বন্দুকের অধিকার নিয়ে রাজনীতিকরা যখন প্রশ্ন তোলেন না

ওদের ক্রোধের উপরই ভরসা

শুটিংয়ে আক্রান্ত ছাত্রছাত্রীদের আমরা প্রতিবাদে সরব হয়ে উঠতে দেখলাম, প্রতিজ্ঞা করতে দেখলাম যে— আর নয়, ফ্লরিডার ঘটনাই হোক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসের পাতায় ‘সর্বশেষ মাস শুটিং’।

Advertisement

প্রতীতি দেব

শেষ আপডেট: ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ ০৬:০০
Share:

ভর্ৎসনা: ফ্লরিডার স্কুলে সতেরো জন নিহত হওয়ার পর বন্দুক-রাজনীতির বিরুদ্ধে স্কুলছাত্রী এমা গঞ্জালেস-এর তীব্র প্রতিবাদ। ছবি: এএফপি

গত ছ’বছর ধরে আমি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাসিন্দা। এই কয়েক বছরের মধ্যেই এ-দেশকে প্রায় পঞ্চাশটি ‘মাস শুটিং’ কাণ্ডের সাক্ষী হতে দেখলাম, যার মধ্যে অন্তত দুটি ঘটনাকে বলা যায় এ-দেশের ইতিহাসে এখনও অবধি মারাত্মকতম। প্রতিটি হত্যাকাণ্ডের পর আমরা এখানে শোক পালন করি, রাজনৈতিক মহল থেকে ‘থটস অ্যান্ড প্রেয়ার্স’-এর বুলি শুনি, এবং তার পর দ্রুত ফিরে যাই সেই গতানুগতিক স্থিতাবস্থায়, পরবর্তী শুটিং-এর জন্যে নিরুপায় অপেক্ষায়। গত সপ্তাহে ভ্যালেন্টাইন্স ডে-তে ফ্লরিডার পার্কল্যান্ডে এক উচ্চ বিদ্যালয়ে শুটিং কাণ্ডে ১৭ জন নিহত হলেন। আমরা যখন প্রস্তুত হচ্ছি সেই একই রুটিনের জন্য, হঠাৎই এ বার অন্য রকম হয়ে গেল সব কিছু। শুটিংয়ে আক্রান্ত ছাত্রছাত্রীদের আমরা প্রতিবাদে সরব হয়ে উঠতে দেখলাম, প্রতিজ্ঞা করতে দেখলাম যে— আর নয়, ফ্লরিডার ঘটনাই হোক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসের পাতায় ‘সর্বশেষ মাস শুটিং’। সোশ্যাল মিডিয়ায় রাজনৈতিক নেতৃত্বকে তারা সরাসরি ভর্ৎসনা জানাল। নবীন কণ্ঠস্বরগুলির মধ্যে সবচেয়ে নাড়িয়ে দিল স্কুলছাত্রী এমা গঞ্জালেস। এমা যেন একাই আমেরিকার জাতীয় নিষ্ক্রিয়তার মূলে তীব্র আঘাত। সোজাসুজি ‘গান কন্ট্রোল’ দাবি করলেন এমা। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে তীক্ষ্ণ আক্রমণ করলেন, নির্বাচনী প্রচারে ন্যাশনাল রাইফ্‌ল অ্যাসোসিয়েশন থেকে তিন কোটি ডলার চাঁদা নেওয়ার জন্য।

Advertisement

মার্কিন দেশে যে কোনও শুটিং-এর পরই দেখা যায়, বন্দুক-লবির কোটি কোটি ডলারে পুষ্ট রাজনীতিবিদরা বন্দুক নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি চাপাচুপি দিতে অত্যন্ত ব্যস্ত হয়ে পড়ছেন। প্রতিবাদকারীদের কণ্ঠরোধ করতে উদ্যোগী হচ্ছেন। এমা কিন্তু বুঝিয়ে দিলেন, নবীন অপ্রতিরোধ্য কণ্ঠের অধিনায়কত্বে আজ জাতীয় মঞ্চে এই বিষয়ে বিশ্লেষণ ও আলোচনা সম্ভব হলেও হতে পারে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বন্দুকের কেনাবেচার উপর আইনি নিয়ন্ত্রণ বাড়ানো কতখানি আবশ্যিক, তা আর বলার নয়। কিন্তু সেই আলোচনাটারও অতিসরলীকরণ কাম্য নয়। বন্দুক নিয়ন্ত্রণ যাঁরা চান, সেই ‘লিবারাল’দের বক্তব্যেও সম্প্রতি মানসিক রোগ এবং হিংসাত্মক প্রকৃতিকে গুলিয়ে ফেলার এক উদ্বেগজনক প্রবণতা দেখতে পাচ্ছি আমরা। অথচ বিশ্বের সব দেশেই মানসিক রোগ আছে, কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তুলনীয় বন্দুক শুটিং-এর প্রকোপ নেই কোথাও। বন্দুক নিয়ন্ত্রণের বিষয়ে আলোচনাকে অতিরিক্ত মাত্রায় মানসিক স্বাস্থ্যের সঙ্গে জড়িয়ে ফেললে, আমরা মানসিক রোগীদেরই অপরাধী করে তুলি। সমাজে এমনিতেই এক কোণে পড়ে থাকা মানুষগুলিকে কঠোর রাষ্ট্রীয় নজরদারির হাতে তুলে দিই— যদিও গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে যে মানসিক রোগগ্রস্ত মানুষরা নির্যাতনকারী হওয়ার চেয়ে নির্যাতনের শিকার হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি।

বন্দুক নিয়ন্ত্রণ সমাজের সার্বিক সুরক্ষা নিশ্চিত না করে প্রান্তিক গোষ্ঠীর মানুষকে নিপীড়নের হাতিয়ার হয়ে উঠতে পারে, এই শিক্ষা আমরা ইতিহাস থেকে ভূরি ভূরি পাই। মনে রাখতে হবে, মার্কিন দেশের বন্দুক-নিয়ন্ত্রণকারী আইনের ইতিহাস এক নজিরবিহীন বাঁক নিয়েছিল ১৯৬৭ সালে, যখন তৎকালীন ক্যালিফর্নিয়ার রাজ্যপাল রোনাল্ড রেগানের সই করা মালফোর্ড অ্যাক্ট পাশ হয়। ব্ল্যাক প্যান্থার পার্টির বিপ্লবীরা বন্দুক হাতে তুলে নিয়েছিলেন এ-দেশের কালো মানুষদের বর্ণবিদ্বেষের আতঙ্ক থেকে রক্ষা করতে, আর তাই তড়িঘড়ি এই আইন পাশ করানো হয়েছিল সাদা সমাজের স্বার্থরক্ষার জন্য। আজকের কুখ্যাত বন্দুক-সমর্থনকারী লবি অর্থাৎ ন্যাশনাল রাইফ্‌ল অ্যাসোসিয়েশনও কিন্তু সে-দিন প্রত্যক্ষ ভাবে বন্দুক-নিয়ন্ত্রণকেই সমর্থন করেছিল! অর্থাৎ বন্দুক নিয়ন্ত্রণ হবে কি না, সেটা অনেকেই ঠিক করেন সমাজের উঁচু তলার মানুষের স্বার্থরক্ষার কথাটা ভেবেই। ‘গান কন্ট্রোল’ বিষয়ে যে কোনও নীতিনির্ধারণের পথে এগোনোর আগে এই বৈষম্যের ইতিহাসটা মনে রাখা দরকার, যাতে ভবিষ্যতের এই আইন বা আইনের অভাব কোনও ভাবে সমাজের বিপন্ন গোষ্ঠীর মানুষকে বিপন্নতর করে না তোলে।

Advertisement

খেয়াল করা দরকার, ‘মাস শুটিং’-এর ঘটনায় বন্দুকধারীরা অধিকাংশই পুরুষ, এবং সাদা পুরুষ। সঙ্গে এটাও খেয়াল করা ভাল যে, এই বন্দুক-হানাহানির দাম যাঁরা প্রাণ দিয়ে দিচ্ছেন, তাঁরা সকলেই ‘প্রান্তিক’ মানুষ, শিশুরাও যার মধ্যে পড়ে। ফ্লরিডার পাল্স নাইটক্লাবে ৪৯ জন সমলিঙ্গ সমাজের মানুষ খুন হন ২০১৬ সালে। ২০১৫-য় ৯ জন কালো মানুষ খুন হন চার্লস্টন-এর আফ্রিকান-আমেরিকান গির্জায়। ২০১৪-য় ইসলা ভিস্তায় এক নারীবিদ্বেষীর বন্দুকে খুন হন ছ’জন, তার মধ্যে দু’জন কলেজ ছাত্রী। প্রতিটি ঘটনায়, বন্দুকধারীটি পুরুষ। এই পুরুষদের বিকৃত আত্মকেন্দ্রিক দর্শন বিশ্বাস করে যে তাদের পারিপার্শ্বিক সমাজ তাদের সঙ্গে ঘোরতর অন্যায় করেছে, এবং সেই কল্পিত অন্যায়ের অপরাধে তারা মানুষ খুন করে ন্যায়ের পথে হাঁটছে। সমকামী মানুষের নাইটক্লাবে আনন্দ, কালো মানুষের উপাসনার অধিকার, নারীর কলেজ ক্যাম্পাসের মুক্ত জীবন, এ-সব কিছুই তাদের ভঙ্গুর পৌরুষের পক্ষে চরম পীড়াদায়ক!

এই আক্রমণকারীদের মধ্যে কারও কারও প্রত্যক্ষ যোগ ছিল সাদা বর্ণবৈষম্যবাদী (‘হোয়াইট সুপ্রিমেসিস্ট’) সংগঠনগুলির সঙ্গে। লক্ষণীয়, গত সপ্তাহের পার্কল্যান্ডের স্কুলের বন্দুকধারীর ইনস্টাগ্রামে পাওয়া গেছে তার নিজের ছবি, স্বয়ং ট্রাম্প-এর স্লোগান-লেখা (‘মেক আমেরিকা গ্রেট আগেন’) টুপি-পরা চেহারায়। যোগসূত্রটা বুঝতে অসুবিধে হয় না। এই বন্দুকধারীদের মধ্যে আর একটি যোগ— নারীবিদ্বেষ। পার্কল্যান্ড স্কুলের এই আক্রমণকারীও কিন্তু তার প্রাক্তন প্রেমিকাকে নিয়মিত নির্যাতন করত, জানা গিয়েছে। অর্থাৎ, যে সংস্কৃতি এই হিংসাত্মক পৌরুষকে মহিমান্বিত করে, সেই একই হিংসার সংস্কৃতি বন্দুক তুলে দেয় সেই পৌরুষের প্রতিনিধিদের হাতে! আর অতি সহজলভ্য বন্দুকের গুলিতে তারা একের পর এক সহজ টার্গেটকে খুন করে চলে, শিশুদের বা ছাত্রছাত্রীদের।

স্যান্ডি হুক এলিমেন্টারি স্কুলে ২০১২-র মর্মান্তিক ঘটনাটা মনে না করে পারছি না। ছ’বছরের শিশুর অকারণ হত্যাও যদি রাজনীতিকদের বিবেক জাগ্রত করতে না পারে, তবে আর কোথায় আশা? কোথায় আশা, যখন প্রেসিডেন্ট নিজেই বন্দুক লবির দ্বারা সমর্থিত? যখন এই বিষাক্ত হিংসাত্মক পৌরুষের জীবন্ত উদাহরণ প্রেসিডেন্ট মশাই নিজেই, এবং তাঁর ঘনিষ্ঠ রাজনৈতিক পরিমণ্ডলের অনেকেই, তাঁরই মতো, নারীনির্যাতনের দায়ে সরাসরি অভিযুক্ত, আশা কি রাখা যায়?

হয়তো যায়। আশান্বিত হই— যখন দেখি হাই স্কুলের ছাত্রী এমা গঞ্জালেস, ন্যাড়া মাথায়, এক হাতে ইতিহাস ক্লাসের নোট, অন্য হাতে রংবেরঙের ‘ফ্রেন্ডশিপ ব্রেসলেট’, নিহত বন্ধুদের শোকে অশ্রুপাত করতে করতে দৃপ্ত কণ্ঠে তীব্র ভাষায় প্রতিবাদ জানাচ্ছে। যখন দেখি দেশের কোনায় কোনায় ‘টিনএজার’রা বেরিয়ে এসে মিছিল মিটিং-এর পরিকল্পনা করছে। যে সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারের জন্য তাদের গোটা প্রজন্মকে অবিরত ব্যঙ্গবিদ্রুপ শুনতে হয়, সেই সোশ্যাল মিডিয়াকেই তারা দেশব্যাপী সংগঠনের অস্ত্র করে তুলছে।

যখন দেখি, স্কুলের ক্লাসরুমে টেবিলের উপর অথবা দরজার পিছনে জড়োসড়ো হওয়া শিশুরা— যারা জানে না কোন দিন কখন এই নিরাপত্তা ‘ড্রিল’ সত্যিকারের শুটিং হয়ে উঠতে পারে— ক্লাসরুম থেকে বেরিয়ে দূরদর্শনের পরদায় দাবি করছে ‘গান কন্ট্রোল’। আশা জাগে। এ-দেশের বড়দের চরম নৈতিক ও রাজনৈতিক ব্যর্থতার উপযুক্ত উত্তরই হয়তো এ-দেশের ছোটদের ক্রোধের আগুনে লুকিয়ে!

শিকাগো ইউনিভার্সিটির ইনস্টিটিউট অব মলিকিউলার ইঞ্জিনিয়ারি‌ং-এ গবেষণারত

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন