সম্পাদকীয়

খরিদ-পাগলিনি?

এই একছাঁচি ও ছকবন্দি ধারণার মধ্যে নারীর প্রতি কিঞ্চিৎ অপমান আছে। নারী সতত বস্তুলোভী ও অমিতব্যয়ী (বিশেষত অর্থটি নিজের উপার্জিত না হইলে)— এই ধারণাকেই রূপ দেওয়া হইয়াছে এই খরিদ-পাগলিনি মূর্তিটি গড়িবার সময়। পুরুষরা কেবল পৃথিবীর গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারগুলি লইয়া চিন্তিত, নারীরা নূতন বেডকভার পাইলেই সকল ভুলিয়া আত্মহারা— এই ব্যঞ্জনাও রহিয়াছে।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৩ জুলাই ২০১৭ ০০:০০
Share:

দোকানে স্ত্রীর সহিত ঘুরিতে ঘুরিতে ক্লান্ত ও বিরক্ত স্বামীদের জন্য সাংহাইয়ের একটি শপিং মল স্বতন্ত্র কিছু আরামপ্রদ বিশ্রামস্থলের বন্দোবস্ত করিল। সেইখানে থাকিবে মালিশ-কেদারা, ভিডিয়ো গেম খেলিবার ব্যবস্থা, অবশ্যই টেলিভিশন। সংস্থাটির আশা, অনেক পুরুষই স্ত্রীকে বলিবেন, তুমি যথেচ্ছ দোকানবাজার করো, আমি এইখানে অপেক্ষা করিতেছি। ধীরে ধীরে ইহার চাহিদা বাড়িবে এবং পুরুষরা মল-এ যাইবার বহু পূর্বেই ফোনের অ্যাপ-এর মাধ্যমে এই কাচ-নির্মিত সুদৃশ্য কক্ষের একটি কেদারা সংরক্ষিত করিবেন। ঠিকই, এই দৃশ্য বিরল নহে: স্ত্রী মহোৎসাহে একের পর এক দোকানে পণ্য পরখ করিয়া বেড়াইতেছেন ও কিনিতেছেন এবং স্বামী ঘণ্টার পর ঘণ্টা বিরস বদনে শ্লথ চরণে স্ত্রীর অনুগমন করিতেছেন। স্ত্রী বিভিন্ন বস্তু ও তাহার মূল্য বিষয়ে স্বামীর মতামত চাহিতেছেন এবং স্বামী দায়সারা উত্তর দিতেছেন এবং ক্রীত বস্তুগুলিকে বহিয়া বহিয়া হাঁটিতেছেন। ইহা লইয়া রসিকতা, ব্যঙ্গচিত্র, কাহিনিবিন্যাস কিছু কম নাই। বহু চলচ্চিত্রে এমন দৃশ্য দেখা গিয়াছে, যেখানে নারীটি একের পর এক পোশাক বদল করিয়া নূতনটি পরিয়া পুরুষ সঙ্গীকে দেখাইতেছেন এবং পুরুষটির মাথা গুলাইয়া গিয়াছে, কোনটি ভাল কোনটি মন্দ হিসাব রাখিতে পারতেছেন না। এই সময়ে সুবিদিত ভাবেই স্বামীদের মনে হয়, বাড়িতে আরাম করিয়া বসিয়া পপকর্ন চিবাইতে চিবাইতে টিভি দেখিলে জীবন অধিক সারবান ও তাৎপর্যপূর্ণ হইত।

Advertisement

এই একছাঁচি ও ছকবন্দি ধারণার মধ্যে নারীর প্রতি কিঞ্চিৎ অপমান আছে। নারী সতত বস্তুলোভী ও অমিতব্যয়ী (বিশেষত অর্থটি নিজের উপার্জিত না হইলে)— এই ধারণাকেই রূপ দেওয়া হইয়াছে এই খরিদ-পাগলিনি মূর্তিটি গড়িবার সময়। পুরুষরা কেবল পৃথিবীর গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারগুলি লইয়া চিন্তিত, নারীরা নূতন বেডকভার পাইলেই সকল ভুলিয়া আত্মহারা— এই ব্যঞ্জনাও রহিয়াছে। তলাইয়া ভাবিলে বুঝা যায়, দোকানপাট করিবার সময় নারীর দিগ্বিদিকজ্ঞানশূন্য অবস্থাটিকে ধ্রুব ধরিয়া লইলে এই তত্ত্ব খুব দূরে থাকে না যে, নারীরা অপরিণতমনস্ক, অগভীর, তাঁহারা অকিঞ্চিৎকর প্রয়োজনগুলি লইয়া অধিক উৎসাহী, এবং অবান্তর বিষয়ে জীবনীশক্তি ও চিন্তাক্ষমতা ব্যয় করিবার এই পাতি-ধর্মই তাঁহাদের মূল সুর। পুরুষেরা ইহা লইয়া তিতিবিরক্ত হইয়াও, সস্নেহ প্রশ্রয়ে নারীদের সঙ্গ দিয়া থাকেন, কারণ বিবাহ তাঁহাদের এই কর্তব্যে আনয়ন করিয়াছে, এবং চরিত্রগত মহত্ত্বের কারণে তাঁহারা এই জোয়াল টানিয়া চলিয়াছেন। তাই পুরুষেরা অধিক কাণ্ডজ্ঞানসম্পন্ন, এবং কাণ্ডজ্ঞানহীনাকে সঙ্গ দিবার প্রশ্নেও প্রবল উদার।

কিন্তু শপিং মল-এ ঘুরিয়া বেড়াইতে, বৈভবের আঁচ পোহাইতে, কল্পনায় নিজেকে বহু বস্তুর অধিকারী ভাবিতে, এবং সাধ্যের মধ্যে, এমনকী সাধ্যের কিছু বাহিরে গিয়াও কয়েকটি পণ্য কিনিয়া ফেলিতে পুরুষেরা কি কম উৎসাহী? তাঁহাদের বস্তুগত লোভ কিছু কম? গৃহস্থালির দ্রব্যে লোভ যদি বা ন্যূন হয়, অন্য বস্তুর প্রতি তাঁহাদের আকর্ষণ কি প্রবল নহে? শাড়ি কিনিবার সময় স্ত্রীকে সঙ্গ দিতে তাঁহাদের মুখ যেমন বিমর্ষ হইয়া যায়, শার্ট কিনিবার সময় একের পর এক নকশা বর্ণ ছাঁদ প্রত্যাখ্যান করিতে করিতে তাঁহাদের অসংখ্য বিপণিময় অনন্ত অভিযানে সঙ্গ দিবার কালে স্ত্রীর কি সমান তিক্ত লাগে না? হইতে পারে, স্ত্রীরা সেই বিরক্তি গোপন করিতে বা বিরক্তিকে প্রশ্রয় না দিয়া যথার্থ বন্ধুতা প্রকাশ করিতে সক্ষম ও উৎসুক? হইতে পারে, স্ত্রীরাই প্রকৃত উদার এবং এমনকী নিজ গাত্রে অন্যায় টিপ্পনী সহিতেও প্রস্তুত? হইতে পারে, একছাঁচি ধারণার বশবর্তী না হইবার প্রতিজ্ঞায় স্ত্রীরাই প্রকৃত গভীর ও আধুনিক? আবার ইহাও হইতে পারে, বেশ কিছু সংখ্যক পুরুষ স্ত্রীর সহিত বেড়াইতে বেড়াইতে জিনিস কিনিতে পছন্দ করেন এবং স্ত্রীর হাসিখুশি সঙ্গটি তিনি রীতিমত উপভোগ করেন। স্ত্রী কিছু কিনিতে গেলেই তাঁহার মনে হয়, একযোগে সিদ্ধান্ত লইয়া কিনিলে, পণ্যের ভার ভাগাভাগি করিয়া লইলে, দ্রব্য সজ্জা মূল্যবৃদ্ধি বিষয়ে মতামত বিনিময় করিলে, সেই সময়টি তাঁহাদের নিকট উজ্জ্বল হইয়া থাকে। বিরক্ত হওয়া তো দূরের কথা, তাঁহারা হয়তো এই মল-এর ক্রয়সময়ের দিকে অধীর প্রতীক্ষায় তাকাইয়া থাকেন? সম্ভাবনা প্রচুর, প্রশ্নও বহু। পুরুষ ও স্ত্রী নির্বিশেষে শপিং-বিধ্বস্ত মনুষ্যের জন্য কয়েকটি কাচের কক্ষ গড়িয়া রাখিলেই ঝঞ্ঝাট মিটিয়া যায়।

Advertisement

যৎকিঞ্চিৎ

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক বলল, মোদীকে স্বাগত জানাতে এ বার থেকে ফুলের তোড়া দেওয়া যাবে না। মোদীও বলেছেন, তিনি খাদির রুমাল বা বই পেতে বেশি পছন্দ করবেন। সত্যিই, ফুল খুব সুন্দর, কিন্তু প্রাথমিক আহ্লাদের পর ডাস্টবিনে ছুড়ে দিতে হয়। কিন্তু বই পড়া যায়, রুমাল ব্যবহার করা যায়, আর ফুল পাকিয়ে ছিঁড়ে নেওয়া বন্ধ হলে গাছের কষ্টও কিছু কমে। জগদীশচন্দ্র থাকলে খুব খুশি হতেন। অবশ্য বইয়ের ব্যাপারটায় ভুরু কুঁচকে যেতে পারত, তার পাতাও তো গাছ থেকেই!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন