সম্পাদকীয় ১

কাজ ও বৈষম্য

সম্ভবত বেসরকারি সংস্থাগুলির সর্বাপেক্ষা বড় দুর্বলতা চুক্তি-শ্রমিকদের কল্যাণের ব্যবস্থায়। সংগঠিত ক্ষেত্রেও যে অসংগঠিত শ্রমিক বাড়িতেছে, তাহা প্রতীয়মান।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০২ মার্চ ২০১৮ ০০:২৭
Share:

সামাজিক ন্যায় এবং দুর্বলের উন্নয়নে কতটা তৎপর ভারতের প্রথম সারির ব্যবসায়িক সংস্থাগুলি? তাহারা সরকারি বিধি মানিয়া ‘সামাজিক দায়িত্ব’ খাতে ব্যয় করিতেছে ঠিকই। কিন্তু স্কুলে শৌচাগার গড়িয়া, গাছ লাগাইয়া, বাঘ বাঁচাইয়াই কি তাহাদের কর্তব্য শেষ? সংগঠিত কর্মক্ষেত্রে প্রান্তবাসীর অন্তর্ভুক্তি, কর্মক্ষেত্রে বৈষম্যমুক্তি, কর্মীদের সামাজিক সুরক্ষা নিশ্চিত করাও কি কর্তব্য নহে? ভারতের সেরা বাণিজ্যিক সংস্থাগুলির মূল্যায়ন করিয়া বাৎসরিক রিপোর্ট বাহির করিতেছে তিনটি অসরকারি সংস্থা। দায়িত্বশীল ব্যবসায়ের সূচক (‘ইন্ডিয়া রেসপনসিবল বিজনেস ইন্ডেক্স’) বলিতেছে, নিরানব্বইটি সংস্থার মাত্র উনিশটিতে প্রতিবন্ধীদের উপযোগী ব্যবস্থা রহিয়াছে। তুলনায় নারী অধিকারের প্রশ্নে তাহারা অধিক তৎপর। পঁচানব্বইটি সংস্থা যৌন হয়রানি-বিরোধী নীতি কার্যকর করিয়াছে। রিপোর্ট প্রণেতাদের মতে, নারী সংগঠনগুলি অধিক সরব। তুলনায় প্রতিবন্ধীদের আন্দোলন তেমন ছাপ ফেলিতে পারে নাই। তাই এই পার্থক্য। সান্ত্বনা ইহাই যে, ‘নিয়োগ প্রক্রিয়ায় কাহাদের প্রতি বৈষম্য ঘটিতে পারে,’ এই প্রশ্নের উত্তরে নারী ও প্রতিবন্ধীদেরই চিহ্নিত করিয়াছে অধিকাংশ সংস্থা। কিন্তু জনজাতি, কিংবা তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের প্রতিও বৈষম্য ঘটিতে পারে, সে-বিষয়ে তাহাদের সতর্কতা সামান্য।

Advertisement

সম্ভবত বেসরকারি সংস্থাগুলির সর্বাপেক্ষা বড় দুর্বলতা চুক্তি-শ্রমিকদের কল্যাণের ব্যবস্থায়। সংগঠিত ক্ষেত্রেও যে অসংগঠিত শ্রমিক বাড়িতেছে, তাহা প্রতীয়মান। এই বৎসর ‘নিয়োগ ও বরখাস্ত’ নীতি আরও প্রসারিত করিয়াছে কেন্দ্রীয় সরকার, তাই চুক্তি-শ্রমিকের পরিসর আরও বাড়িবে। এই পরিস্থিতিতে সামাজিক উন্নয়নের জন্য চুক্তি শ্রমিকের অধিকারের সুরক্ষা ও তাহার কল্যাণ আরও গুরুত্বপূর্ণ হইয়া উঠিয়াছে। এই পরিস্থিতিতে ভারতের শীর্ষ নিরানব্বইটি সংস্থার মাত্র চৌদ্দটি চুক্তি-শ্রমিককে ন্যূনতম মজুরি দিবার নীতি গ্রহণ করিয়াছে। ভবিষ্যনিধি যোজনা এবং স্বাস্থ্যবিমার সুবিধা দিয়াছে কেবল ছয়টি কর্পোরেট সংস্থা। অথচ চুক্তি-শ্রমিকদের হয়রানি, তাঁহাদের অতিরিক্ত কাজ ও কম মজুরি দিবার অভিযোগ কম নহে। ২০১৬ সালে বেঙ্গালুরুর বস্ত্রশিল্পে কর্মরত মহিলা শ্রমিকদের বিপুল প্রতিবাদের পর প্রকাশ পাইয়াছিল, সীমিত সময়ের চুক্তিতে আবদ্ধ হইবার ফলে তাঁহাদের কী অমানবিক কর্মপরিস্থিতি মানিয়া লইতে হয়। বহু ক্ষেত্রে ঠিকাদার চুক্তিশ্রমিকের সুরক্ষা ও সুবিধা হইতে মজুরদের জানিয়া-বুঝিয়া বঞ্চিত করে। শ্রমিক সংগঠনের নেতা, সরকারি শ্রম দফতরের আধিকারিক, কর্পোরেট সংস্থার মানবসম্পদ বিভাগের কর্তা, চুক্তিশ্রমিকের সুরক্ষার প্রশ্নে সকলেই উদাসীন।

দেশের অর্থনীতি কী হারে বাড়িবে, তাহা লইয়া দুশ্চিন্তার শেষ নাই। সেই চিন্তা অসংগত নহে, বস্তুত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু সমাজের এক বিরাট অংশ যে আর্থিক বৃদ্ধির ভাগ পাইতেছেন না, সে-বিষয়ে আলোচনা হয় সামান্যই। দেশের ১ শতাংশ মানুষের হাতে তিয়াত্তর শতাংশ সম্পদ, সম্প্রতি এই সংবাদে অনেকেই চমকিত হইয়াছেন। কিন্তু তাহার প্রতিকারের উদ্যোগ কোথায়? একেই দেশে নূতন নিয়োগ বাড়ে নাই। নিয়মিত বেতনের চাকরি ভারতে মোট কাজের কুড়ি শতাংশও নহে, যাহা চিনে আশি শতাংশেরও অধিক। অসংগঠিত ক্ষেত্রে কাজ বাড়াইয়া দেশের উন্নয়ন হইবে না, কর্মীরও উন্নতির আশা সামান্য। কাজ বাড়াইতে হইবে সংগঠিত ক্ষেত্রে। সেই সঙ্গে সংগঠিত ক্ষেত্রকে স্বচ্ছ ও সংবেদনশীল করিতে হইবে। বৃহৎ বাণিজ্যিক সংস্থাগুলিও যদি মহিলা, দলিত-জনজাতি-সংখ্যালঘুকে স্থান না দেয়, যদি প্রতিবন্ধীর প্রতি উদাসীন, চুক্তিশ্রমিকের প্রতি কৃপণ হয়, তবে বৈষম্য এবং অসাম্যের পরিচিত ছবি আরও গাঢ় হইবে। ইহাই কি নূতন ভারতের চিত্র?

Advertisement
(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন