সম্পাদকীয় ২

উপযুক্ত কাজ

নরেন্দ্র মোদী কি নৈশভোজনের পর বাসন মাজিয়া থাকেন? মনমোহন সিংহ কি আটা মাখিয়া স্ত্রীকে সাহায্য করিতেন? ভারতীয় নেতারা ভাগ্যবান, এই প্রশ্নগুলি কখনও ওঠে নাই।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১৩ মে ২০১৭ ০০:০০
Share:

নরেন্দ্র মোদী কি নৈশভোজনের পর বাসন মাজিয়া থাকেন? মনমোহন সিংহ কি আটা মাখিয়া স্ত্রীকে সাহায্য করিতেন? ভারতীয় নেতারা ভাগ্যবান, এই প্রশ্নগুলি কখনও ওঠে নাই। নেতা ও আমলাদের বাংলোতে সরকারি বেতনভোগী পরিচারক প্রচুর, ফলে তাঁহাদের কুটোটি নাড়িবার প্রয়োজন হয় না। এমনকী উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মীরা চাহিলেও নিজের ব্রিফকেস নিজে বহন করিতে পারেন না, তাহার মনোজ্ঞ বিবরণ ভূতপূর্ব মুখ্য অর্থনৈতিক উপদেষ্টা কৌশিক বসু লিখিয়াছেন। ব্রিটেনের প্রাক্তন উপনিবেশ ভারত যে ধারাটি ধরিয়া রাখিয়াছে, ব্রিটেন তাহা ত্যাগ করিয়াছে বহু পূর্বে। কিছু দিন পূর্বেই ভারতবাসী অবাক হইয়া দেখিয়াছিল তৎকালীন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন দশ নম্বর ডাউনিং স্ট্রিট ছাড়িবার প্রাক্কালে স্বয়ং প্যাকিং বাক্স বহিতেছেন। গৃহকর্মের বিভাজন বিষয়ে বেফাঁস মন্তব্য করিয়া এখন নিন্দিত হইতেছেন ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী। টেরেসা মে বলিয়াছেন, আবর্জনার পাত্র বাহিরে লইবার কাজটি তাঁহার স্বামীই করেন, ওই কাজ তো পুরুষদেরই।

Advertisement

ইহাতেই সমালোচনা ঝড় উঠিয়াছে। ব্রিটেনের দ্বিতীয় মহিলা প্রধানমন্ত্রী হইয়াও লিঙ্গ-পরিচিতি দিয়া সমাজে-সংসারে নারী-পুরুষের ভূমিকা নির্দিষ্ট করিবার কুঅভ্যাসটি কেন ছাড়িতে পারেন নাই? গৃহকর্মের আবার পুরুষ-মহিলা কী? ভারতীয়রা অবশ্য বলিবেন, গৃহকর্মে সত্যই পুরুষ-মহিলা বিভাগ নাই, কারণ তাহার সবটাই মহিলার কর্তব্য। রবিবারের মাংসরন্ধন প্রভৃতি কিছু উপভোগ্য কর্ম ব্যতীত নিত্যকার পৌনঃপুনিক গৃহকর্ম যে পুরুষদের জন্য নির্দিষ্ট হইতে পারে, তাহা শুনিয়াই তাজ্জব হইবে অধিকাংশ ভারতীয় পুরুষ। পুরুষদের কর্মস্থল বাহিরে ও মহিলাদের অন্দরে, এই ধারণা জন্মগত নারী-পুরুষ বিভাজনের মতোই স্বতঃসিদ্ধ বলিয়া মনে করেন অধিকাংশ ভারতীয়। গ্রামীণ পেশাগুলিতেও পুরুষ ও নারীর কর্তব্যে বিভাজন অতি নির্দিষ্ট। নারী সুতায় রং করিবেন, কিন্তু তাঁতে বসিবেন কেবল পুরুষ। হাল চালাইবেন পুরুষ, চারা রোপণ নারী করিবেন। আধুনিক যন্ত্র আসিবার ফলে পেশিশক্তির প্রয়োজন ফুরাইয়াছে, কিন্তু বিস্মৃত পথের মাইলফলকের ন্যায় বিভাজনগুলি থাকিয়া গিয়াছে। বাহিরের কাজ নারীও করিতে পারে, গৃহকাজ করিতে পুরুষের বাধা নাই, সেই ধারণা ভারতের পরিবারে ঢুকিতে পারে নাই।

রাজনৈতিক নেতারাও এই পরিবর্তনে নেতৃত্ব দিতে আগ্রহী নহেন। গাঁধীর সাম্যের বাণী কপচাইতে তাঁহাদের জুড়ি নাই। কিন্তু ছাগল পালন বা সুতা কাটিবার মতো কাজ, যাহা বরাবর মেয়েদের জন্য নির্দিষ্ট, তাহা নিজের হাতে করিবার সাহস গাঁধীর পর কোনও পুরুষ নেতা দেখান নাই। অথচ গৃহকর্ম একা নারীর দায়িত্ব বলিয়া নির্দিষ্ট করিবার জন্য ভুগিতেছে গোটা দেশ। কর্মক্ষেত্রে মেয়েদের যোগদানের হার মাত্র সাতাশ শতাংশ, যাহা অধিকাংশ দেশের পশ্চাতে ফেলিয়াছে ভারতকে। উচ্চশিক্ষার প্রসার ঘটিলেও মহিলারা কাজে সমাজ ও সংসারের প্রত্যাশা অনুসারে গৃহকাজে আত্মনিয়োগ করিতে বাধ্য হন। সমাজে যে বৈষম্য, সংসারেই তাহার সূত্রপাত। সেখান হইতেই তাহাকে দূর করিতে হইবে। ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী আবর্জনা বাহিরে লইয়া যান, ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী উজ্জ্বলা প্রকল্পের উনানে অন্ন পাক করিয়া পরিবেশন করুন মহিলাদের।

Advertisement
(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন