কমিউনিস্ট আদর্শে জান দিয়েছেন মেয়েরা, নেতৃত্ব পাননি

কমরেড দিদি, কার মিছিলে হাঁটছেন, কার পতাকা নিয়ে

নভেম্বর বিপ্লবের অন্যতম সাফল্য রাশিয়ায় মহিলা নেতৃত্ব তৈরি করা ও নারীস্বাধীনতার বাস্তবায়নের মরিয়া প্রচেষ্টা চালানো। সেখানে নাদেজ্দা ক্রুপস্কায়াকে শুধু লেনিন-পত্নী হয়ে থাকতে হয়নি।

Advertisement

সোনালী দত্ত

শেষ আপডেট: ১৬ নভেম্বর ২০১৭ ০০:০০
Share:

শ্রোতা: ধর্মতলায় মেট্রো চ্যানেলে বামপন্থী মহিলা সংগঠনের সমাবেশ। কলকাতা, ২৫ নভেম্বর ২০১০

রাশিয়ায় নভেম্বর বিপ্লবের একশো বছর পূর্ণ হল। এ নিয়ে অনেক চর্চা, ঠিক-ভুলের অনেক চুলচেরা বিশ্লেষণ চলছে। এই ঘটনার ঐতিহাসিক গুরুত্ব প্রশ্নাতীত। ৩৪ বছর লাল ঝান্ডার নীচে থাকা পশ্চিমবঙ্গে বামপন্থার এই ভাটার জমানাতেও একশো পতাকা নিয়ে জেলায় জেলায় মিছিল বেরোচ্ছে। স্লোগান উঠছে। অঙ্গীকার চলছে। আর এই সব মিছিলের সামনের সারিতেই দেখা যাচ্ছে গুটিকতক, বা কোথাও কোথাও সংখ্যায় বেশি মহিলাকে, যাঁদের আমরা আগেও এই ভাবেই বহু মিটিং মিছিলে দেখেছি। এঁরা অনেক সময় আবার লালপাড় সাদা শাড়ি পরে পতাকা ধরেন, শাঁখে ফুঁ দেন, দাদাদের সঙ্গে গলা মিলিয়ে স্লোগান তোলেন, শাড়িতে ব্যাজ লাগিয়ে স্বেচ্ছাসেবক হন, গণসংগীতে গলা মেলান ও মঞ্চে সভাপতি, বিশেষ অতিথি প্রমুখ কমরেডকে পুষ্পস্তবক দিয়ে বরণ করেন হাসিমুখে। এঁদের বক্তৃতা দিতে, নেতৃত্ব দিতে, সিদ্ধান্ত নিতে কিন্তু খুব কমই দেখা যায়।

Advertisement

নভেম্বর বিপ্লবের অন্যতম সাফল্য রাশিয়ায় মহিলা নেতৃত্ব তৈরি করা ও নারীস্বাধীনতার বাস্তবায়নের মরিয়া প্রচেষ্টা চালানো। সেখানে নাদেজ্দা ক্রুপস্কায়াকে শুধু লেনিন-পত্নী হয়ে থাকতে হয়নি। আলেক্সান্দ্রা কোলোনতাইয়ের মতো নেত্রী উঠে এসেছেন লড়াই করে। এলিসারোভা, কুদেলি, সামোইলোভা, নিকোলায়েভা প্রমুখ অনেক মহিলা কমিউনিস্ট আন্দোলনের পুরোভাগে থেকে জনতাকে পথ দেখিয়েছেন। ১৯১৭ সালের পর দু’বছরের মধ্যে লক্ষ লক্ষ রাশিয়ান মহিলা শ্রমের জগতে নিজেদের প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন। সেনাবাহিনীতেও অনেকে লড়াই করেছেন। বিশ্বের প্রথম দেশ হিসেবে রাশিয়ার নারী গর্ভপাতের অধিকার পেয়েছেন। মাতৃত্বের অধিকারকে সম্মান দিয়ে ১৬ সপ্তাহের মাতৃত্বকালীন ছুটি মঞ্জুর হয়েছে। এমন বহু প্রগতিশীল পদক্ষেপ করা গিয়েছে, কারণ প্রশাসনে ও পার্টিতে নেত্রীর অভাব ছিল না।

আমাদের দেশের স্বীকৃত কমিউনিস্ট দলগুলি নভেম্বর বিপ্লব নিয়ে বক্তব্য পেশ করে, বই লেখে, সেমিনার করে। মহিলা কমরেডদের বিষয়ে সেই সব দলের নেতাদের উদাসীনতা কিন্তু সত্যি চোখে পড়ার মতো। মিছিলের লাইন ভরানো, মিটিংয়ের প্রেক্ষাগৃহে ফাঁকা আসনে বসা ছাড়া এই সব দলে মহিলাদের ভূমিকা কী, এই প্রশ্ন বার বার উঠেছে। যে কতিপয় মহিলা নেতৃত্বে গিয়েছেন, তাঁরাও প্রসঙ্গটি নানা ভাবে নানা জায়গায় তুলেছেন। আলোচনা হয়েছে, সিদ্ধান্ত হয়েছে, কাজের কাজ কিছু হয়নি। অথচ এই দলগুলি মহিলাদের ক্ষমতায়নের কথা বলে, পুরুষ নারীর সমানাধিকারের কথা বলে, পার্লামেন্টে নারী সদস্যের জন্য তেত্রিশ শতাংশ আসন সংরক্ষণের কথাও বলে।

Advertisement

শাসনবিভাগে গড়ে দশ শতাংশের বেশি মহিলাকে ভারত কোনও কালে বরদাস্ত করেনি। কমিউনিস্ট দলগুলি যেন ওই সংখ্যা ছুঁতেও নারাজ। বাংলায় বামফ্রন্টের শেষ মন্ত্রিসভায় ক্যাবিনেট সদস্যদের মধ্যে রেখা গোস্বামী ছাড়া আর কোনও মহিলা ছিলেন না। গত লোকসভা নির্বাচনে ৪২ জন প্রার্থীর মধ্যে এ রাজ্যের বামেরা ৬ জনের বেশি মহিলা প্রার্থী দেননি। শ্রীমতী গোস্বামী এক সাক্ষাৎকারে স্বীকার করেছেন, তৃণমূল স্তর বা জেলা স্তরে পার্টি নেতৃত্বকে মহিলাদের নেতৃত্বের গুরুত্ব বোঝানোই যায়নি। তা হলে কি দলের উপরের স্তরের নেতারা তা বুঝেছেন? অন্যান্য বাম দলের কথা তো ছেড়েই দিলাম। খোদ সিপিআইএম-এর কেন্দ্রীয় কমিটির ৭৫ জন সদস্যের মধ্যে মহিলা মাত্র ৫ জন। আর পলিটব্যুরো? সেখানে তো ২০০৫ সালের আগে কোনও মহিলা সদস্যই ছিলেন না। ওই বছর প্রকাশ কারাট সাধারণ সম্পাদক হন। পলিটব্যুরোতে আসেন তাঁর স্ত্রী বৃন্দা কারাট। এ ক্ষেত্রে স্বজনপোষণের অভিযোগ অসংগঠিত ভাবে উঠেছে, তবু এও সত্যি যে, প্রকাশ যেখানে ১৯৯২ সাল থেকে পলিটব্যুরো সদস্য, সেখানে বৃন্দাকে অপেক্ষা করতে হল এত বছর। এখন মহিলা সদস্য বেড়ে হয়েছেন ২ জন। সুশিক্ষিত রাজ্য কেরলেও চিত্র কিন্তু একই রকম। কেরলের বাম গণতান্ত্রিক ফোরাম গত নির্বাচনে ১৪০ জনে মহিলা প্রার্থী দিয়েছিল ১৭ জন। এমনকী জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ে বামপন্থী ছাত্র সংগঠন ‘আইসা’র নেতৃত্বেও মেয়েরা নিতান্ত সংখ্যালঘু।

সাফাই গাইবার লোকের কিন্তু অভাব নেই। কেউ বলেন, বাম দলে মহিলা নেত্রী আছেন, মিডিয়া দেখায় না। কেউ বলেন, সকলকেই কি নেতা হতে হবে? কর্মীর গুরুত্ব নেই? আবার কেউ কেউ এও বলেন, গোকুলে মহিলা নেত্রী তৈরি হচ্ছেন। সময় হলেই মঞ্চে অবতীর্ণ হবেন। তাঁদের অবগতির জন্যে জানাই, ১০ লক্ষ ৬০ হাজার পার্টিকর্মীর মধ্যে মাত্র ১৫.৫ শতাংশ মহিলা। এঁদের বাইরে অবশ্যই কর্মী বা নেতা হওয়ার মতো পার্টি-দরদি মহিলা অনেক আছেন, কিন্তু তাঁদের যে দলে আনা যায়নি, এ ব্যর্থতা কার? আর স্বাধীনতার সত্তর বছর পরেও যে কমিউনিস্ট দলে মহিলা নেতৃত্ব ভ্রূণ স্তরে থেকে গেল, তার দায় থেকেও কিন্তু দলের পুরুষ নেতারা মুক্তি পাবেন না। কেতাবি নারীমুক্তি নিয়ে কতিপয় নেত্রী যতই ভাষণ দিন, মনে মনে তাঁরাও জানেন দলে তো বটেই, এমনকী গণসংঠনেও যে ক’জন মহিলা পরিচালনার দায়িত্বে আছেন তাঁদের অনেকের কাজ শুধুই হাত তোলা। সিদ্ধান্ত নেওয়া বা নস্যাৎ করা, কোনও ক্ষেত্রেই (কিছু ব্যতিক্রম বাদ দিলে) তাঁরা স্বনির্ভর নন।

এমনটি হওয়ার কথা ছিল না। এ দেশের কমিউনিস্ট আন্দোলন গীতা মুখোপাধ্যায়, কল্পনা দত্ত, মণিকুন্তলা সেন, লক্ষ্মী সহগল, শহিদ লতিকা সেন, অমিয়া দত্ত প্রমুখকে দেখেছে। স্বাধীনতার আগে অত্যন্ত সক্রিয় ‘মহিলা আত্মরক্ষা সমিতি’ দেশের মুক্তিসংগ্রামে অতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছে। তারই ধারাবাহিকতা আমরা ‘গণতান্ত্রিক মহিলা সমিতি’তে দেখেছি। খাদ্য আন্দোলন, তেলঙ্গানা, তেভাগার ইতিহাস অহল্যা মা, রাসমণি প্রমুখের আলোয় আজও উজ্জ্বল। পঞ্চায়েত বা পুরসভা, যেখানে বামেরা পুরুষের সমসংখ্যায় (৫০ শতাংশ) মেয়েদের কাজ করার সুযোগ দিয়েছেন, সেখানে দক্ষতায় অনেক সময় তাঁরা পুরুষকেও ছাড়িয়ে গিয়েছেন। তবু দল থেকে প্রশাসনের উপরিস্তরে, সর্বত্র মেয়েদের ব্রাত্য করে রাখার ‘পৌরুষ’ থেকে এ দেশের গণতান্ত্রিক বাম আন্দোলন মুক্ত হতে পারেনি। মুখে সমানাধিকারের কথা বললেও মনে মনে অনেক বাম কর্তাই মেয়েদের ‘কমরেড’ ভাবতে পারেন না। কাজেই নভেম্বর বিপ্লবের শতবর্ষের স্মারক একশো লাল পতাকার একটিও যদি কোনও মহিলার হাতে ওঠে, সময় তাঁকে এই প্রশ্ন করবেই: আপনি কার মিছিলে হাঁটছেন, কমরেড দিদি? কার পতাকা হাতে?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন