লীশ্বরদের ভেবে দেখা ভাল, তাঁরা কী করলে ইসলামাবাদের শিক্ষা হবে, তারা নিজেদের পরাজিত মনে করবে?

সি ক্রিস্টিন ফেয়ার বলবেন, ইসলামাবাদ নয়, রাওয়ালপিন্ডি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এই রণনীতিবিশারদের মতে, পাকিস্তানের রাষ্ট্রশক্তি অংশত রাজনীতিকদের হাতে থাকলেও সেই রাষ্ট্রের ধ্যানধারণাগুলি সামরিক কর্তাদের নিয়ন্ত্রণে। সে দেশের এক প্রাক্তন সেনাকর্তার ভাষায় বললে, সব দেশের হাতেই সেনাবাহিনী থাকে, পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর হাতে একটি দেশ আছে। রাষ্ট্র নয় কিন্তু, দেশ।

Advertisement

তার মানে এই নয় যে, পাকিস্তানে ভিন্নমত নেই। এমনও নয় যে সে দেশের মানুষ গণতন্ত্র চান না, ফৌজি শাসনই তাঁদের অভীষ্ট। বস্তুত, আয়ুব খান থেকে পারভেজ মুশারফ, সেনানায়করা যে বারংবার নির্বাচনের নামে নিজেদের বৈধতা জাহির করতে তৎপর হয়েছেন, এবং এখন যে সেনাকর্তারা নওয়াজ শরিফকে শিখণ্ডী থেকে ক্রমশ শিখণ্ডীতর করে চললেও তাঁর আসনটি কেড়ে নিয়ে নিজেরাই সরকার অধিগ্রহণ করেননি, সেটা বুঝিয়ে দেয়, পাকিস্তানে সমাজ, রাজনীতি এবং উর্দির টানাপড়েন জারি আছে, হয়তো বেড়েছে।

কিন্তু কেবল রাষ্ট্র এবং রাজনীতিক নয়, সে দেশের সমাজও সেনানায়কদের চিন্তাভাবনাকে অনেকখানি আত্মস্থ করে নিয়েছে। বিশেষ করে, ভারত সম্পর্কে রাষ্ট্র ও সমাজের ধারণায় সামরিক বাহিনীর প্রভাব খুব গভীর। নাগরিকদের সকলের ভারতদর্শন নিশ্চয়ই এক ছাঁচে ঢালা নয়, অন্য ধারণাও আছে, কিন্তু পাকিস্তানের সীমিত এবং দুর্বল গণতন্ত্রে সেই ভিন্নমতের নাগাল খাটোই থেকে যায়, রাষ্ট্রনীতিতে তার বিশেষ ছাপ পড়ে না, পড়ার সুযোগ নেই, সে-নীতি চলে ফৌজদারদের চিন্তার সড়ক ধরে।

ক্রিস্টিন ফেয়ার সেই চিন্তার প্রকৃতি বুঝতে চেয়েছেন। সেনাকর্তা থেকে রণনীতিবিশারদ, বহু মানুষের সঙ্গে কথা বলার পাশাপাশি তিনি আর একটি কাজ করেছেন, যা সচরাচর কেউ করেন না। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর নিজস্ব পত্রপত্রিকা ও রিপোর্ট খতিয়ে দেখেছেন। সেই গবেষণার ভিত্তিতে তাঁর সিদ্ধান্ত, পাকিস্তানের সেনানায়কদের কাছে ‘পরাজয়’ কথাটার একটি বিশেষ অর্থ আছে। ভারতের সঙ্গে ছোট লড়াইয়ে মার খেলে বা বড় যুদ্ধে হেরে গেলেও তাঁদের মৌলিক কোনও সমস্যা নেই। তাঁরা মনে করেন, উপমহাদেশে ভারত যে আধিপত্য ভোগ করে এবং বৃহত্তর দুনিয়ায় ক্রমশ তার গুরুত্ব যে ভাবে বাড়ছে, সেটা পাকিস্তানের স্বার্থের প্রতিকূল, এই বাস্তবকে তাঁরা মানতে পারেন না, তাকে ক্রমাগত চ্যালেঞ্জ জানিয়ে যাওয়াই তাঁদের কর্তব্য। যতক্ষণ তাঁরা ভারতের বিরুদ্ধে নানা ভাবে আঘাত জারি রাখতে পারবেন, ততক্ষণ নিজেদের পরাজিত মনে করবেন না। এই কারণেই ওঁরা কাশ্মীর সমস্যার মীমাংসা হতে দেন না, এই কারণেই ভারতে সন্ত্রাসের মেগা-সিরিয়াল চালাতে ইন্ধন জুগিয়ে যান, এই কারণেই নিয়ন্ত্রণরেখা পেরিয়ে হানাদারি চলতে থাকে।

এবং এই কারণেই পারমাণবিক অস্ত্র পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর কাছে এতটা মূল্যবান। ওই অস্ত্র তাদের মোক্ষম একটি ছাতা দিয়েছে। সেই ছাতার নীচে দাঁড়িয়ে তারা অনেক দূর অবধি অ্যাডভেঞ্চার করতে পারে, তারা জানে ভারতের পক্ষে বড় রকমের প্রতি-আক্রমণ সম্ভব হবে না, দিল্লি চাইলেও মস্কো-ওয়াশিংটন তাকে নিরস্ত করবে। এটা কোনও কাকতালীয় ঘটনা নয় যে পারমাণবিক ১৯৯৮-এর পরে ভারতে সন্ত্রাসী হানা অনেক বেড়ে গেছে। সম্ভবত বেড়ে চলবে। ভারত প্রতিরোধ করবে, প্রত্যাঘাত করবে, হয়তো বা সত্যি সত্যিই দু’একটা সার্জিকাল স্ট্রাইকও হবে। পাকিস্তানের ক্ষয়ক্ষতি হবে। কিন্তু তাতে রাওয়ালপিন্ডির কিচ্ছু যায় আসে না। দুই প্রতিবেশীর সওয়াল-জবাবের সাম্প্রতিক ইতিবৃত্ত ক্রিস্টিন ফেয়ারের এই সিদ্ধান্তকে সমর্থন করে। জোরালো সমর্থন।

কিন্তু সমুচিত জবাবের তবে কী হবে? হবে না। এমন কোনও জবাব দিল্লির হাতে নেই, যা পাকিস্তানের সামরিক কর্তাদের নিরস্ত করতে পারে। সুতরাং তাঁরা কোনও অবস্থাতেই নিজেদের পরাজিত মনে করবেন না। তাঁদের উচিত শিক্ষা দিয়ে শেষ দেখে ছাড়ার কোনও উপায়ই শাহ-মোদীদের হাতে নেই, কারণ এখানে কোনও শেষ নেই। অবশ্য তাঁরা যদি সত্যিই ‘চূড়ান্ত আক্রমণ’-এর কথা ভাবেন, তবে একটা উপসংহার আছে বটে। দুই পারমাণবিক শক্তির সম্মুখসমরের শীতল সমাপ্তি।

কাণ্ডজ্ঞান যা বলে, ক্রিস্টিন ফেয়ারের বইটিতে তারই প্রতিধ্বনি শুনি। পাকিস্তানের সঙ্গে সমস্যা মিটিয়ে ফেলার কোনও তাৎক্ষণিক উপায় নেই। সমস্যাটাকে নিয়ন্ত্রণে রাখা জরুরি। আর তার পাশাপাশি সে দেশের সঙ্গে সামাজিক, রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রীয় স্তরে সংযোগ ও লেনদেন বাড়িয়ে চলা জরুরি। বিশেষ করে, দু’দেশের মানুষের পারস্পরিক যোগসূত্রগুলি সর্বস্তরে যত জোরদার হবে, পাকিস্তানের সমাজের চিন্তায় ও দৃষ্টিতে সামরিক বাহিনীর প্রভাব তত কমবে। অন্তত কমতে পারে। দীর্ঘমেয়াদি শান্তির প্রতিষ্ঠায় সেটাই একমাত্র ভরসা।

ঘটছে ঠিক উল্টো। মোদীর রাজ্যে পাকিস্তান-বিরোধিতা যে ভাবে গণ-উন্মত্ততার চেহারা নিচ্ছে, সে দেশের সেনা বা রাষ্ট্রের সঙ্গে সাধারণ মানুষ, শিল্পী, সাহিত্যিক, অভিনেতা, গায়কদের একাকার করে যে ভাবে তাঁদের বিরুদ্ধে পাইকারি শত্রুতার তোপ দাগা হচ্ছে, তার একটা পরিণাম অনিবার্য— পাকিস্তানে ভারতের প্রতি বিরূপতা দ্রুত বাড়বে। এবং তার ফলে সে দেশে সমাজের ভারতদর্শনে সেনাবাহিনীর প্রভাব আরও গভীর এবং জোরদার হবে। যাঁরা সেই দর্শনের বিরুদ্ধে একটা সুস্থ অবস্থান নিতে চান, তাঁদের কাজটা আরও কঠিন হয়ে উঠবে।

হ্যাঁ, আর একটা কাজও হবে। সীমান্তের ও পারে নয়, এ পারে। আমরা দ্রুত, অতি দ্রুত চিন্তাভাবনায় সামরিক হয়ে উঠব। উঠছি। সে জন্য এ দেশের সেনাকর্তাদের পরিশ্রম করতে হয়নি, আমাদের শাসককুল— এবং সংবাদমাধ্যমে ও নাগরিক সমাজে তাঁদের অত্যুৎসাহী সহমর্মীরা— কব্জি ডুবিয়ে সেই দায়িত্ব পালন করছেন। আশা রাখি, অচিরেই জবাব দিতে পারব: আমাদের সেনাবাহিনীর হাতেও একটি দেশ আছে। সমুচিত জবাব।

ফাইটিং টু দি এন্ড, সি ক্রিস্টিন ফেয়ার। অক্সফোর্ড

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন